আলোয় অন্ধ শহর: বাংলাদেশের মৌলিক সাইন্স ফিকশন

আবু সাঈদ আহমেদ

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৩:০১ পিএম | আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:১৫ এএম

বাংলা সাহিত্যে সাইন্স ফিকশন নতুন কোনো বিষয় নয়। ১৮৯৮ সালে এইচ জি ওয়েলসের দ্য ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস প্রকাশিত হবার এক দশক আগেই জগদানন্দ লিখেছিলেন 'শুকর ভ্রমণ' (ট্রাভেলস টু শুক্র)। ওয়েলসের মঙ্গল গ্রহের এলিয়েনদের বর্ণনার এক দশক আগেই শুক্র গ্রহের প্রাণীদের দেখা পেয়েছিলো বাংলা ভাষার পাঠক। জগদানন্দ রায় প্রথম সাইন্স ফিকশন লিখলেও বাংলা ভাষার সাইন্স ফিকশনের পিতা হিসেবে বিবেচিত হন জগদীশচন্দ্র বসু। তিনি নিজেই বিজ্ঞানী হওয়ায় তার কল্পকাহিনীগুলো পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা। আবার বেগম রোকেয়ার 'সুলতানার স্বপ্ন' বিশ্বের প্রথম নারীবাদী বিজ্ঞান কল্পকাহিনী। অর্থাৎ, বাংলা সাইন্স ফিকশনের বয়স প্রায় শত বছরেরও বেশি।

আমাদের একজন হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন। 'তোমাদের জন্য ভালবাসা' লিখেছিলেন ১৯৭৩সালে। বাংলাদেশের প্রথম সাইন্স ফিকশন। এরপর আরো সাইন্স ফিকশন লিখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি বিজ্ঞান আর মানবিক আবেগের এমন রসায়ন সৃষ্টি করেছিলেন যে, পাঠক সাইন্স ফিকশনের প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠেছিলো। ওপার বাংলায় সত্যজিৎ রায় আর এপারে হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাইন্স ফিকশনের স্বকীয় চরিত্র প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

কিন্তু এরপর বাংলাদেশের সাইন্স ফিকশনের ইতিহাস দুর্ভাগ্যজনক- শুধু পিছে হাঁটা আর স্থবিরতা। মৌলিক লেখার অভাব, একজন বাণিজ্যিক সাইফাই লেখক কতৃক মূল লেখা উল্লেখ না করে পশ্চিমা সাইফাইয়ের ছায়া অবলম্বন তথা চুরি, দুর্বল অনুবাদ, কপি কাট পেস্ট সাইফাই সাহিত্য বাংলাদেশের মৌলিক সাইন্স ফিকশন সাহিত্যকে রীতমত কলুষিত করেছে।

বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে টার্গেট গ্রুপ নির্ধারণ করে লেখার ফলে সব বয়সী পাঠকদের তৃষ্ণা মেটানো বাংলা সাইন্স ফিকশন বর্তমানে হয়ে উঠেছে শুধুমাত্র কিশোর পাঠ্য। দুই একজন ব্যাতিক্রম বাদে দেশের সাইফাই লেখকরা তাকে অনুসরণ করায় একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশের সাইফাই। ফলে, প্রথম দিকে এসব কপি কাট পেস্ট সাইফাই সাহিত্যের দারুণ চাহিদা থাকলেও, কিশোর বয়সী পাঠকদের কাছেও এখন আর তেমন আবেদন নেই। 

সালাহউদ্দীন শুভ্রের লেখা 'আলোয় অন্ধ শহর' নিয়ে লিখতে গিয়ে উপরের কথাগুলো বলার কারণ কি? কারণ একটাই, বহু বছর পর বাংলাদেশি সাইন্স ফিকশন, বাংলাদেশের সাইন্স ফিকশন পড়লাম। আলোয় অন্ধ শহরে লেখক সহস্র আলোকবর্ষ দূরের কোনো গ্রহ, হাজার বছর পরের বিপন্ন পৃথিবী, প্রযুক্তির কাছে পরাজিত মানুষ, অদ্ভুত বা মানবিক এলিয়েনদের কথা বলেননি, তিনি মাত্র দেড়শো বছর এগিয়ে গেছেন, সেও এই চির পরিচিত ঢাকায়।

গল্পের মূল চরিত্র রিমেক বর্তমানের স্মৃতি নিয়ে পৌছে গেছে দেড়শো বছর পরের ঢাকায়, ট্রাভেলের শরীর নিয়ে। দেড়'শ বছর পরের ঢাকায় রিমেক আগুন্তক, কিন্তু কেউ তাকে আগুন্তক হিসেবে বিবেচনা করেনা, ট্রাভেল হিসেবে দেখে অথবা দেখার অভিনয় করে। দেড়শো বছর পরের ঢাকা সম্পর্কে রিমেকের বোধ তাই 'এখানে সব তীব্র আর মানুষ ঠাণ্ডা।'

ভবিষ্যতের ঢাকার বর্ণনা পাঠক বই পড়েই জানতে পারবেন। সুন্দর আর গোছানো শহর। জনজীবন স্বস্তিময়। বিভিন্ন গ্যাজেট আর ডিভাইসের ব্যবহার। তরুণরা গেমসে আসক্ত, যখন তারা মায়ের সাথে কথা বলে তখনও তারা মূলত গেমসই খেলে। এত আনন্দের মাঝেও ভবিষ্যতের ঢাকাবাসী সর্বক্ষণ সিকিউরিটি সার্ভিল্যান্সের আওতায় বন্দী। কেন এতো সিকিউরিটি সার্ভিল্যান্স! কাদের স্বার্থে" সেখানেও কি গুম হয়! বিশেষ সংস্থার তৎপরতায় ফিরে আসে প্রশ্নশূন্য মানুষ! ব্রেইন ট্রান্সপ্ল্যান্টের কাহিনীর পরতে পরতে শুভ্র সুচতুর ভাবে রাজনীতি আর সমকালীন প্রেক্ষাপটের ভবিষ্যত ফলাফল মিশিয়েছেন। দেড়শো বছর পরের ঢাকায় রিমেকের "চেনা দুনিয়াই সম্পূর্ণ অচেনা, এখানে এত আলোর মধ্যে সে শুধুই অন্ধকার দেখছে।" কিন্তু সত্যিই কি শুধু অন্ধকার! আলোর আভার ডাক নেই! 

হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের, বাংলাদেশের সাহিত্যের যে ইউনিক ভাষারীতি সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার প্রভাব প্রায় সর্বগ্রাসী। অনেকেই ইচ্ছে করে, চেষ্টা করে হুমায়ূন আহমেদের মত ভাষায় লেখে, অনেকে অজান্তেই ওই ভাষায় লেখে। তবে অল্প যে ক'জন লেখক খুব সচেতনভাবে গদ্যের নিজস্ব ভাষারীতি তৈরীতে সচেষ্ট আছেন শুভ্র তাদের একজন। নিজস্ব ভাষারীতিতেই লিখেছেন সাইন্স ফিকশন "আলোয় অন্ধ শহর"। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর নামকরণ আর বৈশিষ্ট্য, কাহিনীতে মানবিকতা, আবেগ, সামাজিক দায়বদ্ধতা আর রাজনীতির মিশ্রণে 'আলোয় অন্ধ শহর' হয়ে উঠেছে মৌলিক বাংলা সাইন্স ফিকশন। 

আলোয় অন্ধ শহর প্রকাশ করেছে বৈভব। বইটি হাতে নিলেই মন ভরে যায়। চমৎকার প্রোডাকশন। গায়ের মূল্য ৪৫০টাকা হলেও মেলায় ২৫% কমিশন বাদ দিয়ে দাঁড়ায় ৩৩৮টাকা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh