অমর একুশে গ্রন্থমেলা

আন্তর্জাতিক মানের হতে আর কতদিন

জোবায়ের মিলন

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:৪৫ এএম | আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:৪৬ এএম

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

অমর একুশে গ্রন্থমেলার বয়স ৪৮ বছর (১৯৭২-২০২০)। বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমি) উঠানে চিত্তরঞ্জন সাহার সেই চটে বিছানো বই নিয়ে বসা থেকে আজকের বিশাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। 

আকারে, প্রকারে, প্রকাশে, বিকাশে গ্রন্থমেলার বিস্তার সারাদেশে বিস্তৃত। শুধু দেশে নয়, প্রবাসী ও বাংলাভাষীর কাছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বইমেলা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও প্রিয়। লাখ লাখ বইপ্রেমী বইমেলায় উপচে পড়ে। বিশাল আয়তনে আয়োজিত হয়েও মানুষ ধরে না। দেখে মনে হয়, লেখক-পাঠক-প্রকাশক উৎসুকদের ভিড়ে বইমেলার আয়তন আরো বিশালতার দাবি রাখে। 

কিন্তু আয়তনে বড় হলেও গুণগত মান কি বাড়ছে? অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে আন্তর্জাতিক মানের করতে আর কতদিন সময় নেবে বাংলা একাডেমি? একুশে ফেব্রুয়ারি এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। একুশ যদি আন্তর্জাতিক হতে পারে, একুশের চেতনার ওপর নির্মিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা আন্তর্জাতিক হতে দোষ কোথায়? 

আমরা যদি প্যারিস আন্তর্জাতিক বইমেলার দিকে লক্ষ্য করি, তবে দেখবো- তারা গত বছর পঞ্চাশটি দেশকে তাদের মেলায় অংশগ্রহণ করাতে পেরেছে, ৩৯০ জন লেখককে একত্রিত করেছে ও এক লাখ ৬৫ হাজার ভিজিটর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের বইমেলায় হাজির করেছে। 

ফ্রাঙ্কফুর্ট, লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্রের বইমেলাকে যদি দেখি- সেখানে সারাবিশ্ব থেকে হাজার হাজার বইপ্রেমী অংশগ্রহণ করেন। বাড়ির কাছে দিল্লি বা কলকাতা, নেপাল বা মালয়েশিয়ার বইমেলায়ও দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই, সেখানেও বিশ্বের নানান জায়গার পাঠক-লেখক-প্রকাশক ও বই-সম্পৃক্ত মানুষের উপস্থিতি। 

২০২০ সালের কলকাতা বইমেলায় তারা হাজির করেছে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনকে; সাথে সীমানা ঘেঁষা বাংলাদেশ তো আছেই। এই উপস্থিতির কারণেই কি কেবল আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠা, নাকি আন্তর্জাতিক মানের হওয়ার কারণেই সেখানে বিভিন্ন দেশের বই-সম্পৃক্ত মানুষ উপস্থিত হয়েছেন নানান প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে? 

জানা যায়, এসব আন্তর্জাতিক বইমেলা শুরুতে সবাই যার যার দেশের গণ্ডিতেই সীমিত ছিল, তারপর তারা মানে-গুণে আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছেছে। তাই প্রশ্ন জাগে- অমর একুশে গ্রন্থমেলা এত বছরেও কেন আন্তর্জাতিক মানে যেতে পারছে না? বরং প্রতি বছরই বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলার মানকে ঘিরে শোনা যায় অসংখ্য ত্রুটির কথা। বিচ্যুতির কথা। তাদের অবহেলা ও অসামর্থ্যরে কথা। 

একুশে গ্রন্থমেলায় কলকাতা থেকে আগত কবি সন্দীপন ধর জানান, ‘কলকাতা, দিল্লি বইমেলার সময়ে চারপাশের নিরাপত্তা যেমন কঠোর, তেমনি মেলার অভ্যন্তরে পরিচ্ছন্নতা, পরিকল্পনা চোখে পড়ার মতো। সেখানে পাঠক ও বইপ্রেমীদের জন্য থাকে বিশেষ বাস সার্ভিস, উবার বা ওলায় থাকে ডিসকাউন্ট; পাঠে আগ্রহ তৈরির জন্য থাকে বই নিয়ে নানা প্রকার কর্মযজ্ঞ। বিশেষত, পাঠক-লেখক-প্রকাশক ও আগতদের জন্য থাকে ফুড কর্নার, যার সঠিক নিয়ন্ত্রণ থাকে আয়োজকদের নজরে। প্রতিদিন শেষে বিক্রির রশিদ জমা দিতে হয়, বই-এর তথ্য ও অর্থের হিসাব রাখা হয়। একটি নিউজ লেটার বের হয়, যা থেকে বইমেলার প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা হয়।’ 

বাংলা একাডেমি কি এমনটা করে? 

অনুবাদক, গল্পকার মোজাফ্ফর হোসেন যোগ করেন আরো কিছু কথা, ‘অন্যান্য দেশের মেলাগুলোর মান নিয়ে বলার মতো তেমন কিছু পাওয়া যায় না সাধারণত, তারা মানোন্নত। লেখক, পাঠকসহ দর্শনার্থীদের কথাও তারা ভাবেন মনোযোগ দিয়ে। তারা মানকে যেমন গুরুত্ব দেন, তেমনি নিরাপত্তাকেও। আমাদের মেলা ঘোরাঘুরির মানুষে ঠাসা, বাইরের মেলাগুলোতে প্রয়োজনীয় মানুষে ভরা। টেকনিক্যাল বিষয়ে তারা সরব, যেমন- বিশুদ্ধ পানি, পরিচ্ছন্ন ওয়াশরুম, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা কর্মী, পরিচ্ছন্ন কর্মী, স্বেচ্ছাসেবক, আলো ব্যবস্থাপনা, স্টল ব্যবস্থাপনা, তথ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিতে তুলনাহীন।’ 

লেখক মজিদ মাহমুদ তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘বাংলা একাডেমির কাজ গ্রন্থমেলা আয়োজন করা নয়। তাদের কাজ অন্য কিছু। একই সাথে অনেক কাজ করতে যেয়ে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে বাংলা একাডেমি। তারা না পারছে মেলাটি বোধের জায়গায় এগিয়ে নিতে, না পারছে তাদের কাজ সুচারুভাবে করতে। শুধু তো জায়গা বড় করে দিলেই একটি গ্রন্থমেলা সার্থক হয় না! এর পিনপতন পর্যন্ত দেখতে হয়। লন্ডন বইমেলা, ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা দেখলে মনে হয় কোনো অভিজাত শপিংমলে প্রবেশ করেছি। তাদের মেলায় বইয়ের অর্ডার কাটা হয়। নির্দিষ্ট সময়ে তা ডেলিভারি দেয়া হয়। কোনো কারণে পাঠকের পছন্দ না হলে বা ত্রুটি ধরা পরলে তা ফেরত নেয়া হয়। তাদের বাহ্যিক দিকটা যেমন উজ্জ্বল, তেমনি ভেতরের বিষয়গুলোও উজ্জ্বল। মানের বিষয়ে তাদের কাছে কোনো ছাড় নেই। তারা মেধা মনন ও তার মানের উন্নয়নে কাজ করে, জাতীয় কল্যাণে কাজ করে; আর আমাদের এখানে কিছু বিষয়ের প্রচার ও প্রসারের কাজে সময় ব্যয় করা হয়। নিজেদের ত্রুটি যতদিন পর্যন্ত দূর করা না যাবে, ততদিন পর্যন্ত অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে ত্রুটিমুক্ত করা যাবে না।’ 

সাহিত্যিক স্বকৃত নোমান বলেন, ‘আমাদের এখানে একুশের চেতনার সঙ্গে বইমেলাকে একাত্ম করা হয়েছে বলে বইমেলা এলে মানুষ বই ও একুশের চেতনায় জেগে ওঠে। গ্রন্থমেলাকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে আরো আগেই। তবে বাংলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় ও তত্ত্বাবধানে বারোয়ারি ও বসন্ত মেলায় পর্যবসিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা আগামীতে অশনির খপ্পরে অতলে হারায় কিনা সেটাই ভয়।’

দিন শেষে কথা দাঁড়ায়- বাংলা একাডেমির দেখভালে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ ওপরতল থেকে দেখলে আহা, কী সুন্দর বলা যায়! ভেতরে নামলে এর হাজারো ক্রটি চোখে পড়ে। বাংলা একাডেমি জানে না এই মেলায় কী বই আসছে, কী বই যাচ্ছে; তারা জানে জমা পড়া বইয়ের নাম। তারা জানে কতটি স্টল, কতটুকু জায়গা। জানে না স্টলে কী আছে, জায়গার পরিবেশ কেমন। অথবা তারা তা জানে, মানসম্মত করতে চায় না। 

বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ে যে হাজারো ভুল, তা দেখায় দায়িত্ব নিশ্চয় বাংলা একাডেমির, যেহেতু তারা আয়োজক; অধিকাংশ প্রকাশকের যে প্রুফ রিডার নেই, এডিটিং প্যানেল নেই, প্রিভিউ কমিটি নেই- তা কে দেখবে? এই প্রকাশনীগুলো কী করে মেলায় স্টল পায়? 

বাংলা একাডেমির বইমেলার পরিবেশকে সাহিত্যের বিকাশে অস্বাস্থ্যকর বলা যায় এক বাক্যেই, বলা যায় অপরিকল্পিত। এখানে না আছে আর্কিটেকচারাল মান, না আছে মান যাচাইয়ের ভাবনা। 

সময় এসেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে আন্তর্জাতিক মানের করে উপস্থাপন করার। মানের দিকে খেয়ালহীন পথ চললে হাজার বছর হয়তো চলা যাবে, টিকে থাকা যাবে। তেলাপোকাও তো টিকে থাকে! দেশের জনগণের মননের বিকাশে বই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই বই যদি মানসম্মত না হয় তাহলে তা বারোয়ারি ও বসন্ত মেলায় পর্যবসিত হয়েই থাকবে। এর দায় আমাদের সকলের ওপরই বর্তায়। তাই সচেতন মহল থেকে এ আওয়াজ তোলা আজ সময়ের দাবি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh