প্রবীর বিকাশ সরকার
প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২০, ১০:১৯ এএম | আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২০, ১০:৩২ এএম
একসময় বাঙালির স্বতন্ত্র চিন্তা, সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাববনী শক্তি জার্মান এবং জাপানি জাতির চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। আমাকে একবার একজন জাপানি ভারততত্ত্ববিদ দুঃখ করে বলেছিলেন, ভিন্ন চিন্তার জন্য বাঙালি একসময় অগ্রবর্তী ছিল। তোমাদের মসলিন বস্ত্র, স্বর্ণালঙ্কারের সূক্ষ্ম নকশা, চৌচালা বাড়ি, ডাকবাংলো, কাপড়ে সুঁইসুতোর কারুকাজ, হারমোনিয়ম, বাঁশি, পাটের দড়ি, মাটির পুতুল, দুধের পেড়া, মিষ্টি, সমবায় সমিতি, রেডিও উদ্ভাবন, বৃক্ষের প্রাণ আবিষ্কার কিংবা আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ ইত্যাদি বিশ্বের বুকে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। তোমাদের সব হারিয়ে গেল ১৯৭২ সালের পর যেই স্বাধীনতা হস্তগত হল।
আমি তাঁকে বললাম, কী কারণে বাঙালির এই সুমহান ঐতিহ্য হারিয়ে গেল?
তিনি বললেন, স্বাধীনতার অপব্যবহার, স্থানীয় নেতৃত্বহীনতা, শিশুশিক্ষা ও প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমগুলো স্থিমিত হয়ে যাওয়া, অনর্থক ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়া এবং জাতিগত ঐক্যের অভাব। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে, লাগাতার শিশুদের প্রতি অবহেলা। সরকারি ও বেসরকারিভাবে শিশুদের চিন্তা ও প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর কোনো পরিকল্পরাই কোনো সরকার গ্রহণ করেনি। পরিশ্রম না করেই শিখরে পৌঁছানোর অমার্জিত খেয়ালিপনাকে উৎসাহিত করেছে রাজনীতি।
কী গভীরভাবেই না সেই অধ্যাপক বাঙালিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন অনেক বছর ধরে ভেবে বিস্মিত হয়েছিলাম! একটি কথাও তাঁর অতিরিক্ত বা মনগড়া ছিল না।
মাঝে মাঝে পানশালায় বিভিন্ন স্তরের জাপানি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গেলে স্বাভাবিক কারণেই বাঙালির সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং জাপানের সঙ্গে আবহমান সম্পর্কের কথা ওঠে। মতবিনিময় হয়। ২০০৫ সালের দিকে তেমনি একটি আড্ডায় শিশু প্রতিরক্ষক তাকারাদা তোকিও স্যার বাংলাদেশের শিশুশিক্ষা ও প্রতিভা বিকাশের প্রসঙ্গ তুললেন, জানতে চাইলেন কী অবস্থা এখন?
আমি বললাম, আশাপ্রদ কিছুই নেই। জাপানের মতো বাংলাদেশ শিশুস্বর্গ নয়। প্রতিভা বিকাশের কোনো মাধ্যম নেই। একসময় বেশকিছু শিশু সংগঠন ছিল সেগুলো এখন কর্মতৎপর নয়, প্রতিভা বিকাশের কোনো পরিকল্পনা বা প্রকল্পও নেই।
তিনি বললেন, তুমি কিছু করো! ইউনিক কিছু চিন্তা করো!
তাকারাদা স্যারের উৎসাহে আমার ভেতরে জেগে থাকা শিশুপত্রিকার চিন্তাটি আবার নড়ে চড়ে উঠল। আমার বাবার কথা মনে পড়ে গেল। বাবা মাঝে মাঝে আমাকে বলত, “থিঙ্ক ডিফরেন্ট! ভিন্ন চিন্তা করো! এটা গান্ধীর কথা তুমি কি জানো?”
এই মূলমন্ত্রটিই আমি জাপানে আসার পর আমেরিকার অ্যাপল কম্পিউটার ইঙ্ক কোম্পানির স্লোগান হিসেবে দেখেছিলাম। এবং দারুণ আলোড়িত হয়েছিলাম। ১৯৯৭-২০০২ সাল পর্যন্ত অ্যাপল কোম্পানির স্লোগান ছিল এই মন্ত্রটি।
আমি ভাবতে বসলাম শিশুপত্রিকা নিয়ে। শিশুপত্রিকার সংজ্ঞা কি? বাজারে যেসব পত্রিকা, সাময়িকী বা দৈনিকে যে শিশুদের জন্য লেখালেখির পাতা বরাদ্দ থাকে তাতে ৯৯.৯ ভাগ লেখাই লিখে বড়রা----এটাই কি শিশুপত্রিকা বা শিশুমাধ্যম? আমার মনে হতে লাগল, শিশুদের জন্য লেখা বই, ম্যাগাজিন, পত্রিকা প্রকাশ সঠিক শিশুপত্রিকা বা মাধ্যম অথবা শিশুসাহিত্য নয়। শিশুরা যা মনে করে লিখবে, আঁকবে শিশুদের কাগজে সেটাই শিশুপত্রিকা। শতভাগ শিশুদের চিন্তা, লেখা ও অঙ্কন নিয়ে যে কাগজ প্রকাশিত হবে সেটাই মাতৃভাষায় শিশুর প্রতিভা বিকাশের মাধ্যম। এমন একটি কাগজ আমি প্রকাশ করতে চাই।
যেই ভাবা সেই কাজ। প্রথমে স্ত্রীর সঙ্গে মতবিনিময় করলাম। সে রাজি। বলল, “খুব ভালো চিন্তা। একেবারে ইউনিক। প্রসিড অন। “ তাকারাদা স্যারকে পুরো পরিকল্পনাটি জাপানি ভাষায় লিখে হস্তান্তর করলাম। তিনি সেটা পড়ে অভিভূত হয়ে গেলেন! বললেন,“শতভাগ শিশুদের লেখা ও অঙ্কনচিত্র নিয়ে কি পত্রিকা প্রকাশ করা সম্ভব?”
আমি বললাম,“সম্ভব। এবং আমি এটা করে দেখাব।”
আমার স্ত্রী ও জাপানি বন্ধুরা খুব ভালো করে জানে, আমার উইল ফোর্স অত্যন্ত প্রবল। একবার ইচ্ছে হলে তার শেষ দেখাই আমার চ্যালেঞ্জ।
এর মধ্যে ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতায় গেলাম একটি বিশেষ কাজে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির আমন্ত্রণে। সেখানে অনুজপ্রতিম বন্ধু নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে বিখ্যাত একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। আমার চিন্তিত শিশুপত্রিকার পরিকল্পনা তার সামনে রাখলাম। তিনি পড়ে বললেন, “এ তো সাংঘাতিক কাণ্ড হবে! শতভাগ শিশুদের লেখা নিয়ে সংবাদপত্র প্রকাশ! তুমি কী পারবে? যদি পারো অসামান্য একটি উদাহরণ হবে। একটি শিক্ষাণীয় কাজ হবে।” তিনি আমাকে আশীর্বাদ করলেন। ভদ্রলোক আর কেউ নন, ‘আনন্দমেলা’কে যিনি ২৫ বছর ধরে সম্পাদনা করে আধুনিক আইকনে রূপান্তরিত করেছিলেন, স্বনামধন্য দেবাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়, আজ তিনি লোকান্তরিত।
২০০৭ সালে কুমিল্লায় গিয়ে তিনটি সংখ্যা পরীক্ষামূলক প্রকাশ করেছিলাম। শতভাগ লেখাই শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের। তাদের ছড়া, কবিতা, গল্প, অঙ্কন শুধু নয়, তাদের ভালোলাগা মন্দলাগা, বইয়ের আলোচনা, বিশিষ্টজনের সাক্ষাৎগ্রহণ, প্রিয় শিক্ষক; সংগঠনের সংবাদ, ফিচার লেখা এমনকি, প্রবন্ধ লেখা পর্যন্ত তারা লিখেছে “কিশোরচিত্র” ট্যাবলয়েড পত্রিকায় ১৬ পৃষ্ঠা ব্যাপী।
কিন্তু তিনটি প্রকাশের পরপরই একটি অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে। ফলে জাপানে ফিরে আসি। কয়েক বছর বিরত থাকি। তারপর ২০১০ সালের দিকে ইন্টারনেটে কিছুদিন প্রকাশ করি। পরের বছর তাকারাদা স্যারকে কেন্দ্র করে পুনরায় মাসিক হিসেবে ‘কিশোরচিত্র’ কুমিল্লায় প্রকাশিত হয় ২০১৩ পর্যন্ত। আরও সহযোগী ছিলেন শিমুরা তাকুইয়া, তাপস বড়ুয়া, মোঃ জসীম উদ্দিন এবং আমার স্ত্রী নোরিকো মিয়াজাওয়া।
বিশেষ করে যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই সে হলো আশরাফ হোসেন নামে একজন তরুণকে, যার অদম্য আগ্রহ আর কর্মতৎপরতা না থাকলে এই দূরূহ কাজটি আমি ফলপ্রসূ করতে পারতাম না। সে একাই সব অধিকাংশ লেখা ও অঙ্কন সংগ্রহ করত স্কুলে স্কুলে, ছাত্র-ছাত্রীদের বাসাবাড়িতে গিয়ে। প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা শুধু লেখা সংগ্রহের জন্যই বাজেট থাকত তাও ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে। অন্যান্য জায়গা থেকে ডাকে লেখা আসত।
পত্রিকাটিতে কয়েকটি বিষয়ে কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল, যেমন:
ক) ধর্ম নিয়ে কোনো লেখা
খ) অহেতুক ব্যক্তিসমালোচনা
গ) যৌনতাবিষয়ক লেখা বা অঙ্কনচিত্র
একাধিক নতুনত্ব ছিল। যেমন:
ক) পত্রিকার লেআউট জাতীয় পত্রিকার মতোই
খ) লেখকের সচিত্র পরিচিতি
গ) সাক্ষাতকারের আয়োজন
ঘ) যাদুঘরে নিয়ে গিয়ে প্রতিবেদেন লেখানো
ঙ) স্কুলে স্কুলে লেখা ও অঙ্কনচিত্র সংগ্রহের জন্য বাক্স স্থাপন
চ) প্রতি সংখ্যায় তিনটি ভালো লেখার জন্য সম্মানী প্রদান প্রাইজবন্ডের মাধ্যমে
পরিতাপের বিষয়, যে কোনো কারণেই হোক পত্রিকাটি বন্ধ করে দিয়ে জাপানে ফিরে আসতে বাধ্য হলাম ২০১৪ সালে। এরপর আর এরকম কাগজ কাউকেই প্রকাশ করতে দেখলাম না! এমনকি, যেসকল ছাত্রছাত্রী ‘কিশোরচিত্রে’ নিয়মিত লিখেছে তাদের কারো লেখা জাতীয় দৈনিক বা স্থানীয় পত্রপত্রিকায় আর দেখলাম না!
বাংলাদেশে শিশুপত্রিকার কী হাল তা নিয়ে বলার কিছু নেই। শিশুসাহিত্য ফোরাম হচ্ছে, শিশুদের নিয়ে সংগঠন হচ্ছে কিন্তু শিশু, কিশোর, কিশোরীদের নিজেদের চিন্তা ও লেখার মাধ্যমে তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা যেমন নেই, কোনো মাধ্যমও নেই। প্রশ্ন জাগে, এত এত শিশুসাহিত্যিক তাদের লেখা বা বই সত্যিই কি শিশুদের হাতে পৌঁছায়? আড়াই বছর পত্রিকা প্রকাশের সময় ঢাকা তো বটেই, অন্যান্য শহরে, গ্রামেগঞ্জে গিয়ে দেখেছি শিশুদের চিন্তার কী আকাল! রবীন্দ্র-নজরুল ছাড়া আর কোনো লেখকের নামও তারা জানে না! স্কুলে গ্রন্থাগার আছে, তাতে তালা লাগানো থাকে। স্বরচিত লেখাপাঠের আয়োজন নেই। স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিন কোথাও প্রকাশিত হয় না। দৈনিকের শিশুপাতাগুলো শিশুদের আকর্ষণ করে না। দেয়াল পত্রিকার ঐতিহ্য অনেক আগেই উঠে গেছে।
বাংলাদেশ একটি উদ্ভট দেশ, তার কোনো ভবিষ্যৎ শিশুপ্রকল্প নেই, জাতীয় শিশু সংবাদপত্র নেই, শিশু একাডেমী থেকেও নেই। তার মানে বাংলাদেশের কোনো স্বপ্ন নেই! এই যে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের তোড়জোড় চলছে তার সঙ্গে শিশুদের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি?
লেখাটি প্রবীর বিকাশ সরকারের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেয়া হয়েছে।