মাহমুদ সালেহীন খান
প্রকাশ: ২১ মে ২০২০, ১০:১২ এএম
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে এবং আল্লাহ রাসূল (সা.) তার বাণীতে অসংখ্যবার এ মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণনা করেছেন। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের এ মাসে মানুষের প্রতিদিনের অভ্যাস ও কার্যকলাপেরও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। পরিবর্তন আসে ইবাদত বন্দেগিতেও।
এসময়ে মানুষ যদি একটি সহজ কাজ তথা শুধুমাত্র জিহবাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাহলে অনায়াসেই অনেক বড় বড় পাপ থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
জিহ্বা অতি ছোট অথচ মানবদেহের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এটিকে সচল রাখার জন্য মহান আল্লাহ্ এক বিশেষ ব্যবস্থায় সবসময় আর্দ্র রাখেন। ওই ব্যবস্থা না থাকলে মানুষ জিহ্বাকে কোনো কাজেই লাগাতে পারত না। আর এই ছোট্ট অঙ্গদ্বারা অনেক বড় বড় পাপ কাজ হয়ে যায় যা আমরা চিন্তাও করি না।
রমজান মাসেই এই কাজগুলো না করার অভ্যাস গড়ে তোলা খুবই সম্ভব, আর এ অভ্যাস যদি বাকি এগারো মাস চালু রাখা যায় তবেই বড় বড় সেই পাপ চিরতরে দূরীভূত হয়ে যাবে।
একদিকে যেমন আমরা রোযা রাখি অপরদিকে নামায অনাদায়, গীবত, মিথ্যা, কামাচার, পাপাচার ইত্যাদির মতো জঘন্যতম অপরাধেও কেউ কেউ লিপ্ত হই। কিছু লোক আছে, যাদের রোজা শুধুমাত্র অনাহারে দিনযাপন বা উপোস থাকাই হয়। কিন্তু রাসূল (সা.) এ মাসে অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।
রাসূল (সা.) বলেছেন, কত সাওম পালনকারী রয়েছে যারা অনাহার ছাড়া আর কিছুই পায় না। (মুসনাদ আহমাদ)।
অন্যত্র তিনি বলেছেন,‘যে ব্যক্তি অশ্লীল কথা ও কাজ পরিত্যাগ করতে না পারে তার পানাহার থেকে বিরত থাকা আল্লাহর দরকার হবে না।’ (বুখারি)।
সাহাল ইবনে ইবনে সাআদ (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের দুই চোয়ালের মাঝের অঙ্গ এবং দুই রানের মাঝের অঙ্গ হেফাজত করবে আমি তার জান্নাতের জিম্মাদার।’ (বুখারি)
হাকিমুল উম্মত হযরত মাওলনা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) বলেন, ‘মানুষ ৩০ প্রকারেরও বেশি গোনাহ নিজের জবান দিয়ে করে থাকে। কত সময়ের অপচয় করে থাকে। চলার পথে কিংবা যানজটে নগরবাসীর অগণিত শ্রমঘণ্টা অবলিলায় ক্ষয়ে যায়। অথচ ইচ্ছা করলেই নষ্ট সময়গুলো মূল্যবান থেকে মহামূল্যবান করে তোলা যায়। শুধু জিহ্বা নেড়ে পরকালের সঞ্চয় বাড়ানো যায়।’
জিহ্বা দ্বারা যেসব গুনাহ হয়ে যায়:
পরনিন্দা করা: কোনো মানুষের অসাক্ষাতে তার দোষত্রুটি বলা, যা মানুষের নিকৃষ্টতম অভ্যাস। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘এবং গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান কর না, তোমাদের কেউ যেন পশ্চাতে নিন্দা না করে, কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ কর, বস্তুত তা ঘৃণাই করবে, সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু।’ (সুরা হুজরাত, আয়াত-১২)।
হাদিসে এসেছে, হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ এবং আবু সাইদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘পরনিন্দা যিনার চেয়েও নিকৃষ্ট।’(মেশকাত)
গীবত করা ও শোনা দুটিই সমান অপরাধ। জীবিত ও মৃত উভয় ধরনের মানুষের গীবত করা হারাম।
মিথ্যা অপবাদ দেয়া: যার মধ্যে যে দোষ-ত্রুটি নাই, তাই মিথ্যাভাবে অপরকে বলে বেড়ানো। এটা গীবতের চেয়েও জঘন্য কাজ। আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা সতী নারীকে অপবাদ দেয়, অতঃপর চারজন সাক্ষী উপস্থিত না করে, তাদেরকে ৮০টি বেত্রাঘাত কর, আর তাদের সাক্ষ্য কক্ষণো গ্রহণ কর না, এরাই না-ফরমান।’( আন নূর, আয়াত-৪)।
মিথ্যা কথা বলা: মিথ্যা সকল পাপের উৎস এবং সত্য মুক্তি দেয় আর মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা-প্রতারণা ও গুনাহের কাজ ত্যাগ করে না, আল্লাহ তা'আলার কাছে তার পানাহার থেকে বিরত থাকার কোনো মূল্য নেই।’ (আবু দাউদ)
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেন, ‘মুনাফিকের লক্ষণ তিনটি: কথায় কথায় মিথ্যা কথা বলে, ওয়াদা করলে ওয়াদা ভঙ্গ করে আর আমানতের খেয়ানত করে।’
ঝগড়া করা: বিশেষ করে ঝগড়ার সময় অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করা। কেউ কেউ মুনাফিকের চারটি লক্ষণের কথা বলেছেন- উপরের তিনটিসহ চতুর্থটি হলো- পরষ্পর ঝগড়া করলে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘মুসলমানকে গালাগালী করা কবিরাহ গুনাহ ও তার সাথে মারামারী করা কুফরি’।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণীত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘এমন দুটি স্বভাব মানুষের মধ্যে রয়েছে যা কুফরির অন্তর্ভূক্ত -১, কারো বংশ তুলে তিরষ্কার করা ২. মৃতের জন্য বিলাপ করে কান্নাকাটি করা।’ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে অন্য একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘রোজা ঢাল স্বরূপ, সুতরাং অশ্লীলতা করবে না ও মুর্খের মতো কাজ করবে না। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, তাকে গালি দেয়, তবে সে যেন দুইবার বলে, আমি রোজাদার।’(বুখারি)
হারাম খাবার খাওয়া: রমজানে অশ্লীলকাজ থেকে বিরত থাকা যেমন জরুরি, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া থেকে বিরত থাকাও জরুরি। ওজনে কম দেয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও অতীব জঘন্য কাজ, যা রোজা থেকে করলে রোজাকে ধ্বংস করে দেবে। আল্লাহ বলেন; ‘হে ইমানদারগণ, পরস্পরের সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে ছাড়া তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না’। (নিসা, আয়াত-২৯)
মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই গোশত (দেহ) জান্নাতে যাবে না, যা হারাম (খাবার) থেকে উৎপন্ন। জাহান্নামই এর উপযোগী।’ (ইবনে হিব্বান ও তিরমিজি)
সাক্ষাতে মানুষকে অপমান করা: অনেকে এমন আছেন যে, সামান্য ভুল-ত্রুটি পেলেই মানুষকে অপমান করেন এবং দম্ভ করে বলেন আমি তো তোমার পেছনে বলছি না। এ ব্যাপারে আল কুরআনের বাণী; ‘প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর দুর্ভোগ’ (সূরা হুমাঝাহ্, আয়াত-১)
মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া: রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা কি বলতে পারো কোনগুলো সব গুনাহের বড় গুনাহ। সাহাবীরা বলেন, আল্লাহর রাসূলই ভাল জানেন। রাসূল বলেন; সেগুলো হলো- ক. আল্লাহ্র সাথে শরীক করা, খ. পিতা মাতার অবাধ্য হওয়া, গ. মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।
অত্যাধিক খাওয়া: হালাল খাবার হলেও তা পরিমিত না খেয়ে অত্যাধিক খাওয়া ইসলামী শিষ্টাচারবিরোধী। রমজান মাসে ইফতারি ও সাহরিতে অধিক পরিমাণে খাবার গ্রহণ ও নষ্ট করা মুসলমানদের একটি সাধারণ অভ্যাস তথাকথিত আভিজাত্যে পরিণত হয়েছে, যা অপব্যবহার বা অপচয়েরই নামান্তর। অথচ কুরআনে অপচয় করা শয়তানী স্বভাবের কথা বলা হয়েছে । আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই অপচয়কারী শয়তানের ভাই’। (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-২৭)
রাসূল (সা:) বলেছেন, ‘সে পরিপূর্ণ মুমিন নয়, যে পেট পুরে আহার করে আর তার প্রতিবেশী অভুক্ত অবস্থায় থাকে’। (মেশকাত ও আদাবুল মুফরাদাত)
অহেতুক কথাবার্তা বলা: রমজানে রোজা রেখে অশালীন কথা বলা, গালি দেয়া নিষেধ। তাই রোজা রেখে এ ধরনের কাজে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন রোজা রাখে তখন সে যেন অশালীন কথাবার্তা না বলে ও হৈচৈ না করে।’ (বুখারি)