আমার লেখালেখির অনুপ্রেরণা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান

মাহমুদ সালেহীন খান

প্রকাশ: ২৪ মে ২০২০, ০৬:১৬ পিএম | আপডেট: ২৪ মে ২০২০, ০৭:৫৭ পিএম

মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। ছবি: সংগৃহীত

মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। ছবি: সংগৃহীত

দেখতে দেখতে চারটি রমজান পেরিয়ে গেল। ঠিক চার বছর আগে আমার নানা মাসিক মদীনার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান এ দেশের ইসলামি সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং রাজনীতির এক কিংবদন্তী। যিনি শুধু একজন ব্যক্তির পরিচয় বহন করেন না, বরং মুহিউদ্দীন খান নামটির সাথে জড়িয়ে আছে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বাংলাদেশের মুুসলমানদের ইতিহাস ঐতিহ্যের একটি প্রতিষ্ঠান। কিছু মানুষ শতাব্দীতে একবারই জন্ম নেন, আলো দেখান পুরো জাতিকে; তেমনই একটি নাম মাওলানা মুহিউদ্দীন খান।

মুসলিম জাতির অন্যতম কাণ্ডারি হিসেবে তাঁর প্রধান অস্ত্র ছিল কলম। তিনি তাঁর কলম দিয়ে শুধু বাংলাদেশের মুসলমানদের সংকটই তুলে ধরেননি, বরং পুরো মুসলিম বিশ্বের মুসলমানদের অধিকার আদায়ে তাঁর কলম যুদ্ধ করেছে। এই নিরলস কাজটি তিনি করেছেন লেখালেখি আর অর্ধশতাব্দী কাল থেকে তাঁর সম্পাদিত মাসিক মদীনা পত্রিকার মাধ্যমে। আজকে বাংলাদেশের যতগুলো ইসলামি পত্রিকা পাঠকদের হাতে আছে, এমনকি প্রতিটি দৈনিকে যে ইসলামি পাতা আছে তা মাসিক মদীনা তথা মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের কলমের উত্তরাধিকার। শুধু তাই নয় ইসলামি সাহিত্য প্রকাশে মদীনা প্রকাশনীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। মাসিক মদীনার মাধ্যমে তিনি অসংখ্য লেখক তৈরি করেছেন। যারা আজকে মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের মুখ উজ্জ্বল করছেন তাঁর কলম সৈনিক হিসেবে। বাংলাদেশের সীরাত গবেষণা ও চর্চার অন্যতম দিকপাল তিনি। তাঁর হাত ধরেই এ দেশে সীরাত গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। 

মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সাথে আমার সম্পর্ক নানা-নাতি। আমি তাঁর বড় মেয়ের বড় সন্তান। নাতি-নাতনীদের মধ্যে আমি সবার বড়। সেই সুবাদে শৈশব থেকে আমি তার আদর পেয়েছি অনেক। মায়ের কাছ থেকে শুনেছি আমার জন্মের পর আমার নানা মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহর দিকে আহ্বানের আযানের ধ্বনি আমার কানে দিয়েছিলেন। ছোট থেকেই আমি অসুস্থ ছিলাম। নানার কারণেই আমি আজ দুই পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পারছি। এই মহান ব্যক্তির কাছে আমি চিরঋণী। অথচ প্রতিদান হিসেবে তাঁকে কিছুই দিতে পারিনি। আমাদের পুরো পরিবার নানার মৃত্যুতে অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়েছে। আমার লেখালেখির অভ্যাস তৈরি হয়েছে ছাত্রজীবন থেকেই। সমকালীন বিষয়ের উপর একটি নিবন্ধ লিখে বাংলাবাজার গিয়েছিলাম নানাকে দেখাতে। লেখাটি পড়ে উনি তখনই সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানে ছাপানোর নির্দেশ দেন। তারপর থেকেই নিয়মিত সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানে সমকালীন বিষয়ে আমার লেখা প্রবন্ধ ছাপা হতো। প্রায়ই  বাংলা বাজার মদীনা ভবনে গিয়ে নানার কাছ থেকে তাঁর প্রকাশনীর বিভিন্ন বই নিয়ে আসতাম। এই মহান ব্যক্তির বই পড়তে পড়তে ইসলামিক বিষয়ে লেখার অভ্যাস তৈরি হয়।পরবর্তীতে দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক নয়া দিগন্ত, দৈনিক আমার দেশ এ ইসলামী পাতায় আমার লেখা নিয়মিত ছাপা হতে থাকে। এর পেছনে যে ব্যক্তিটির অদৃশ্য দোয়া ছিল, তিনি হলেন আমার নানা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। 

আমার মা আমাকে সব সময় বলতেন আমার স্বভাব চরিত্র, দেহের গঠন এবং গুণাবলী নাকি নানার মতো। শৈশব থেকেই আমার লেখার অভ্যাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে অন্য কোনো কর্মক্ষেত্র আমাকে কখনই টানেনি। আমার এসব কিছু নাকি আমি নানার কাছ থেকে পেয়েছি। ছাত্রজীবনে যখন বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে যাতায়াত করতাম তখন নানার পরিচয় দেয়ার সাথে সাথে সে সব পত্রিকার সম্পাদক, সাহিত্য সম্পাদক আমাকে তাদের কামরায় ডাকতেন, আমার লেখা পড়তেন, ছাপাতে নির্দেশ দিতেন। খুব মনে আছে- দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন কবি আাল মুজাহিদী। আমি একটি প্রবন্ধ নিয়ে তার কাছে গিয়ে নানার পরিচয় দেয়ার পরই তিনি উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। ইনকিলাবের ফিচার সম্পাদক ভাষা সৈনিক আব্দুল গফুর সাহেবের সাথেও আমার সম্পর্ক নানাকে কেন্দ্র করে। নয়া দিগন্তের সহকারী সম্পাদক মাসুদ মজুমদার, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগের অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান প্রমুখ ব্যক্তিরা আমাকে এখনো স্নেহ করেন, সম্মান করেন; আমার নানা মরহুম মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সম্মানে। এসব বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহ উদ্দীপনায় লেখালেখির প্রতি আমার দিনদিন আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। এখনো দেখা হলেই তারা আমাকে বলেন, “নাতী তোমার নানার নাম রাখতে হবে কিন্তু। লেখালেখিটা ছেড়ো না।” নানার রাজনৈতিক সভা সমাবেশে আমার খুব একটা অংশগ্রহণ করা হয়ে উঠেনি। কিন্তু উনার সাহিত্যকর্মের সাথে আমার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। নানাকে যখনই কাছ থেকে দেখেছি, তখন হয়তো বই পড়তেন, নয়তো লিখতেন কিংবা পত্রিকা পড়তেন। জীবনের শেষ বছরগুলোতেও অসুস্থ থাকা অবস্থায় বাসার দুইতলার কক্ষটাতে তার এই অভ্যাসের ব্যতিক্রম আমি দেখিনি।

কোন এক রাজনৈতিক কারণে নানা আমাদের বাসায় কিছুদিন ছিলেন। তখন খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি। তাঁর জীবনের উত্থান-পতনের অনেক গল্প শুনেছি। আমার অনেক লেখা সেই সময়ে নানাকে পড়তে দিয়েছিলাম। তখন আমার লেখার মান, বিষয়বস্তু নির্বাচন, ভাষার ব্যবহার ও বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন; যা আজও আমার কাছে পাথেয় হিসেবে থাকছে। নানার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য আমি লক্ষ্য করেছি যেটা, তা হলো ইসলামি সাহিত্যে বাংলা ভাষাকে সাবলীলভাবে তিনি উপস্থাপন করতে সক্ষম ছিলেন।

আমার সাংবাদিকতা ও লেখক জীবনের একটি আফসোস থেকে যাবে। “বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতি ও পর্যালোচনা” শিরোনামে একটি গবেষণা গ্রন্থের পান্ডুলিপি তৈরি করেছি। পান্ডুলিপি পড়ে নানা আমাকে বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন, ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়েছেন। আমি আবদার করেছিলাম, একটি ভূমিকা লিখে দেয়ার জন্যে এবং খুব ইচ্ছে ছিলো বই প্রকাশের পর নানার হাত দিয়েই বইটির প্রকাশনা উৎসব করার। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি তখন ভূমিকাটি লিখতে পারেননি। বলেছিলেন, সুস্থ হবার পর লিখে দিবেন এবং বইটি ‘মদীনা পাবলিকেশান্স’ থেকে প্রকাশ করবেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আমার সৌভাগ্য হলো না ইসলামের কিংবদন্তীর স্বাক্ষরে গ্রন্থটির জন্য ভূমিকা পাওয়ার। আমার গ্রন্থটি নানার হাতের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হলো এবং আমার ভেতর একটি দীর্ঘশ্বাস থেকে গেল না পাওয়ার।

নানার অসুস্থ অসুস্থ অবস্থাতেও একদিন আমার কর্মজীবন নিয়ে কথা হচ্ছিল। তখন খুবই হতাশাগ্রস্থ ছিলাম। প্রকাশনী করছি সেটাও উনি শুনেছেন। আমার হতাশজনক কথা শুনে বলেছিলেন, “হতাশ হবার কিছু নেই, প্রাথমিক অবস্থায় আমার জীবনও অনেক কষ্টে কেটেছে। আল্লাহকে ডাকো। তাঁর উপর ভরসা করো এবং পরিশ্রম করো, সফলতা আসবেই।” এরপর দেখা হলে তিনি আমার লেখা, প্রকাশনীর খোঁজখবর নিতেন। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানকে দেখেই হাতে কলম উঠিয়েছিলাম ছাত্রজীবনে। একজন মুহিউদ্দীন খান যেভাবে কলম দিয়ে কোটি মানুষের ভালবাসা পেলেন, কোটি মানুষকে অশ্রুসিক্ত করলেন, উত্তরাধিকার হিসেবে সেই কলম ধরে রাখার দায়িত্ব এখন আমাদের।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh