কোন পথে বিশ্বায়নের অর্থনীতি?

শাহ্জাহান সরকার

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২০, ০৬:২১ পিএম

করোনাভাইরাস-পরবর্তীকালে পুঁজিবাদী উন্নয়ন-বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাব পৃথিবীতে অর্থনৈতিক সংকট ডেকে আনবে বলে আশঙ্কা করছেন সমাজগবেষক ও অর্থনীতিবিদরা। এটা কেবল আশঙ্কার বিষয় নয় বরং একচেটিয়া মুমূর্ষু পুঁজিবাদের যুগে একে বস্তুর অনিবার্য নিয়তি বলা যায়। কারণ এটা আজ কোনো নতুন সমস্যা নয়, বরং পুরনো। একচেটিয়া পুঁজির শুরুতেই এটা পুঁজিবাদের ললাটের লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখান থেকে বের হওয়ার পথ ‘পুঁজিবাদী উন্নয়ন-বিশ্বায়নে’র হাতে কী আছে? এখন শুধু ভবিষ্যতের অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের করার কী আছে। রুশ বিপ্লবের নেতা লেনিন একশত বছর আগেই বলেছেন, একচেটিয়া পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ বিকাশ হিসেবে পণ্য-পুঁজির জায়গায় যখন অর্থ-পুঁজি কর্তৃত্বকারী হয়ে ওঠে, তখন সে-পুঁজি জাতীয় স্বার্থের বাইরে আন্তর্জাতিক বাজার লুণ্ঠনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এভাবে মুনাফা অর্জন ও পুঁজিবাদের সংকট ঠেকাতে অপর দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে এবং তারই পরিণতি হিসেবে অতীতে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়েছে। 

মূলত উন্নত বিশ্বের শাসকরা নিজ দেশের জনগণসহ অপর রাষ্ট্র শোষণ, দখল-কর্তৃত্ব করার নিমিত্তে পুরাতন ঔপনিবেশিকতার পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদে আবির্ভূত হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ অপর রাষ্ট্র সসৈন্যে যেমন দখল করে থাকে, তেমনি দখল ছাড়াও অপর রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ওপর কর্তৃত্ব বজায় রেখে নয়া উপনিবেশে পরিণত করে। এভাবে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ তার পতন ঠেকাতে বিশ্বায়ন-উন্নয়ন অর্থনীতির নামে নয়া-উপনিবেশবাদ সৃষ্টিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। আর আমাদের মতো দেশের জনগণকে, নয়া উপনিবেশবাদের উন্নয়নের ঢেঁকি গেলানোর চেষ্টা করা হয়। অন্যদিকে বিভিন্ন রাষ্ট্র-সরকারের মন্ত্রী-আমলা ও ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরা একে ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশ্বায়ন বা গ্লোবাল ভিলেজ’ প্রভৃতি শব্দগুচ্ছের ইঞ্জিনিয়ারিং দ্বারা মৃতবৎ ‘সাম্রাজ্যবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদের’ করুণদশা ঢেকে রাখার চেষ্টা করে থাকে। 

তাই একশ’ বছরের অধিককাল ধরে এই পুঁজিবাদী উন্নয়ন-অর্থনীতির নামে আমাদের মতো এশিয়ার দেশসহ আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার পশ্চাদপদ দেশগুলোর শাসক শ্রেণি প্রভাবিত হয়েছে। আর ‘উন্নয়ন অর্থনীতির’ সোনার হরিণ পাওয়ার আশায় উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর বিনিয়োগকারীদের পেছনে ছুটছে। এমনকি বিনিয়োগকারী দেশগুলোও সে ফাঁদ পেতে বসে থেকেছে। শুধু তাই নয়, পশ্চাদপদ দেশগুলোকে উন্নয়নের বটিকা গলধঃকরণ করতে বাধ্য করেছে। এসব দেশের স্বাধীন অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি বিকাশে বাধা দিয়েছে, তাকে অধস্থিত করে আত্তীকরণ করেছে। বিশ্বায়নের নামে পুরাতন উপনিবেশের বদলে নয়া উপনিবেশ সৃষ্টি করতে যুদ্ধ-বিগ্রহ বাঁধিয়ে এসেছে এবং এ পন্থায় নয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে। 

আমাদের মতো দেশে এই অন্ধানুকরণের উন্নয়ন তরিকা যে আলোর বিকীরণ ফুটিয়ে তুলেছে, তাতে তুষ্ট হবার চাইতে অসন্তুষ্টি বেশি জেগে উঠছে। গ্রামের রাস্তাঘাট পাকা ও প্রশস্তকরণ, বৈদ্যুতিক আলোর সংযোগ বৃদ্ধিসহ আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ ঘটলেও, গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহর বা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে এক মুঠো ভাতের আশায়, কাজের আশায়। করোনা মহামারিতে তারা আরো বেশি বেকার হবে। ‘উন্নয়নের’ পরশমনি এখন তাদের জীবনে মরণকাঠি হয়ে পড়ছে। 

এভাবে পুঁজিবাদী উন্নয়ন বাস্তবে তাদের হা-ভাতে করেছে, গৃহহারা করেছে, বেকার করেছে, উন্নয়নের লটবহর টানতে পাথর ভাঙার মতো রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার কাজে যুক্ত করেছে এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রযুক্তি মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বন্দিদশায় ফেলেছে। রাত-দিন পরিশ্রম করে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা বা পোশাকশিল্পে ১২-১৪ ঘণ্টা কায়িক শ্রম দিয়ে কষ্টকর কাজে যুক্ত থাকছে।

আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপ-এশিয়ার সব সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র ও চীনের একচেটিয়া পুঁজিবাদ এক চরম সংকটে পড়েছে। তা থেকে উত্তরণের জন্য তারা আজ মরিয়া হয়ে উঠছে। জৈব রাসায়নিক গবেষণারের অমার্জিত চর্চা সে কাজেরই অংশ, যা দিয়ে তারা কৃত্রিম খাদ্য ও যুদ্ধের মারণাস্ত্র তৈরিতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। এমনকি জনগণের ক্ষোভ ও উত্তাল পরিস্থিতিকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য করোনা-পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীরাই করোনাভাইরাসকে এখন গ্যাস্ট্রো-করোনার নামে উস্কে দিচ্ছে। 

বিশ্ব-অর্থনীতি ও রাজনীতির উপরোক্ত পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস-পরিস্থিতি কী ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলছে এবং ফেলবে তার হিসাব-নিকাশ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। পুঁজিবাদ তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলার অবস্থায় পৌঁছেছে। তার ক্রনিক-সংকট তাকে এখন বেকায়দায় ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এটা সুবিধাভোগী-শাসক শ্রেণির কাছে কতটা যে নীরব আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, তা বলা বাহুল্য।

যার ফলে, উপরোক্ত পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস প্রাণঘাতী ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করলেও বিশ্বব্যাপী শাসক শ্রেণি এটা দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের গভীর ক্ষত-পুঁজিবাদী সংকট, শ্রেণি-বৈষম্য ও বেকারত্বকে আড়াল করার ঢালে পরিণত করেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, করোনাভাইরাস উৎপত্তির পথ খোলা রেখেই তারা ওষুধ আবিষ্কারের পেছনে ছুটে চলেছে। এমনকি বর্তমান পরিস্থিতিকে আরো প্রলম্বিত করার যড়যন্ত্র যে হচ্ছে না, তা বোঝার উপায়ও নেই। ফলে করোনার টিকা নিয়ে চীন-জার্মানির মধ্যে দরকষাকষি চলছে। চীনের একটি সংস্থা জার্মানির একটি সংস্থাকে ১৩ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের বিনিময়ে ভ্যাকসিনের মালিকানার অংশীদারি কেনার প্রস্তাব দিয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অপরদিকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি জার্মানির একটি সংস্থাকে ‘ঘুষ’ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। 

উপরোক্ত ভ্যাকসিনের মালিকানার অংশীদারিত্ব কেনার চীন-মার্কিনসহ অন্যান্য ধনী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা প্রমাণ করে যে, করোনা-পরিস্থিতিতে একচেটিয়া পুঁজির বাজার কতখানি নির্লজ্জ হয়ে উঠেছে। এ অবস্থা গ্লোবাল ভিলেজ মতাদর্শকে অসাড় প্রতিপন্ন করে তুলেছে। 

সঙ্গত কারণে তাই কিছু প্রশ্ন উঠতে পারে যে, মৃতপ্রায় বিশ্বায়নের অর্থনীতির বর্ম আজ আরো মূর্তভাবে, আরো গভীরভাবে ভাঙনের মুখে পতিত কী? করোনাভাইরাস কি এ সংকটকে আরো ত্বরান্বিত করছে, না-কি এ-সংকটের অজুহাতে বিশ্বায়নের ভাঙন ঠেকাতে বিকল্প প্রচেষ্টা চলছে? আবার এটাও কি হতে পারে না যে, ধনী রাষ্ট্রগুলোর বিশ্ববাজার দখলের একটা নতুন মেরুকরণ ও শীতল যুদ্ধের নীরব প্রস্তুতি চলছে? সম্ভবত কোনো সম্ভাবনাকেই আজ আর খাটো করে দেখা সম্ভব হচ্ছে না। তাই তথাকথিত বিশ্বায়নের একচেটিয়া অর্থনীতির খোলনলচে পাল্টে ফেলে পৃথিবীর মানুষ করোনাভাইরাসসহ যাবতীয় মহামারিকে সৃজনশীলভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হোক- এমন দাবি করাটাই বর্তমান সময়ে যৌক্তিক বলে মনে হয়।


শাহ্জাহান সরকার, কলামিস্ট

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh