ব্যাধি মুক্তির সন্ধানে

আসিফ

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২০, ০৪:৩২ পিএম

করোনার কথা উঠলেই নানা প্রসঙ্গ সামনে এসে হাজির হচ্ছে। যেমন ২০০২ সালের একটি ঘটনা: পৃথিবীতে সার্সভাইরাসের আক্রমণ ঘটেছিল। এই ঘটনা ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করলেও তা পৃথিবীব্যাপী এভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। তবে পৃথিবীর মানুষ সঠিক অর্থে জীববিজ্ঞান গ্রহণ করলে বর্তমান এই বিপদের আভাস আগে থেকেই কিছুটা বুঝতে পারতো। 

বিজ্ঞান বিশেষত জীববিজ্ঞান মতে- মানুষ প্রকৃতির অংশ। ফলে বিজ্ঞান জানলে বোঝা সহজ হয় প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকাটা কেন প্রয়োজন। বিজ্ঞান পথ দেখাতে পারে, মানুষ পরস্পরের সঙ্গে সহনশীল সম্পর্ক রেখে কীভাবে বসবাস করবে। কেননা বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারে, কীভাবে বৃক্ষ-উদ্ভিদ, নদী-নালা গড়ে উঠেছিল। এর ওপর নির্ভর করে কীভাবে মানুষ ও স্তন্যপায়ী জীবদের টিকে থাকার পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। প্রকৃতি একটা নির্দিষ্ট পরিমান চাপ সহ্য করতে পারে, কিন্তু তার বেশি হলে সে ভেঙে পড়ে। বিশৃঙ্খলা করলে প্রকৃতিতে অনেক ধরনের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া জেগে উঠতে পারে, যা আমাদের মতো প্রাণপ্রকৃতির বহু ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

করোনাভাইরাস এমন একটি বিপদ। যদি আমরা আরও একটু অগ্রসর হই এবং কার্লোস লিনিয়াস, চার্লস ডারউইন, জোহান্স গ্রেগরি মেন্ডেলের পথ ধরে হাঁটি, তাহলে বুঝতে পারব করোনাভাইরাসের গতি প্রকৃতি। কার্লোস লিনিয়াসের ট্যাক্সোনোমি বা নামকরণবিদ্যার পথ ধরেই আমরা বুঝতে পারি- বৈশিষ্ট্য অনুসারে ভাইরাসটির বিজ্ঞানভিত্তিক কী নাম হওয়া উচিত এবং অন্যান্য ভাইরাসের সঙ্গে তার পার্থক্য কী। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বানুসারে আমরা বুঝতে পারি- পৃথিবীতে এত বিপুল বৈচিত্র্যের কারণ, প্রাণিজগতের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক, কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয় করে চলতে হবে, তার ব্যত্যয় হলে কী ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে। জোহান গ্রেগরি মেন্ডেলের বংশগতির পথ ধরে আমরা বুঝতে পারি সেই ভেঙে পড়া পরিস্থিতি কেমন হতে পারে, পরিবর্তন বা মিউটিশনের কতসব অভিনব ধারা থাকতে পারে। তাদের দুটো গঠনে বর্তমানে আমাদের মধ্যে রয়েছে : সার্স-কভ, সার্স-কভ-২, এই নামগুলো দেখলেই আমরা বুঝতে পারি সার্স ও মার্সের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে।

ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার মতো কোষীয় বা জীবিত কিছু নয়, এমন কি মৃত কিছুও নয় বরং জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি কিছু একটা বস্তু। তবে এর মধ্যে জেনেটিক তথ্য সংবলিত ছোট্ট একটি ধারক রয়েছে, যা দিয়ে অন্য প্রাণীর কোষে অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করতে পারে। এটা ঘটে ভাইরাসটি যখন তার প্রকৃতির স্বাভাবিক আধার (কোনো প্রাণ) থেকে মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণে স্থানান্তরিত হয়, তখনই ওই দেহে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং নিজের প্রতিরূপ করতে থাকে। মানুষ বা অন্য প্রাণির দেহে স্থানান্তরিত হওয়ার সময়কে স্পিলওভার বলে। তাহলে দাঁড়াচ্ছে, বাস্তুস্থানচ্যুত বা ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স নষ্ট করলেই এটি আমাদের মধ্যে তা উপস্থিত হতে পারে। তবে আরও একটি উপায়ের সম্ভাবনা রয়েছে। কৃত্রিম উপায়ে জীবাণুঅস্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমেও হতে পারে। পৃথিবীতে মানুষের বিকাশের যে নির্মম ও হিংসাত্মক ইতিহাস আছে তাতে এ ধরনের ঘটনা অসম্ভব নয়।

কোনো ভাইরাস যদি ডাবল স্ট্রান্ড ডিএনএ গঠনের জিনোম বহন করে, যা ভুল করে প্রতিরূপ তৈরিতে কম পরিবর্তন ঘটায়; তাই দ্রুত বিকশিত হয় না; কিন্তু সিঙ্গেল স্ট্রান্ড আরএনএ (রাইবো নিউক্লিক এসিড) গঠনের আরেক ধরনের ভাইরাস রয়েছে; তারা ভুল করে বেশি, বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনশীল কপি বা বংশধর তৈরি করে। করোনা হলো এরকম একটি ভাইরাস। একটি আঁধারের অভ্যন্তরে পরিবর্তনশীল পৃথক পৃথক এ ভাইরাস গোষ্ঠী ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় একে অন্যের সংগে প্রতিযোগিতা করছে; দক্ষতা বৃদ্ধি করছে। মানবপ্রজাতিকে বিপন্ন করে তুলেছে।

এটা সত্য যে, দুর্যোগটা পৃথিবীর নয়, মানুষের। পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছি, অনবরত দখল করার চেষ্টা করেছি। করোনা প্রত্যেকটা পদক্ষেপে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, শুধু রাষ্ট্রগুলোকে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য বাসিন্দার (গাছাপালা, বণ্যপ্রাণী, কীটপতঙ্গ) সঙ্গে সমন্বয় করে চলতে হবে। জীববিজ্ঞানের বিবর্তনীয় সূত্রগুলোকে পরিত্যাগ করে নয়, মাথায় নিয়ে প্রকৃতিকে বুঝতে হবে।

আর ভাইরাসের বিরুদ্ধে জয়লাভ করার কিছু নেই, তাকে সমন্বয় করে চলতে হয়। মাথায় রাখতে হবে এই ভাইরাস আমাদের আক্রমণ করেনি, বরং প্রকৃতিকে দূষণ বা আমাদের কিছু কর্মকাণ্ডে অথবা গোপন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগত জীবনাচারণ বা সামাজিক জীবনযাপনে আর প্রকৃতির সঙ্গে সহনীয় অবস্থান গড়ে তুলতে পারিনি। নাগরিক জীবনে খেলার মাঠতো দূরের কথা, একটা চড়ুই পাখিকে বসতে দিতেও আমাদের মানসিকতা বাধা দিয়েছে। অথচ সামান্য ক’দিনে মানুষের হস্তক্ষেপ না-হওয়ার কারণে প্রকৃতি কতো সরব হয়ে উঠেছে : হিমছরিতে হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে, দিনাজপুরে উটপাখি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, কক্সবাজারে সমুদ্রসৈকতে ডলফিনরা চলে এসেছে, সবুজ পাতাগুলোতে সূর্যের আলো কেমন ঠিকরে পড়ছে, পচে-গলে কালো হয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গার পানিতে আকাশ দেখা যাচ্ছে, যে আকাশ সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে মানবপ্রজাতিকে ডাকছে- কত আনন্দের কথা, কত অল্পতেই সব ঠিক হয়ে যেতে পারে। অতএব, করোনা বিপর্যয় থেকে আমরা নিশ্চয়ই বের হয়ে আসব। তবে নিজেদের সম্পর্কে ধারণাগুলো পরিষ্কার করতে জীববিজ্ঞানের সূত্রগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে জীবনাচারণ ঠিক না করতে পারলে সামনে আরও বিপদ অপেক্ষা করছে।

উল্লেখ্য ইংল্যান্ডে প্লেগ রোগ দেখা দিলে ১৬৬৫ সালের মধ্যভাগে মহামারি আকারে বিস্তার লাভ করে। ফলে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। এই মহামারিতে ইংল্যান্ডে ১০ শতাংশ লোক মারা যায়। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ায় নিউটন নিজ গ্রাম উইলসথর্পে ফিরে আসেন। ১৮ মাসের অবসরে নিজের গ্রামের বাড়িতে তৈরি হয় তার সমস্ত আবিষ্কারের ভিত্তি। মহাকর্ষ ও গতির সূত্র আবিষ্কার ছাড়াও ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস ও ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাসের জন্ম হয়েছিল, যা গাণিতিক নিয়মে প্রকৃতির বিষয় অনুসন্ধানের পথ খুলে দিয়েছিল।

একই রকম কাজ সবকালে, সব পরিস্থিতে হতে হবে এমন কোনো কথা নেই; তবে বিশ্বের প্রায় ১১৫টি দেশে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জাতীয় কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, ফলে প্রায় ১২০ কোটি শিক্ষার্থী একরকম বেকার হয়ে পড়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিলেবাস শেষ না হওয়ার ভয় তাদেরকে নানা কারণে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, সে-ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য অনেকেই অনলাইনের সুবাদে বর্তমান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন বোর্ডের বইয়ের গাদা গাদা পড়া শিক্ষার্থীদের গেলাতে চাইছে। আর শিক্ষার্থীরা চোখের সামনে ঘটে চলা মৃত্যু, ক্ষুধা আতঙ্ককে নির্লিপ্তভাবে পাশ কাটিয়ে খেলে আর উগরালেও এর একটা দারুণ দিক সম্ভবত রয়েছে। তাহলো অনলাইনের স্মার্টফোন বা হাইটেক প্রযুক্তি যে প্রাযুক্তিক বয়সন্ধিকাল বা আত্মধ্বংসের পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তা যেন হঠাৎ করে টিকে থাকার অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পণ্য কেনা, পড়ালেখাসহ কী কাজে এর ব্যবহার হচ্ছে না; করোনাভাইরাসের সংকটের কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যখন কোনো প্রযুক্তি বা ডিভাইস বা মেশিন টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ারে রূপ নেয়, তখন আত্মধ্বংসের প্রবণতা কিছু মাত্রায় কমে গিয়ে জোরালো ভূমিকা হয়তো নেবে। 

এ ছাড়াও ভাবুন দেখি ছোট্ট একটা ভাইরাস, চোখে দেখা যায় না। কীভাবে পৃথিবীটাকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দিলো! পরে জানা গেল ২০০২ সালে প্রাদুর্ভাব হওয়া সার্সভাইরাসের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক আছে বা এটি তার বিবর্তিত রূপ। তাহলে পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পারল না কেন? আমরাতো জানতাম সেইসব জীববিজ্ঞানীকে এবং তাদের দেখানো পথগুলোকে। ক্ষমতায় থাকা নেতৃত্ব আরেকটি দেশের পরিস্থিতি দেখে শোধরালো না কেন? কারণ পুঁজি, মুনাফা, ক্ষমতার লোভ আর শ্রেষ্ঠত্বের দম্ভ; অশুভ এবং অপরিপক্ব মস্তিষ্কধারী ব্যক্তিদের ক্ষমতার শীর্ষ বা কেন্দ্রে আরোহন অথবা শীর্ষ বা কেন্দ্রবিন্দু বলে কিছু থাকার মতো অনেক ধরনের ব্যাধি।

আহ, এভাবে যদি চিন্তা করা সম্ভব হয় যে, পৃথিবীর এই সব শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বেরিয়ে আসবে, বেরিয়ে আসবে সেই সব মানুষ, যারা দেখাবে এক ব্যাধিমুক্ত পৃথিবীর পথ।


আসিফ, বিজ্ঞান লেখক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh