আমীন আল রশীদ
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২০, ১০:১২ এএম | আপডেট: ০৭ আগস্ট ২০২০, ১০:৩৭ এএম
করোনাভাইরাসের কারণে চাকরি হারিয়ে বা কর্মহীন হয়ে অনেকেই ঢাকা ছেড়েছেন। অনেকে পেশা বদলে ফেলেছেন। অনেকে বেকারত্বের ঘানি টানছেন। বিশেষ করে বেসরকারি চাকরিজীবীরা।
কিন্তু এ রকম ভয়াবহ সংকটের ভেতরেও একটি খাত বেশ লাভবান হয়েছে, সেটি হলো অনলাইন ব্যবসা। করোনাকালে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর যখন সবকিছু প্রায় বন্ধ হয়ে গেল, মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রিত, কোথাও কোথাও লকডাউন হলো, তখন মানুষের কাছে অতি প্রয়োজনীয় সেবা হিসেবে আবির্ভূত হয় নিত্যপণ্যের বিভিন্ন অনলাইন সাইট। সেই ধারাবাহিকতায় এবার অনলাইনে কোরবানির পশুর হাটও অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে।
সমস্যা হলো, অনলাইনে কেনাকাটা করার অভিজ্ঞতা সবার ভালো নয়। অনেকেই প্রতারিত হয়েছেন ও হচ্ছেন। আর কিছু অসৎ, লোভী ও অপেশাদার ব্যবসায়ীর কারণে এখন পুরো অনলাইন ব্যবসাই প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের কারণে ক্রেতা-বিক্রেতার স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে এবার কোরবানির পশু কেনাবেচার জন্য ডিজিটাল হাটের ধারণা নিয়ে আসে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। নিবন্ধনের পর নিজস্ব প্যানেল থেকে পশুর ছবি, ভিডিও ও অন্যান্য তথ্য আপলোড করতে হয়। ফলে ক্রেতারা সহজেই কোরবানির জন্য প্রয়োজনীয় পশু পছন্দের সুযোগ পান ও বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে ডেলিভারি নিয়েছেন। ক্রেতারা ঘরে বসেই গরুর ছবি ও ভিডিও দেখা এবং ওজন জানার সুযোগ পান এত। গরুচাষি, খামারি বা ব্যাপারীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার সুযোগও ছিল। এরপর নির্দিষ্ট স্থান থেকে অথবা হোম ডেলিভারির ভিত্তিতে টাকার বিনিময়ে পশু সংগ্রহ করা হয়। আবার অনলাইনে কিনে বাসায় ডেলিভারির পর পশু দেখে পছন্দ না হলে ফেরত দেয়ার সুযোগও ছিল।
শুধু তা-ই নয়, ডিজিটাল হাট ও অন্যান্য অনলাইন হাট থেকে গরু কেনায় দামের ১০ থেকে ২৫ শতাংশ পরিশোধ করলে খামারে গরু রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ক্রেতার ইচ্ছা অনুযায়ী, ঈদের এক থেকে দুই দিন আগে এসব গরু সরবরাহ করা হয়। তবে পশু সরবরাহের আগেই বাকি মূল্য পরিশোধ বা ক্যাশ অন ডেলিভারির সুযোগও দিয়েছেন অনেকে। ঢাকায় বেশিরভাগ ক্রেতার পশু রাখার জায়গা না থাকায় ঈদের একদিন আগে পশু নিতে চায়।
তবে এতকিছুর পরেও অনলাইন হাটে শেষমেশ কী পরিমাণ কোরবানির পশু বিক্রি হলো এবং তাতে ক্রেতা-বিক্রেতার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির পরিমাণ কেমন, তা ঈদের পরে জানা যায়।
ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি ভালো হলেও অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরের মানুষের আগ্রহ কম ছিল।
ইংরেজি দৈনিক বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের বরিশাল ব্যুরোপ্রধান জহিরুল ইসলাম জুয়েল সম্প্রতি এক টকশোতে জানিয়েছেন, বরিশাল অঞ্চলের মানুষের মধ্যে অনলাইনে কোরবানির পশু কেনার আগ্রহ খুবই কম। বরং মানুষ হাটে গিয়ে দেখে-শুনে, দরদাম করে পশু কেনায় অভ্যস্ত। তিনি বিভিন্ন হাট ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, মানুষের মধ্যে করোনা নিয়ে খুব একটা ভয়-ভীতিও নেই।
দেশের প্রশাসনসহ সর্বত্র ডিজিটালাইজ করা সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। সেই ধারাবাহিকতায় ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসায় উৎসাহ দেয়া হয়। তার ওপর করোনাভাইরাসের মতো মহামারির কারণে মানুষের বাজারে যাওয়ার পরিমাণ কমে যাওয়ায় অনেকেই এখন চাল-ডালের মতো নিত্যপণ্যও অনলাইনে কিনছেন; কিন্তু সবার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। অনেকেই কাক্ষিত পণ্য পাচ্ছেন না এবং অনেক পণ্যের দামই বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনলাইনে কোরবানির পশু কেনার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, পশুর দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। কেউ কেউ লিখেছেন, অপেক্ষাকৃত কম দামের গরুতে ক্লিক করলে সেখানে লেখা ‘সোল্ড’ বা বিক্রি হয়ে গেছে।
অনলাইনে কেনাকাটার আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কম সময়ে ডেলিভারি পাওয়া। দেশের একটি বড় অনলাইন প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে দুই মাসেও পণ্য ডেলিভারি না দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। তারা অন্যান্য সাইটের তুলনায় কম টাকায় পণ্য দেয় বলে প্রচুর মানুষ সেখান থেকে কিনতে আগ্রহী হয়; কিন্তু অনেকেই মূল্য পরিশোধ করে দিনের পর দিন পণ্যের অপেক্ষায় থাকেন। ওই অনলাইন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রচারিত হয়েছে।
অনলাইন কেনাকাটায় জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে কিছু অসৎ ও ভুঁইফোড় ব্যবসায়ীর আবির্ভাব হয়েছে, যাদের উদ্দেশ্যই হলো মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা। চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের আকর্ষণ করে তাদের কাছ থেকে পণ্যের দাম নিয়ে পণ্য না দেয়া বা দিলেও ছবির সঙ্গে পণ্যের মিল না থাকা। অনলাইনে এক পণ্য দেখিয়ে আরেকটি সরবরাহসহ প্রতারণার নানা অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে অনেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকের খবরও এসেছে।
অনেকেই বিভিন্ন নামি-দামি ব্র্যান্ডের পণ্যসামগ্রীর ছবি ডাউনলোড করে কম্পিউটারে ফটোশপের মাধ্যমে নিজেদের পণ্য হিসেবে প্রদর্শন করে সেগুলো বিক্রির বিজ্ঞাপন দেয়। তারা এসব পণ্যের প্রকৃত মূল্য থেকে অনেক কমে বিক্রির ব্যাপারে অনলাইনে প্রচার চালায়। এতে অনেকে কিনতে আগ্রহী হয়ে যোগাযোগ করে। তখন প্রতারকচক্রের সদস্যরা ক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্যের দাম ও ডেলিভারি চার্জ নিয়ে নিম্নমানের আরেক পণ্য পাঠায়। অনেক সময় পণ্যের মূল্য ও পরিবহন খরচ নিয়ে কোনো পণ্যই পাঠায় না।
এরকম একটি অনলাইনে পোশাক কিনতে টাকা পাঠানোর দুই মাস পরেও পণ্য পাননি এই প্রতিবেদকের স্ত্রী। পরে ওই অনলাইনে যোগাযোগ করা হলে নম্বরটি সঠিক নয় বলে জানানো হয়।
আবার করোনাকালের সুযোগ নিয়ে অনেকে ব্যবসা শুরু করলেও অনলাইন ব্যবসার নিয়ম-কানুন জানেন না। অনলাইনে যারা ব্যবসা করেন, সম্ভবত তাদের অধিকাংশেরই ট্রেড লাইসেন্স নেই। অনলাইনে ব্যবসা করতে গেলে ট্রেড লাইসেন্স লাগবে কি না সেটিও পরিষ্কার নয়। আবার অনলাইনে কেনাকাটা করতে গিয়ে প্রতারিত হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর তার বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেয়, তাও স্পষ্ট নয়। ফলে যে যেভাবে পারে ব্যবসা করছে। এসব কারণে পুরো অনলাইন ব্যবসা সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে।
সম্প্রতি একটি জনপ্রিয় অনলাইন সাইট থেকে ক্রেডিট কার্ডের ইএমআই পদ্ধতিতে বিখ্যাত ব্র্যান্ডের একটি ৪০ ইঞ্চি স্মার্ট টিভি ক্রয় করেন এই প্রতিবেদক। টিভি হাতে পাওয়ার পরে দেখা গেল প্যাকেট ওই ব্র্যান্ডের নয়, ম্যানুয়াল ও রিমোটও সেই ব্র্যান্ডের নয়। শুধু টিভির গায়ে ব্র্যান্ডের নাম লেখা। টিভির সঙ্গে যে স্ট্যান্ড দেয়া, সেটিও ভুল। ওয়াল হ্যাঙ্গার নেই। ডেলিভারিম্যান টিভিটা খুলে ডিশ লাইনে যুক্ত করে দেখলেন ছবির মানও খারাপ। তার মানে পুরো জিনিসটাই নকল। কাস্টমার কেয়ারে ফোন করলে তারা জানান, সাত দিনের মধ্যে পণ্যটি ফেরত দেয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রশ্ন হলো- ক্রয় করা একটি পণ্য ফেরত দেয়ার জন্য সেটিকে নতুন করে প্যাক করে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়া, সময় ব্যয় করা এবং পুরো ঘটনাটির জন্য একজন ক্রেতার যে মানসিক অস্বস্তি হলো, সেটির ক্ষতিপূরণ কে দেবে?
কভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ শুরুর পর এপ্রিল-মে মাসে বিভিন্ন অনলাইন সাইটে গিয়ে দেখা গেছে, বাজারে যে জিনিসের দাম ৫০০ টাকা, সেটি অনায়াসে অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। তার সঙ্গে ডেলিভারি চার্জ। হয়তো কোনো একটি জীবাণুনাশকের এক লিটার বোতলের দাম আড়াইশ’ টাকা। তার সঙ্গে ডেলিভারি চার্জ দেড়শ’ টাকা।
করোনাভাইরাসের কারণে অনেকে চাল-ডাল, মাছ-মাংসের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও অনলাইনে কিনেছেন। সেই সুযোগ নিয়েছেন কিছু লোভী ব্যবসায়ী। দেখা গেছে, বাজারে যে মাছের কেজি তিনশ’ টাকা, অনলাইনে সেটি লেখা হয়েছে সাড়ে পাঁচশ’ টাকা। তার সঙ্গে ডেলিভারি চার্জ তো আছেই। এভাবে প্রতিটি পণ্যের দামই বাজারের চেয়ে বেশি। আবার মানের প্রশ্ন তো রয়েছেই। তার মানে কিছু লোক অনলাইন ব্যবসা শুরুই করেন রাতারাতি ধনী হওয়ার ধান্ধায়।
তবে প্রকৃত অর্থে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়তে গেলে অনলাইন ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ তথা সরকারের কঠোর মনিটরিং জরুরি। ক্রেতাদের প্রতারিত হওয়া ঠেকাতে আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার। যে কেউ চাইলেই যে কোনো কিছুর ব্যবসা খুলে বসতে পারবেন কি না, তারও একটি নীতিমালা থাকা দরকার। কে কী বিক্রি করছেন ও এই ব্যবসার আড়ালে কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ড করছেন কি না, সেদিকে আইন-শৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকতে হবে।
সর্বোপরি, যারা অনলাইন ব্যবসায় যুক্ত, তাদেরও লোভ সংবরণ করে দ্রুত ধনী হওয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে মানুষ মহামারির মতো জরুরি পরিস্থিতিতে অনলাইনে কেনাকাটা করবে ঠিকই, পরিস্থিতি ভালো হলে আর এদিকে ফিরেও তাকাবে না। তাতে একটি সম্ভাবনাময় খাতের অকালমৃত্যু হবে।