নিজস্ব প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২০, ০৭:২৭ পিএম | আপডেট: ০৭ আগস্ট ২০২০, ০৭:৩৩ পিএম
অভিযোগের শেষ নেই সদ্য প্রত্যাহার হওয়া টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে। তার ঘুষবাণিজ্য ও লুটপাটের হাতিয়ার ছিলো কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে ক্রসফায়ার। ইয়াবার এ প্রবেশদ্বার টেকনাফে ক্রসফায়ারের রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন পুলিশের এই সাবেক ওসি।
পুলিশ ও মানবাধিকার সংস্থার তথ্য মতে, ২০১৮ সালের মে মাস থেকে গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত শুধু কক্সবাজারে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ২৮৭ জন নিহত হয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ১৭৪ জন, বিজিবির সঙ্গে ৬২ জন এবং র্যাবের সঙ্গে ৫১ জন। শুধু টেকনাফেই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে ১৬১ জন। এর বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটে মেরিন ড্রাইভ এলাকায়। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে এলাকাটি ‘ক্রসফায়ার জোন’ হয়ে উঠলেও থামেনি ইয়াবার কারবার।
ওসি প্রকাশ্যে মাদক কারবারিদের নির্মূল করার ঘোষণা দিলেও তার এই মিশনে শীর্ষ কারবারি হাজি সাইফুল ছাড়া উল্লেখযোগ্য কেউ নিহত হয়নি। নিহতদের বেশির ভাগই ইয়াবার খুচরা বিক্রেতা। স্থানীয় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, আত্মসমর্পণের নামে শীর্ষ কারবারিদের রেহাইয়ের সুযোগ দিয়ে এবং চুনোপুঁটিদের দমন করে চলছে ‘ক্রসফায়ার বাণিজ্য’।
কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ককে কার্যত ডেথ জোনে পরিণত করেন তিনি। আতঙ্কে রাতে এ সড়কে চলাচলে মারাত্মক ভীতির সঞ্চার হয় স্থানীয়দের মধ্যে। চাহিদা মতো টাকা না পেয়ে ক্রসফায়ারে হত্যার বিস্তর অভিযোগও রয়েছে প্রদীপ কুমার দাসের বিরুদ্ধে।
দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দফায় দফায় পার পেয়ে গেলেও এবার আর শেষরক্ষা হয়নি। সাতজন পুলিশ সদস্য বৃহস্পতিবার (৬ আগস্ট) কক্সবাজার আদালতে হাজির হলে তাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়ে তিনজনকে সাত দিনের রিমান্ডের আদেশ দেয় আদালত।
মূলত মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডে প্রদীপের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসার পরই মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা। মাদক নির্মূলের অসিলায় ক্রসফায়ারের নামে কন্ট্রাক্ট কিলিং, লোকজনকে জিম্মি করে টাকা আদায়, এমনকি ধর্ষণে সহায়তার অভিযোগও উঠছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগ উঠেছে, অনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে প্রদীপ আয় করেছেন শত শত কোটি টাকা। দেশ-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফ থানা থেকে সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের চাকরিজীবনের পুরোটাই সমালোচনা ও বিতর্কে ভরা। বিতর্কিত এই পুলিশ কর্মকর্তা নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে চাকরিজীবনে বরখাস্ত ও প্রত্যাহার হয়েছেন কমপক্ষে পাঁচবার। প্রতিবার অদৃশ্য ক্ষমতাবলে ফিরেছেন স্বপদে। পদে ফিরেই ধারণ করেছেন দানবীয় রূপ। প্রভাবশালী প্রদীপের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাও।
সূত্র জানা গেছে, ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের এক শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বায়েজিদ বোস্তামী থানায় মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ ওঠে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে। অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটি ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় তিনি বরখাস্ত হন। তবে তাকে বহাল করার জন্য দেশের অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি ফোন করেছেন পুলিশের নীতিনির্ধারকদের কাছে। অল্প দিনের মধ্যেই প্রদীপ চাকরি ফিরে পেয়ে পুনরায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
তবে এর আগে ২০১৩ সালে একটি মামলার বিরোধিতা করায় এক আইনজীবীকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে পাঁচলাইশ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় প্রদীপসহ আট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন ওই আইনজীবী। একই বছরের ২৪ মে পাঁচলাইশ থানার পাশের একটি কমিউনিটি সেন্টার থেকে শিবির আখ্যা দিয়ে ৪০ ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকে আটক করেন প্রদীপ। ওই সময় তিনি ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা-কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিতও হন।
পাঁচলাইশে ওসি থাকাকালে বাদুড়তলায় বোরকা পরা এক বৃদ্ধাকে রাজপথে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করে ব্যাপক সমালোচিত হন প্রদীপ। এ ঘটনার পর সারা দেশে তোলপাড় হয়। এরপর পাঁচলাইশ থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয় ওসি প্রদীপকে।
২০১২ সালে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) পতেঙ্গা থানার ওসির দায়িত্ব পালনকালে আদালতের অনুমতি ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে আসা বিদেশি জাহাজকে তেল সরবরাহে বাধা দেয়া, বার্জ আটক এবং বার্জ মালিকসহ ১২ ব্যক্তিকে মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এসব ঘটনা ফাঁস হলে প্রশাসনে ব্যাপক তোলপাড় হয়। পুলিশ সদর দফতর গঠিত তদন্ত কমিটি প্রদীপকে অভিযুক্ত করলে পতেঙ্গা থানা থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়।
সিএমপির কোতোয়ালির উপপরিদর্শক (এসআই) থাকাকালে নগরের পাথরঘাটার এক হিন্দু বিধবা মহিলার জমি দখলের অভিযোগ ওঠে প্রদীপের বিরুদ্ধে।
সূত্র বলছেন, নব্বইয়ের দশকে বিএনপি সরকার আমলে এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর সুপারিশে পুলিশে যোগদান করেন প্রদীপ কুমার দাশ। এসআই হিসেবে পুলিশে যোগদানের পর থেকে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে একের পর এক ঘটনার জন্ম দেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভোল পাল্টে প্রদীপ অনেক প্রভাবশালীর কাছের লোক হয়ে ওঠেন।
২০১৭ সালে মহেশখালী থানায় ওসি হিসেবে যোগ দিয়ে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণের নামে নিত্যনতুন কৌশলে অপকর্ম করতে থাকেন তিনি। দুই বছর আগে টেকনাফ থানায় যোগদানের পর আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন প্রদীপ। ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে নিয়মিতভাবে টাকা আদায়, লুটপাট, মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আঁতাতসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এদিকে ওসি প্রদীপের কক্সবাজার কোর্টে আত্মসমর্পণ করা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আইনে ৩০২ ধারার মত আমলযোগ্য মামলার আসামিকে গ্রেফতারের নির্দেশনা থাকলেও ওসি প্রদীপের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। উল্টো তাকে ব্যাপক নিরাপত্তা দিয়ে কক্সবাজার কোর্টে আত্মসমর্পণের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
এছাড়া পুলিশের হেফাজতে থাকা ওসি প্রদীপ গ্রেফতার না আত্মসমর্পণ করেছে তা নিয়েও বৃহস্পতিবার সারাদিন ছিলো গুঞ্জন। আইনবিদরা মনে করেন, এর মাধ্যমে অভিযুক্তকে অতিরিক্ত সুবিধা দেয়া হয়েছে।