সুদেষ্ণা ঘোষ
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২০, ১০:৪৭ এএম
সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত ৫৫০ লাখ বছরের পুরনো একটি পেঁচার জীবাশ্ম জীববিজ্ঞান জগতের একটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
অতি প্রাচীন এই শিকারি পাখিটি বাজপাখির মতো শিকার ধরতো- এই তথ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জীবাশ্ম পেঁচাটির সংরক্ষিত পায়ের হাড় পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে। তীক্ষ্ণ নখের মাধ্যমে এটি তার শিকার ধরতো; কিন্তু বর্তমানে সমগোত্রীয় পক্ষিকুল তাদের চঞ্চুর সাহায্যে শিকার ধরে থাকে।
গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়, নতুন খোঁজপ্রাপ্ত অস্থিসমূহ এক অজানা গোত্রভুক্ত পেঁচকের, যা একটি বহুপ্রাচীন জীবাশ্ম।
যদিও এই জীবাশ্মটি ছিল করোটিবিহীন; কিন্তু প্রত্যেকটি হাড়ই ছিল অক্ষত অবস্থায়, যা ত্রি-মাত্রায় সংরক্ষিত করা হয়েছে। পেঁচকটি ছিল বৃহৎ; প্রায় ২ ফুটের কাছাকাছি (৬০ সেন্টিমিটার) লম্বা। এটির দৈর্ঘ্য ছিল বর্তমানের তুষার পেঁচক প্রজাতির মতো (নেকটিয়া স্ক্যান্দিয়াকা)।
১৯৯০ সালে ৫৫০ লাখ বছর আগে উত্তর ওয়োমিংয়ের পললভূমিতে উইলউড তৈরির সময়ে জীবাশ্মটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। সাম্প্রতিক গবেষকরা পেঁচকটির নামকরণ করেছেন, ‘প্রিমোপটিন্যাক্স পলিওটরাস’। প্রিমোপটিন্যাক্স অর্থাৎ ‘প্রথম পেঁচক’ (‘প্রিমাস’ হলো একটি ল্যাতিন শব্দ, যার অর্থ ‘প্রথম’, এবং ‘পটিন্যাক্স’ একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ ‘পেঁচক’)। এই প্রজাতিকে ‘ধূসর ষাঁড়’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। জীবাশ্মটি যে সময়ে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, সেই সময়টিকে বিজ্ঞানীরা ভূ-তাত্ত্বিক সময় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিগত ২৮ জুলাই বিজ্ঞানীরা মেরুদণ্ডি প্রাণীদের জীবাশ্মবিজ্ঞানের সাময়িক পত্রিকাতে এই বিষয় সংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণী তুলে ধরেছিলেন।
জীবাশ্ম বিজ্ঞানীরা এই প্রাচীন পেঁচকটিকে শনাক্ত করেছিলেন পেঁচকের হাড়ের আকৃতির মাধ্যমে, তাদের মধ্যে স্কন্ধের হাড়, পাখনার মধ্যে হিউমেরাস ও টিবিওটারসাসের (হাঁটু ও গোড়ালির মধ্যবর্তী অংশে অবস্থিত হাড়) মতো পায়ের হাড়ের উপস্থিতি এবং টার্সোমেটাটার্সাস (গোড়ালি ও পায়ের আঙুলের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত), যেটি শিকার ধরার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গবেষণার সহযোগী রচয়িতা থিয়েরি স্মিথ, রয়্যাল বেলজিয়ান ইনস্টিটিউট অব ন্যাচারাল সায়েন্সের জীবাশ্ম-বিজ্ঞান গবেষণা শাখার প্রধান কর্মকর্তা জানান, ‘পেঁচকের জীবাশ্ম শনাক্তকরণের জন্য টার্সোমেটাটার্সাসই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাড়।’
প্রিমোপটিন্যাক্সের ক্ষেত্রে, পেঁচকের আঙুলিতে অবস্থিত হাড়গুলোই বিশেষভাবে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আধুনিককালের পেঁচাগুলোর আঙুলের নখর সমদৈর্ঘ্যবিশিষ্ট; কিন্তু বর্তমানের সাধারণ শিকারি পাখিদের মতোই। প্রিমোপটিন্যাক্স পলিওটরাসের পায়ের পশ্চাৎঅঙ্গুলি এবং দ্বিতীয় অঙ্গুলির নখর তাদের তৃতীয় এবং চতুর্থ আঙুলের নখরের তুলনায় বৃহৎ আকৃতিবিশিষ্ট।
অধুনালুপ্ত এই পেঁচক প্রজাতি বাজপাখি ও ঈগলের মতো শিকার ধরার জন্য তাদের লক্ষ্য স্থির করত এবং তারপর সেটিকে ধরে প্রাণীটির দেহ তীক্ষ্ণ নখরের সাহায্যে ছিন্নভিন্ন করে দিত।
গবেষণা অনুযায়ী তুলনা করলে দেখা যায়, পেঁচারা সাধারণত তাদের ধারালো চঞ্চু দিয়ে শিকারকে নিহত করে। স্মিথের ব্যাখ্যানুসারে ৫৫০ লাখ বছর আগে যখন প্রিমোপটিন্যাক্স ওয়োমিংয়ের উঁচু আকাশে উড়ে বেড়াত, তখন বানর, বীবর, হরিণ ও ঘোড়াদের প্রাচীন প্রজাতি প্রভৃতি স্তন্যপায়ীদের আধিক্য থাকার জন্য উত্তর আমেরিকা বিখ্যাত ছিল। এই জীবাশ্ম পেঁচাটির আকর্ষণীয় পা দুটি খুব সহজেই খরগোশের মতো আকৃতির যে কোনো প্রাণীকে আবদ্ধ করতে সক্ষম ছিল। যদিও সেই সময়ে ওই অঞ্চলে খরগোশের আধিক্য ছিল।
স্মিথের ভাষায়, ‘প্রাচীনযুগে বেশিরভাগ ক্ষুদ্রাকৃতিবিশিষ্ট স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সাথে আধুনিকযুগের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের দৈর্ঘ্যরে বিশেষ কোনো তারতম্য চোখে পড়ে না এবং তারা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুবিশিষ্ট পরিবেশে বসবাস করে আসছে।’
প্রিমোপটিন্যাক্স গাছ থেকে ক্ষুদ্রাকৃতির বানর কিংবা মাংসাশী প্রাণীদের শিকার করত অথবা স্তন্যপায়ী প্রাণী কিংবা বীবর তালিকাভুক্ত কোনো প্রাণীকে ছোঁ-মেরে নিয়ে গিয়ে মাটিতে ফেলে তীক্ষ্ণ নখ দ্বারা আহত করতো।
প্রিমোপটিন্যাক্স একটি দুর্লভ জীবাশ্ম, যা প্রাচীনযুগে পেঁচক প্রজাতির উপস্থিতির নিরিখে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। এর আকার ও বাজপাখির মতো পায়ের উপস্থিতি জানান দেয় পেঁচকদের মধ্যেও প্রজাতিগত বৈচিত্র্য গুরুত্বপূর্ণ এবং লক্ষ্যণীয় একটি বিষয়।
তথ্যসূত্র: লাইভ সায়েন্স পত্রিকা