বিদ্রোহী নজরুল

মো. মোস্তফা কামাল

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২০, ১০:৩৫ পিএম | আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০২০, ১১:১৮ পিএম

বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী প্রতিভা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৮৯৯ সালের ২৪ মে পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমেদ এবং মাতা জাহেদা খাতুন। কাজী ফকির আহমেদের সাত পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের মধ্যে চার পুত্রের অকাল মৃত্যুর পর জন্মগ্রহণ করেন নজরুল। এজন্য তাঁর ডাকনাম রাখা হয় দুখু মিঞা।

সময়ের আবর্তে সেই দুখু মিঞাই হয়ে ওঠেন বাংলাসাহিত্যের অমর ব্যক্তিত্ব। ১৯২১ সালে রচিত হয় তার অসামান্য সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’। কবিতাটি এতোটাই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যে বিশেষণটি নজরুলের নামের সাথে এখনও শোভাবর্ধন করে যাচ্ছে। বিদ্রোহী কবিতা কবি নজরুলের জীবন এবং কবি চেতনার এক বিশিষ্ট প্রতিনিধি। এই কবিতায় তিনি লেখেন-
...মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না—
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না—
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত।
আমি সেইদিন হব শান্ত।

১৯২১ সালে নজরুল কুমিল্লায় অবস্থান করার সময় ব্রিটেনের যুবরাজ ভারতে আসেন। যুবরাজের আগমন উপলক্ষে তৎকালীন কংগ্রেসের আহ্বানে সমগ্র দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। নজরুল কুমিল্লায় প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিয়ে ‘জাগরণী’ গানটি গেয়ে শোনান। ১৯২২ সালে ধীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ভগিনী প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের গভীর প্রেম গড়ে ওঠে। ১৯২২ সালের ১৭ জানুয়ারি কাজী নজরুল কলকাতার বিখ্যাত জোঁড়াসাকোর ঠাকুর বাড়িতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিদ্রোহী কবিতাটি পাঠ করে শোনান। সে বছর আগস্ট মাসে নজরুলের সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা ’ধূমকেতু’ প্রকাশিত হয়। ধূমকেতুর পূজাসংখ্যায় নজরুলের লেখা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ এনে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কুমিল্লা থেকে নজরুলকে গ্রেফতার করা হয়।

পরবর্তীতে ১৯২২ সালের ২৪ নভেম্বর তাঁকে কলকাতায় আনা হয় এবং চিফ ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে তাঁর বিচার শুরু হয়। ১৯২৩ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি জেলে বসে রচনা করেন ’রাজবন্দীর জবানবন্দী’। কোর্টের বিচারে নজরুলকে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয় এবং আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই বছর এপ্রিল মাসে তাকে হুগলি জেলখানায় স্থানান্তর করা হয়। কারাবন্দিদের ওপর জেল কর্তৃপক্ষের অন্যায়, অবিচার আর নির্মম ব্যবহারের  প্রতিবাদে নজরুল বিদ্রোহ ঘোষণা করে অনশন শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে অনশন ভঙ্গ করার জন্য টেলিগ্রাম পাঠান। কিন্তু জেল কতৃপক্ষ সেই টেলিগ্রাম নজরুলকে না দিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে ফেরত পাঠায়। ১৯২৩ সালে ২৩ মে নজরুল অনশন ভঙ্গ করেন। পরবর্তীতে ১৫ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান।

প্রতিবাদ আর বিদ্রোহ যেন নজরুলের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য। এটিকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন নতুন সৃষ্টির লক্ষ্যে। অন্যায়ের প্রতিবাদ, কুসংস্কার ধ্বংস এবং নতুন সৃষ্টি এই ত্রিমাত্রিক সত্তাই নজরুল প্রতিভাকে নিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়। তাই তো`বিদ্রোহী' কবিতায় তিনি বলেন-
আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!

নজরুলের রচনার পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে প্রেম আর ধর্মের অনুসঙ্গ। তার রচনায় মানব প্রেম আর মানব ধর্মের বাণী যেন জীবন্ত। সমাজ ও ধর্মের সংকীর্ণতা, ধনী-গরিবের সীমাহীন বৈষম্য, ধর্মে ধর্মে বিভেদ এবং সাম্প্রদায়িকতা কবিমনকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। এসবের বিরুদ্ধেই তিনি করেছেন সর্বত্র বিদ্রোহ। মানুষের জয়গান গেয়েছেন। সবার উপরে স্থান দিয়েছেন মানুষকে। তিনি তাই ‘মানুষ’ কবিতায় লিখেছেন-
গাহি সাম্যের গান—
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।

নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম নিরপেক্ষ। তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অমানবিক বিষয়গুলোর বর্জনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এ কারণে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের গোঁড়া ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী লোকজন কবিকে পছন্দ করতেন না। নজরুলের জীবন দর্শনে ছিল সহবস্থানের মনোভাব, অসাম্প্রদায়িকতার মনোভাব। ১৯৪১ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির রজত জয়ন্তী উপলক্ষে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন-

“হিন্দু-মুসলমান দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব-অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাঙ্ক কোটি কোটি টাকা পাষাণ-স্তুপের মতো জমা হয়ে আছে এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। কর্মজীবনে অভেদসুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম অসুন্দরকে ক্ষমা করতে, অসুরকে সংহার করতে এসেছিলাম-আপনারা সাক্ষী আর সাক্ষী আমার পরমসুন্দর”।

সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই— চন্দ্রীদাসের এই উক্তি নজরুলের মানবতাবাদে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ১৯২৯ সালে কলকাতার আলবার্ট হলে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন- 

“আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলে শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। কেউ বলেন আমি মুসলমান, কেউ বলেন কাফের আমি বলি ও দুটোর কোনোটাই নই, আমি শুধু মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডসেক করার চেষ্টা করেছি। গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি”।

নজরুলের মানসপটে ছিলো আন্তর্জাতিক মানবতাবোধ। তিনি ছিলেন সকল প্রকার হীনতা, কুসংস্কার, স্বার্থপরতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে। আবুল কাশেম ফজুলল হক নজরুলের মানবতাবাদী চিন্তার পটভূমি সম্পর্কে বলেছেন- “দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় নজরুলের কর্মকাল। যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি বিস্ময়কর সৃষ্টিধারা ও চলছিল তখন। লেলিনের নেতৃত্বে রুশ বিপ্লব, মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে তুরস্ক বিপ্লব, সানইয়াত সেনের পরে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে চীন বিপ্লব রচনা করেছিল নব সৃষ্টির ধারা। ব্রিটিশ শাসিত ভারত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপ্ত হয়েছিল। রামমোহন-বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারা ও ভারতের শিক্ষিত বাঙালির মনে তখন মহৎ আকাঙ্ক্ষা জাগাতে সক্ষম হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদী, স্বদেশি, অসহযোগ প্রভৃতি নামে অভিহিত আন্দোলনগুলো তখন অসাধারণ বিকাশে আত্মপ্রকাশ করছে। বাংলা ভাষার কবি সাহিত্যিকদের মধ্যেও যুদ্ধ ও ধ্বংসলীলাকে যাঁরা বড় করে দেখছেন তাঁরা হতাশায় আচ্ছন্ন হয়েছেন— যেমন সুধীন দত্ত, জীবনানন্দ দাস। আর যাঁরা সৃষ্টির প্রবাহকে বড় করে দেখেছেন তাঁরা গোটা পৃথিবীকে সেই সঙ্গে স্বদেশের মহত্তর সৃষ্টির সম্ভাবনা অবলোকন করেছেন। নজরুল ছিলেন শেষোক্তদের সবচেয়ে বলিষ্ঠ প্রতিনিধি। তখনকার সামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তিসংগ্রাসের আবেগ নজরুলের কাব্য, প্রবন্ধে, উপন্যাসে যতটা ধরা-পড়েছে, বাংলাভাষায় অন্য কোনো লেখকের রচনায় ততটা ধরা পড়েনি।”

১৯৩৬ সালের মুসলিম ছাত্র সম্মেলনের ফরিদপুর জেলা সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে নজরুল বলেন- “দেয়ালের পর দেয়াল তুলে আমরা ভেদ বিভেদের জিন্দারখানার সৃষ্টি করেছি, কত তার নাম শিয়া, সুন্নী, শেখ, সৈয়দ মোগল, পাঠান, হানাফি, শাফি, মালেকী, লামজহাবী, ওহাবী আরও কত শত দল। এই শতদলকে একটি বোঁটায় একটি মৃণালের বন্ধনে বাঁধতে পার— তোমরাই। শতক বিচ্ছিন্ন এই শতদলকে এক সামিল করো, এক জামাত কর— সকল ভেদ-বিভেদেও প্রাচীর নিষ্ঠুর আঘাতে ভেঙে ফেল”।

কাজী নজরুল ইসলামের দেশাত্বচেতনার উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়। দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য জাতীয় চেতনার উৎস হিসেবে নজরুলের কবিতা পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি পরাধীন সমাজকে ভাঙতে চেয়েছেন, অতঃপর ধ্বংসস্তূপের উপর ফোটাতে চেয়েছেন সৃষ্টির আনন্দ কুসুম। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষিত মিনার। প্রলয়োল্লাস কবিতায় তিনি উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেন-
ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? — প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন।
আসছে নবীন—জীবন-হারা অ-সুন্দরে করতে ছেদন।
তাই সে এমন কেশে বেশে
প্রলয় বয়েও আসছে হেসে—
মধুর হেসে!
ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির-সুন্দর!

কবিতার মতো সংগীতেও নজরুলের দেশাত্মচেতনার প্রকাশ ঘটেছে। নজরুলের স্বদেশ সংগীতগুলো পরাধীন ভারতবাসীর প্রাণে সঞ্চার করেছে নতুন স্পন্দন, বাঙালিকে করেছে উদ্দীপিত উদ্বেলিত। নজরুলের স্বদেশ-সংগীতগুলোর বিশেষত্ব এই যে, সেখানে দেশপ্রেমের উদার আহ্বানের সঙ্গে ছিল বৈপ্লবিক চেতনার প্রকাশ। তিনি দেশপ্রেমের সঙ্গে-সঙ্গে মানুষকে বিদ্রোহের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকেই তাঁর প্রধান অন্বিষ্ট বলে বিবেচনা করেছেন। তাই দেশের মানুষের সার্বিক যুক্তির জন্য তিনি গেয়েছেন শৃঙ্খল-মুক্তির গান-
এই শিকল-পরা ছল মোদের এই শিকল-পরা ছল।
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল।
কিংবা
কারার ঐ লৌহ-কপাট
ভেঙে ফেল, কর রে লোপাট
রক্ত-জমাট
শিকল পূজোর পাষাণ-বেদী।

দেশাত্মবোধের সংগীত হিসেবে নজরুলের এ-সব গান বাঙালির চিরায়ত সম্পদ। বিদ্রোহের উন্মাদনাই নজরুলের দেশাত্মবোধক গানগুলোর মূল কথা। [ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ, কথাগুচ্ছ গুচ্ছকথা; পৃষ্ঠা-৪৮]

জীবনব্যাপী চিন্তা ও চেতনার ক্ষেত্রে তিনি কখনো মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ করেন নাই। মানুষের ভেদাভেদ তিনি স্বীকারও করেননি। নজরুলের সাম্যবাদ সর্বধর্মের মহামিলন। তাইতো নজরুল অকপটে বলেছেন-
গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা- ব্যবধান
যেখানে মিশিছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।
-(সাম্যবাদী; সর্বহারা)

নজরুলের রচনায় উঠে এসেছে মানুষ যে ধর্মানুরাগীই হোক না কেন, স্থান-কাল-পাত্রের বিভিন্নতা সত্ত্বেও মানুষের মৌলিক সত্ত্বা এক এবং অভিন্ন। তাঁর বিদ্রোহী কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে-
মূর্খরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো
আদম, দাউদ, ঈসা, মুছা, ইব্রাহীম, মোহাম্মাদ (স.)
কৃষ্ণ-বুদ্ধনামক, কবীর বিশ্বের সম্পদ-
আমাদেরই এরা পিতা পিতামহ এই আমাদের মাঝে,
তাঁদেরই রক্ত কম-বেশি করে প্রতি ধমনীতে বাজে।
-(মানুষ; সাম্যবাদী)

নজরুল ইসলাম রাজনীতিবিদ ছিলেন না কিন্তু তাঁর চেতনায় ছিল রাজনীতি সচেতনতা। তাঁর বিভিন্ন রচনায় রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছে। মনেপ্রাণে তিনি বিপ্লব আর বিদ্রোহকে সমর্থন করতেন। পুঁজিবাদী যুগের শোষণের কবলে মানুষ যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছে এ কথা নজরুল গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। ‘চোর, ডাকাত’ কবিতায় ধনতান্ত্রিক শোষণের চিত্র তিনি সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। কবিতাটি সাম্রাজ্যবাদী আর পুঁজিবাদী শোষণের কথাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়। তিনি লিখেছেন-
বিচারক। তব ধর্মদণ্ড ধর,
ছোটদের সব চুরি করে আজ বড়রা হয়েছে বড়।
যারা যত বড় ডাকাত-দস্যু জোচ্চোর দাগবাজ
তারা তত বড় সম্মানী জাতি-সঙ্ঘেতে আজ।

নজরুল যে সাহিত্য অঙ্গন থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নেবেন এটাও হয়তো তাঁর বিদ্রোহী সত্তায় জাগরিত হয়েছিল। তাই ১৯৪১ সালের ৫ ও ৬ এপ্রিল বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য-সমিতির রজত-জয়ন্তী অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে তার জীবনের শেষ ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন-

“যদি আর বাঁশী না বাজে আমি কবি বলে বলছি নে- আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি- আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন- আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসি নি, আমি নেতা হতে আসিনি- আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম- সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম”।

১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮) রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর বছর খানেকের মধ্যেই নজরুল অসুস্থ হয়ে যান। ক্রমেই তিনি নির্বাক ও সম্বিতহারা হয়ে যান। নানা পথ পরিক্রমায় যাপিত হয় কবির এই বাকরুদ্ধ জীবন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবি ঢাকায় আসেন। রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ধানমন্ডির ২৮ নং সড়কে ৩৩০/বি বাংলোতে কবির বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাদেশ সরকার কবিকে মাসিক ১০০০ টাকা বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেয়। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ সমাবর্তনের মাধ্যমে কবিকে সম্মানসূচক ডি. লিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ সালে কবি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করেন। সে বছরই কবিকে ‘একুশে পদক’ প্রদান করা হয়। 

কাজী নজরুল ইসলামের আজ ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালে ২৯ শে আগস্ট (১২ ভাদ্র, ১৩৮৩ বঙ্গাবদ্ধ) রবিবার সকাল ১০টা ১০ মিনিটে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) কবি পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। 

কবি নজরুল আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তিনি আমাদের কাছে রেখে গেছেন তাঁর বিদ্রোহী চেতনা, দেশপ্রেম, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্যের জয়গান, উদারনৈতিক রাজনৈতিক মতাদর্শ। যার মাধ্যমে আমরা প্রগতিশীল শান্তির উত্থান, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিনাশ, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন রোধ, উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দর্শন প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। যেখানে নজরুলের সেই ক্ষুধিত মানুষের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হবে না। বাঙালি চেতনাকে সমুন্নত রেখে গড়ে উঠবে অসম্প্রদায়িক ক্ষুধাযুদ্ধ, আত্মনির্ভরশীল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই সোনার বাংলা। যে মাটি তাঁর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের রক্তে স্নানিত হয়েছে সেই মাটিতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা বৃথা যেতে পারে না।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক:
মো. মোস্তফা কামাল
প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ
সরকারী শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh