স্মৃতিতে ভাস্বর- ভাস্কর মৃণাল হক

আয়শা মাহমুদ মীম

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০২:১৯ পিএম

কখনো ভাবিনি ভাস্কর মৃণাল হককে স্মৃতিচারণ করব, তার অর্জন নিয়ে লিখব। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে স্নাতক অর্জন করা মৃণাল হকের শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি ঝোঁক ছিলো প্রবল। পরিত্যক্ত চাবি ও চেইন নিয়ে কাজ করার অসাধারণ দক্ষতা ছিলো মৃণালের। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পর বড় সুযোগ পেতে তাকে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি।

প্রথম দিকে কাদা, মার্বেল, সিমেন্ট, কাঠ, ব্রোঞ্জ ও টেরাকোটা নিয়ে কাজ করতেন। মৃণাল হকের সর্বকালের সেরা ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে নির্মিত ‘গোল্ডেন জুবলি টাওয়ার’, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের ‘রত্নদ্বীপ’, মতিঝিলের ‘বলাকা’, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে ‘রাজসিক’, নৌবাহিনীর সদর দপ্তরের সামনে ‘অতলান্তিকে বসতি’, স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিশ্ব শান্তিকে কেন্দ্র করে বঙ্গবাজারে স্থাপিত ‘প্রত্যাশা’, পরীবাগে ‘জননী ও গর্বিত বর্ণমালা’ (মায়ের কোলে শহীদ ছেলের মরদেহ), ধানমন্ডি-২৭-এ ইস্পাতের কান্না।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও সুনাম অর্জন করেছিলেন মৃণাল হক। যুক্তরাষ্ট্রের রাজপথে জায়গা পেয়েছে তার ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও মোজাইক চিত্র। নিউইয়র্কের ট্রানজিট কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় তিনি কয়েক বছর মোজাইক চিত্র করেছেন। বিশ্বের ৩০টি দেশের প্রদর্শনীতে দেখিয়েছেন তার শিল্পকর্ম। জাপানে ওসাকা বাই-অ্যানুয়াল আর্ট অ্যান্ড স্কাল্পচার এক্সিবিশনে দু’বার তার শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। ফ্রান্স, ভারত, চীনেও শিল্পকর্ম প্রদর্শন করেছেন। বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় পাঁচবার একক প্রদর্শনী এবং এশিয়ান বাই-অ্যানুয়্যাল আর্ট এক্সিবিশনে সাতবার প্রদর্শনী করেছেন। দেশের মধ্যে ন্যাশনাল আর্ট এক্সিবিশনে ১৪ বার এবং ন্যাশনাল স্কাল্পচার এক্সিবিশনে সাতবার অংশ নিয়েছেন।

সুনাম অর্জনের পাশাপাশি তার ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্কও হয়েছে। ২০১৬ সালে রোমান যুগের ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘লেডি জাস্টিস’র আদলে মৃণাল হকের গড়া ভাস্কর্যটি সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের প্রধান ফটকের বাইরে স্থাপন করা হয়েছিল। এরপর হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ইসলামী সংগঠন ভাস্কর্যটির বিরোধিতায় নামে। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের সামনে থেকে ভাস্কর্যটি অপসারণ করে এনেক্স ভবনের পেছনে রাখা হয়। এর আগেও তার ভাস্কর্য সরানো হয়েছে। ২০০৮ সালে মৌলবাদীদের দাবির মুখে বিমানবন্দরের সামনে মৃণাল হকের ‘লালন’ ভাস্কর্য সরিয়ে নেয় সরকার। সে বছরই মতিঝিলের বলাকা ভাস্কর্য ভাংচুর করে একটি ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে মৃণাল হকের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিলো। নিজের চিত্রকর্ম তাকে বিভিন্ন সময় দেখানোর সুযোগ হয়েছিল। চিত্রের সমালোচনার পাশাপাশি কীভাবে উন্নতি করা যায়, সেই পরামর্শও তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। প্রথম যেবার মৃণাল হকের গুলশানের অফিসে গেলাম, প্রজেক্টরে ভাস্কর্যের অনেক ছবি দেখিয়ে এর পেছনের গল্প বলেছেন। তার ভাষ্য ছিলো, ‘যখন আমি কোনো পাবলিক ডোমেইনে ভাস্কর্য দেই, তখন সেটা জনগণের সম্পত্তি। তাই প্রশংসার পাশাপাশি আমাকে সমালোচনাও মেনে নিতে হবে।’

তার নিজস্ব জাদুঘর মৃণাল হক সেলেব্রেটি গ্যালারিতে মুগ্ধ হয়েছি। ৩২টি ভিন্ন ভাস্কর্য নিয়ে জাদুঘরটির যাত্রা শুরুর পেছনে অনুপ্রেরণা ছিলো মাদাম তুসো জাদুঘর। শেখ হাসিনা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, মাদার তেরেসা, চে-গুয়েভারা, শাকিরা, মাইকেল জ্যাকসন, শাহরুখ খান, ডোনাল্ড ট্রাম্প, বব মার্লে, লিওনেল মেসি, জনি ডেপ ও চার্লি চ্যাপলিনের মতো বিখ্যাতদের ভাস্কর্য ছিলো জাদুঘরে।

গত ২২ আগস্ট মাত্র ৬২ বছর বয়সে দেশের মূল্যবান এই ভাস্কর্য শিল্পী মৃণাল হকের প্রয়াণ হয়। তার সরলতা ও বিনয়ী স্বভাব আমাকে আকৃষ্ট করত। শৈশব থেকে তিনি ছিলেন আমার অনুপ্রেরণা। আমার এক এক্সিবিশনের চিত্রকর্ম দেখে মৃণাল হক বলেছিলেন, ‘তোমার চিত্রকর্ম অন্যদের চেয়ে আলাদা’। তার এই প্রশংসাবাক্য হৃদয়ে ধারণ করে রাখব।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh