সিরিয়ার মানবিক সংকট ও ট্রাম্পের নিষ্ঠুর নিষেধাজ্ঞা

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৫০ এএম

গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়া সরকার ও এর সহযোগীদের বিরুদ্ধে নতুন করে আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেন। ২০১১ সাল থেকেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ছিল সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ও তার সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। 

তবে মধ্য জুন থেকে কার্যকর হওয়া নতুন নিষেধাজ্ঞা সিরীয় বা অ-সিরীয়, যারা আসাদ সরকারের সাথে ব্যবসায়িক বা অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে সম্পর্ক রেখেছে, এমনকি ত্রাণ সংক্রান্ত বিষয়ে জড়িতদের ওপর ওই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। এটি ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য নীতিরই অংশ। আর তা মার্কিন মিত্রদের কেউ কেউ সমর্থনও করছে। 

এ নিষেধাজ্ঞায় মার্কিন স্বার্থের বিশেষ কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে মতামত বিশেষজ্ঞদের; কিন্তু এর ফলে মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো সিরীয়দের জন্য যে দুর্ভোগ বেড়েছে, সে কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ প্রতিনিধি জেমস জেফরি জানান, সিরিয়ায় রাশিয়ার অবস্থান দুর্বল করতে এ নিষেধাজ্ঞা জরুরি ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের বিরুদ্ধে এ রকম নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। রুশ প্রভাব কমলে আসাদ সরকারকে জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। তখন নিরাপত্তা পরিষদের ২২৫৪ নম্বর রেজলিউশন অনুযায়ী, সিরিয়ায় রাজনৈতিক সংস্কার সম্ভব হবে। চাপ বাড়াতে আসাদ সরকারের অধীনস্ত এলাকা ও তুর্কি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা তেলের খনিতে ইসরায়েলি হামলা চালাতেও সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেইসাথে বাগদাদে যাওয়ার মূল রাস্তাও বন্ধ করে দিয়েছে।

সম্প্রতি ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক অধ্যাপক জশোয়া ল্যান্ডিস ও কোলবি কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক স্টিভেন সাইমন সিরিয়ায় মার্কিন নীতি ও আসাদ বিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে লেখেন, ২০১১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ইউরোপীয় নেতারা ভেবেছিলেন, একটু জোর দিলেই আসাদ সরকারের পতন হবে এবং তাদের সমর্থিত নতুন সরকার ক্ষমতায় আসতে পারবে। কিন্তু মাঠের বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। মার্কিন-ইউরোপীয় সমর্থিত আসাদবিরোধী নেতাদের জনগণের মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব ছিল না। এমনকি তারা বিরোধীদের মধ্যে ঐক্য গঠনেও সমর্থ হয়নি। এরপর ২০১২ সালে সিরিয়ায় পাঠানো হয় দেড় হাজারেরও বেশি সিআইএ প্রশিক্ষিত মিলিশিয়া। ২০১৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়া যুদ্ধে প্রবেশ করে রাশিয়া।

মার্কিন সমর্থিত কোনো কোনো মিলিশিয়া গ্রুপ ইসলামিক স্টেট (আইএস) ও আল-কায়েদার মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হয় বলেও বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়। 

সিরিয়া হয়ে ওঠে বহু গ্রুপের যুদ্ধক্ষেত্র। যুক্তরাষ্ট্র বারবার অভিযোগ করেছে, রাশিয়া আইএস দমনের অজুহাতে তাদের সমর্থিত বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা করছে। অন্যদিকে রাশিয়াও অভিযোগ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে এমনভাবে ব্যবহার করছে যেন রুশ ও সিরীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়।

আসাদ মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। সিরিয়ায় রাশিয়ার একটি বিমান ঘাঁটি ও একটি নৌঘাঁটি রয়েছে। শান্তি আলোচনায় রাজি হলেও মধ্যপ্রাচ্যে নিজের সামরিক শক্তি অটুট রাখতে রাশিয়া আসাদকেই ক্ষমতায় রাখতে চায়। আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখাটা ক্রিমিয়া দখলের পর রাশিয়ার সবচেয়ে বড় জয় বলে মনে করা হচ্ছে। 

রাশিয়ার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানও সমর্থন করে আসাদকে। ২০১২ সাল থেকেই তেহরান আসাদ সরকারকে সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতা দিয়ে আসছে। সিরিয়ায় ইরানি সেনাবাহিনীর পাশাপাশি তাদের সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়ারাও রয়েছে। সেইসাথে রয়েছে ইরান সমর্থিত লেবাননের হিজবুল্লাহ। 

এর বিপরীতে, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের আসাদবিরোধী সক্রিয় ভূমিকাও রয়েছে। গত মাসেও ইসরায়েল আসাদপন্থী সেনাবাহিনীর ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে। সৌদি আরব একাধিক ওয়াহাবি ধারার ইসলামপন্থী গ্রুপকে সহায়তা দিয়ে থাকে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস তাদের দখল করা বিশাল এলাকার প্রায় সবটুকু নিয়ন্ত্রণই হারিয়েছে, যেখানে তারা কথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় কুর্দি যোদ্ধারা আইএসের রাজধানী হিসেবে পরিচিত রাকা থেকে তাদের বিতাড়িত করেছে। সিরিয়া যুদ্ধের ভেতরেই কুর্দিরা তুরস্ক সীমান্তে একটি নতুন ‘দেশ’ প্রতিষ্ঠা করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় কুর্দিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় তুরস্ক। সিরিয়া যুদ্ধে তুরস্কের মূল লক্ষ্য কুর্দিদের আটকে দেয়া। তাদের দাবি, সিরিয়ার কুর্দিরা পিকেকের কুর্দিদের সাথে যুক্ত। পিকেকে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে স্বাধীনতার জন্য তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করছে।

নতুন নিষেধাজ্ঞার ব্যাখ্যায় মার্কিন কর্মকর্তারা সিরিয়াকে কুয়াগমায়ার বা ‘কর্দমাক্ত জমি’ বলে উল্লেখ করছেন। এ কথাটি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। যে রাষ্ট্র তার জনগণকে অনাহার, রোগাক্রান্ত, দারিদ্র্য ও লুটেরা যুদ্ধবাজদের হাতে তুলে দেয়। কার্যত ট্রাম্প প্রশাসন এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সেই হতাশাপূর্ণ অবস্থাকে আরো বাস্তব করে তুলতে চাইছে। যদিও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে লক্ষ্য পূরণের উদাহরণ নিতান্তই নগণ্য। এমনকি নিষেধাজ্ঞার ফলে গণবিরোধী শাসকও জনগণের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন, যেখানে ওই শাসকরা নিজেদের ‘জনগণের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে জাহির করতে পারেন।

কার্যত সিরিয়ার পুনর্গঠনকে অসম্ভব করে তুলেছে ট্রাম্প প্রশাসনের এই নিষেধাজ্ঞা। অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও তেলক্ষেত্রকে লক্ষ্য করে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, যা সিরিয়াকে আবার নিজের পায়ে দাঁড় করাতে অপরিহার্য। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার তেল ক্ষেত্রগুলোর সুরক্ষা দিচ্ছে। অথচ সিরীয় বা অ-সিরীয় কোনো প্রতিষ্ঠানকেই ওই তেল ক্ষেত্র মেরামত করতে দিচ্ছে না। তেল সরবরাহ না থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। সেখানকার জনগণ দিনে মাত্র এক থেকে দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ পান। আবার মেরামত না হওয়ায় তেলক্ষেত্র থেকে অপরিশোধিত তেল গিয়ে পড়ছে খাবুর এবং ইউফ্রেটিস নদীতে। এ নিষেধাজ্ঞায় ট্রাম্প শুধু সিরীয় জনগণকে দুর্ভোগে ফেলছেন না, তাদের পরিবেশকেও বিষাক্ত করে তুলছেন। 

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, নতুন নিষেধাজ্ঞা সিরীয়দের মানবিক বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিচ্ছে। ২০১১ সালে যেখানে ১ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতেন, সেখানে ২০১৫ সালে তা পৌঁছায় ৩৫ শতাংশে। লেবাননের সাথে সিরিয়ার অর্থনীতি ভীষণভাবে যুক্ত। লেবানন দেউলিয়া হয়ে পড়ার পর সিরিয়ার অর্থনীতিও পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। খাবারের দাম বেড়েছে ২০৯ শতাংশ, একইভাবে ওষুধ ও চিকিৎসা ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। 

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্যমতে, চলতি বছরের ছয় মাসে খাদ্য নিরাপত্তার বাইরে থাকা মানুষের সংখ্যা ৭৯ লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ লাখে। সিরিয়ায় মানবিক সংকট নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই দেশটির সরকার ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। এ সরকার ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে অভিযোগ রয়েছে; কিন্তু একই কথা তো সৌদি রাজতন্ত্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সেখানে কোনো কাজ পেতে রাজন্যদের যে বিশেষ কমিশন দিতে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত রাষ্ট্রীয় দলিলেও সুস্পষ্টভাবে তার উল্লেখ রয়েছে। এ প্রশ্নে নিশ্চয় মার্কিন প্রশাসন কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে না!

ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, সিরিয়ায় তারা সরকার বদল করতে চায় না। অথচ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে জাতিসংঘের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এখনই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, নতুন সংবিধান ও গোত্রগত শাসনের বদলে অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এই সংস্কারের মানেই হলো ক্ষমতাসীন সরকারের বিদায়, তা বাশার আল-আসাদ ও তার মিত্ররা বেশ ভালোই জানেন। তাই এমন সংস্কারে তারা কখনোই রাজি হবেন না। 

অপরদিকে সিরিয়ায় এ মুহূর্তে আসাদ সরকারের বিদায় মানেই হলো- আরেকটি নতুন গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। ২০১১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র, তার মদদপুষ্ট বাহিনী ও আইএস সন্ত্রাসীরা সিরীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। গত ৯ বছরে আসাদ যে গোত্রের, সেই আলাওয়াতি গোত্রের লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়। যা আলাওয়াতিদের প্রতি ২৫ জনে একজন। এত মানুষ হত্যার পর সরকার পরিবর্তনের মানে যে আরো গণহত্যার পথ সুগম করা তা বলাই বাহুল্য। বহু দুর্বলতা ও লাখো মানুষের জীবনের বিনিময়ে হলেও এ কথা সত্য যে, আসাদ ও তার সমর্থকরা এ যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। 

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা যেমন আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারেনি, তেমনি এটি সিরীয়দের জন্য কোনো শান্তির বার্তাও বহন করে না। বরং এটি সিরীয়দের মানবিক বিপর্যয়ে ফেলার আরেকটি চেষ্টা। এই নিষেধাজ্ঞা সিরীয়দের প্রতি মার্কিন নিষ্ঠুরতার আরেকটি প্রতীক হয়ে রইল।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh