শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রাসঙ্গিকতা

গোপাল অধিকারী

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৬:৪৬ পিএম

মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। গত ১৬ মার্চ থেকে কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে আগামী ৩১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছুটি বর্ধিত করা হয়েছে। পরীক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি, দ্রুততম সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা আসবে।

আমরা দেখছি, প্রায় সকল সেক্টর করোনার কারণে লকডাউনের পর খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সঙ্গত কারণেই স্কুল, কলেজ বন্ধ রয়েছে। এতে স্বাভাবিক শিক্ষাগ্রহণে ছাত্রছাত্রীদের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে ভিন্নমত রয়েছে। তবে বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনায় আমাদের সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আমার বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে। 

প্রথমত, সব সেক্টর চালু রেখে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সব কিছুর একটি প্রধান উপাদান থাকে। করোনা নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায় সকল ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। এই অবস্থা ধরে রাখা প্রশাসনের কঠোরতা ছাড়া সম্ভব নয়। অথচ আমরা নিজেরাই এ বিষয়ে সচেতন নই। উল্টো দিকে প্রশাসনের লোকজন এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখতে গিয়ে নিজেরাই করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। শুরুর দিকে দীর্ঘদিন করোনার ব্যাপকতা কমাতে ঈশ্বরদী হাটে-বাজারে, পথে-প্রান্তরে হ্যান্ড মাইক নিয়ে প্রচার-প্রচারণা করেছেন উপজেলার সহকারী কমিশনার মমতাজ মহল। তাঁর সেই কর্মকাণ্ড বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো মানুষ সচেতন হয়নি। উল্টো মমতাজ মহল নিজেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এরপর থেকে তাঁকে আর অভিযানে দেখা যায়নি। চারপাশের চিত্র দেখে মনে হয় না করোনাভাইরাসের কোনো প্রভাব দেশে আছে। সবই চলছে আপন নিয়মে। তাহলে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রেখে লাভ কী?

দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনই খোলা না গেলে ঝরে যাবে প্রায় পাঁচগুণ শিক্ষার্থী। ফলে দেশে শিক্ষার হার হবে নিম্নগামী। ঝরে পড়া মেয়েদের অনেকের অপ্রাপ্ত বয়সেই বিয়ে হয়ে যাবে। তারা সচেতনতার অভাবে মরণফাঁদে পা দিতে বাধ্য হবে। ফলে অপ্রাপ্ত বয়সে মাতৃত্বকালীন বিভিন্ন বিপদে পড়বে তারা। দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক অভিভাবক সন্তানদের বাসায় নিয়মিত পড়াচ্ছেন না। অনেক ছাত্রছাত্রী পড়াশোনায় মনোযোগ হারিয়েছে। ফলে তারা পিছিয়ে পড়বে। কথায় বলে, দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকলে চকচকে লোহাতেও মরিচা ধরে। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও তাই হবে। বিশেষ করে প্রাইমারি স্কুলগুলোর শিক্ষার্থী বালক-বালিকাদের পড়ার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে হিমশিম খেতে হবে।

তৃতীয়ত, সিলেবাস সম্পূর্ণ না করলে সন্তান পিছিয়ে পড়বে অভিভাবক হিসেবে আমরা অনেকেই বিষয়টি ভাবছি না। এতে নিশ্চিতভাবেই তার মেধার ওপর প্রভাব পড়বে। শহর অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয়তো অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে, কিন্তু গ্রামে এখনও পুরোপুরি অনলাইন ক্লাস চালু হয়নি। সেক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

প্রধানত এই তিনটি কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা প্রাসঙ্গিক বলে আমার মত। তাছাড়াও বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় বিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিভিন্ন টিকাদান কর্মসূচিগুলো ব্যাহত হচ্ছে যা শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মানসম্মত শিক্ষার কথা বলি। আমাদের দেশের অগ্রগতি ও আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মানসম্মত শিক্ষা প্রয়োজন। আমাদের সমাজে যে অস্থিরতা চলছে, শিক্ষাও কিন্তু এর বাইরে নয়। দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি নাজুক হচ্ছে। সবাই মিলেই এই অস্থিরতা ও ধ্বংসের হাত থেকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হবে।

আমরা অনেকেই চিন্তা করি ভালো ফলই ভালো শিক্ষার্থীর একমাত্র শর্ত। কিন্তু না, পরীক্ষায় ভালো ফল না করেও ভালো কিছু করার নজির অনেক রয়েছে। আবার ভালো ফল করেও পরবর্তী সময়ে হারিয়ে যাওয়ার উদাহরণও কম নয়। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষা অর্জন করে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন পরিসংখ্যান আমার মনে হয় নেই। একটি বাড়ি নির্মাণ করতে গেলে আামাদের যেমন ভিত্তি মজবুত করতে হয়, তেমনি সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হলে আমাদের অবশ্যই আগে তাদের ভিত্তি মজবুত করতে হবে। তাদের সঠিক চর্চা করাতে হবে। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী নিজ থেকে বই পড়তে চায় না। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে সেই শিক্ষার্থী মূল বই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।

আমরা অনেকে ভাবছি, সন্তানের জীবন আগে, পড়ালেখা পরে। কথাটি ঠিক, কিন্তু আমি যদি কোনো নিয়ম-নীতি না মেনে করোনা জোনে বেপরোয়া চলাফেরা করে সন্তানকে ঘরে রাখতে চাই, তাহলে সেটা কতটুকু যৌক্তিক হবে? করোনা আসলে বড়দের বেপরোয়া চলাফেরায় হয়। সন্তান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এলে তারা কি বাইরে চলাফেরা করার সুযোগ পাবে? স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটাই হলো প্রধান। ইতোমধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউরোপের অনেকে দেশে স্কুল খুলেছে। ফলে আমাদেরও ভাবতে হবে।

তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে কিনা এ ব্যাপারে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। স্বাস্থ্য বিষয়ক নিদের্শনা বাস্তবায়নে কঠোর মনিটরিং করতে হবে। প্রয়োজনে যারা এগুলো মানবে না তাদের এমপিওভুক্তি বাতিল করা যেতে পারে। ইত্যাদি পদক্ষেপ নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন খুলে দেওয়াই যৌক্তিক হবে বলে মনে করি। 


লেখক: সাংবাদিক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh