করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান

নিজস্ব প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১০:০২ পিএম | আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১০:১১ পিএম

মহামারি করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে দেশে মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। করোনার থাবা কখন শেষ হবে সেটাও কেউ বলতে পারছে না। যেসব দেশ ভাইরাসটিকে ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে, তাদের মধ্যেও সংক্রমণ দ্বিতীয় দফায় ফিরে আসা নিয়ে ভীতি রয়েছে। আর মাস দুইয়ের মধ্যেই শীত আসছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এ সময়টায় ঠান্ডা লাগা বা ফ্লুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এ কারণে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে ঋতু পরিবর্তনের সময় করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাবে এবং বলা হচ্ছে, প্রথম দফায় সংক্রমণ যত ব্যাপক ছিলো- দ্বিতীয় দফায় তা আরো মারাত্মক হবে।

কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণ কেমন চেহারা নেবে- তার পূর্বাভাস দেয়া কি এত সহজ? মোটেও তা নয়। বরং ব্যাপারটা বেশ জটিল। শুধু করোনাভাইরাসের প্রকৃতি নয়, অন্য নানা রকম শীতকালীন রোগজীবাণু, মানুষের আচরণ, সরকারি নীতির সাফল্য-ব্যর্থতা– এরকম অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আসলেই আসবে কিনা।

এছাড়া বিজ্ঞানে এখন নতুন কিছু গবেষণা চলছে যাতে দেখা যায় যে একটি ভাইরাল সংক্রমণ হয়তো অন্য কোনো ভাইরাসের সংক্রমণকে আটকে দিতে পারে। তবে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব পড়বে কি না, তা এখনো অজানা।

বিজ্ঞানীরা বলেন, এমন হবার সম্ভাবনা আছে। তবে এটা বলা হচ্ছে অন্য ভাইরাস সম্পর্কে আমরা যা জানি তার ওপর ভিত্তি করে। করোনাভাইরাস আছে মোট চার রকমের- যা সাধারণ সর্দি-জ্বরের লক্ষণ সৃষ্টি করে। প্রতিটিই সহজে ছড়ায় শীতের সময়। ইনফ্লুয়েঞ্জা, রাইনোভাইরাস, এবং আরএসভি নামে আরেকটি ভাইরাসের সবগুলোরই আচরণ মোটামুটি একই রকম।

তবে লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এ্যান্ড ট্রপিক্যার মেডিসিনের ড. রেচেল লো বলেন, এগুলো হয়তো মৌসুমি হতে পারে, কারণ অন্য কিছু ভাইরাস আছে যেগুলো শীতকালে সংক্রমণ বাড়তে দেখা যায়– কিন্তু আবহাওয়া নাকি মানুষের আচরণ, কোনটার প্রভাব এখানে বেশি এখনো তা বোঝার ক্ষমতা খুব সীমিত।

তবে দেখা গেছে, মানবদেহের বাইরের পরিবেশ যখন ঠান্ডা- তখন সব ভাইরাসই অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের জন্য বিশেষ করে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিশেষ অনুকূল বলে দেখা গেছে।

সূর্যের আলোয় যে অতিবেগুনি রশ্মি থাকে তা ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। কিন্তু শীতের সময় অতিবেগুনি রশ্মির পরিমাণও কম থাকে। শীতপ্রধান দেশগুলোতে ঠাণ্ডার সময় লোকে ঘরের ভেতরেই বেশি থাকে। দরজা জানালা থাকে বন্ধ থাকে। বাতাস চলাচল করে কম। এবং এই পরিবেশই করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য সহায়ক।

গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরাস গবেষণা কেন্দ্রের ড. পাবলো মারসিয়া বলেন, একটি ভাইরাসের আক্রমণের ফলে মানবদেহে যে রোগ-প্রতিরোধী প্রতিক্রিয়া হয়– তা অন্য কিছু ভাইরাসকে অন্তত খানিকটা সময়ের জন্য ঠেকিয়ে রাখতে পারে। তবে অন্য কয়েকটি জরিপে আবার দেখা গেছে যে কিছু কিছু ভাইরাস বেশ ‘মিলেমিশে’ থাকতে পারে এবং পাশাপাশি বিস্তার ঘটাতে পারে।

বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসলে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। এ অবস্থায় বর্তমান অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়ার কথা জানিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মকর্তা ডা. জিয়াউদ্দিন হায়দার গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশের হেলথ ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম খুবই দুর্বল ও সেকেলের। ফলে আমরা জানি না ঠিক এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অবস্থান ঠিক কোথায়। আমরা প্রথম ঢেউয়ের কোন অবস্থানে আছি, দ্বিতীয় ঢেউ আসবে কিনা, আসলে সেটা কবে নাগাদ আসবে- এর কোনো কিছুই আমরা বিজ্ঞানসম্মত তথ্যের ভিত্তিতে জানি না৷ অনেকে অনেক মন্তব্য করে থাকেন, কিন্তু মন্তব্যগুলো শুধু নিজস্ব অনুমানের ভিত্তিতে করা, যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় প্রস্তুত- কথাটি বলতে পারছি না। জনগণকে করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক এখনো করা যায়নি, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ পরিষ্কার-পরিছন্ন থাকার বিষয়টি এখনো দেশের বেশির ভাগ মানুষ আমলে নিচ্ছেন না, করোনা শনাক্তকরণ এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং করার ক্ষেত্রে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য এখনো দেখা যাচ্ছে না।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত এক ওয়েবিনারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ প্রথম ওয়েভ নিয়ন্ত্রণ করার কাছাকাছিও নেই। যদি ধরে নিই, বাংলাদেশ সামনে প্রথম ওয়েভ নিয়ন্ত্রণ করবে। তাহলে দ্বিতীয় ওয়েভ এলে তিনটি সমস্যা দেখছি। ব্যবসায়ী, পোশাক ও পরিবহন সংগঠন নেতাদের কাছ থেকে বাধা আসবে। দীর্ঘ দিন তারা নানা বিধিনিষেধ মেনে চলেছে। সীমিত আকারে কিছু বিধিনিষেধ এখনো আছে। বহু লোক চাকরিচ্যুত হলো, ফল পেল কী? পরে গিয়ে আবারো একই ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করতে গেলে স্বাভাবিক কারণেই বাধা আসবে।

একদিনে গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ২৬ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যায় চীনকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত মারা যাওয়া ২৬ জনকে নিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে মৃতের মোট সংখ্যা ৪ হাজার ৭৫৯ জনে দাঁড়িয়েছে।

গতবছর ডিসেম্বরে যেখান থেকে এ ভাইরাস পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, সেই চীনে এ পর্যন্ত ৪ হাজার ৭৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সর্বশেষ এই তথ্য হালনাগাদের পর জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের টালিতে বিশ্বে বাংলাদেশ উঠে এসেছে ২৮তম স্থানে।

চীনে প্রাদুর্ভাবের তিন মাস পর বাংলাদেশে নতুন করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী ধরা পড়েছিল ৮ মার্চ, তার ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর খবর আসে। গত ৭ সেপ্টেম্বর সেই সংখ্যা সাড়ে চার হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে ৩০ জুন এক দিনেই ৬৪ জনের মৃত্যুর খবর জানানো হয়, যা এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু।

জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার বিশ্বে মোট মৃতের সংখ্যা ৯ লাখ ২৪ হাজার পেরিয়ে গেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কেবল ভারত ও পাকিস্তানে মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।
বৈশ্বিক তালিকায় তৃতীয় স্থানে থাকা ভারতে মোট মৃত্যু ৭৯ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, পাকিস্তানে মৃত্যু হয়েছে ৬ হাজারের বেশি মানুষের।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh