ইলিশ গেলো, কিন্তু পেঁয়াজ এলো না

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০১:১১ পিএম

হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ খবরে কেজিতে বেড়ে গেছে ১০ টাকা করে। এ খবরে আড়ৎগুলোতে পেঁয়াজের বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল সোমবার সকালে যে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে কেজিতে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা, সেই পেঁয়াজ বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজির দরে। মূলত খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা।

তবে পেঁয়াজ আসা কেন বন্ধ হলো এ বিষয়ে সকাল থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো কারণ কেউ বলতে পারেননি। দেরিতে হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের খবর জানিয়েছে ভারত। গতকাল সোমবার ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগ থেকে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হলো, বিদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। 

ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের মহাপরিচালক অমিত যাদব স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়,  ১৯৯২ সালের ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত সবধরনের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ থাকবে। তবে পেঁয়াজের কাঁটা টুকরা ও গুঁড়া এ নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে।

তবে শারদীয়া দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা হিসাবে বাংলাদেশের ইলিশের ট্রাক যখন বেনাপোল বন্দর দিয়ে (শুল্কমুক্ত) ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে পৌঁছে গেছে; তখন ভারত সরকার সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর, হিলি স্থলবন্দরসহ সব সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। একবছর আগে ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত হঠাৎ করে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশের মানুষকে চরম বিপাকে পড়তে হয়েছিলো। তখন মোদী সরকারের স্বার্থপরতার কারণে মিশর, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিমানে পেঁয়াজ আনতে হয়েছে। এর আগে যুগের পর যুগ ধরে তিস্তা চুক্তি ঝুলিয়ে রাখলেও হঠাৎ করে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে ফেনী নদীর পানি ত্রিপুরায় নিয়ে গেছে ভারত। রেল, নৌ, সড়ক ট্রানজিট এবং বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর ব্যবহারসহ নানামুখি সুবিধা নিয়েছে ভারত বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে। বিনিময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সব সময় করেছে প্রতারণা। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার পুরনো রেকর্ড বাজিয়ে বছরের পর বছর ধরেই বন্ধুত্বের নির্দশন স্বরুপ বাংলাদেশের সামনে সম্প্রীতি-সৌহাদ্বের ‘মুলা’ ঝুলিয়ে রেখেছে।

২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ইলিশ মাছ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পরবর্তীতে সব মাছ রফতানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলেও ইলিশের উপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে। তবে বাংলাদেশ সরকার একাধিকবার ভারত সরকারকে শুভেচ্ছা উপহার স্বরুপ ইলিশ মাছ দিয়েছে। গত বছর এই সময় দেওয়া হয়েছিল ৫০০ মেট্রিক টন।

এবার ভারতে শারদীয়া দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এক হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন ইলিশ বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এই খবর জানিয়ে বলেছে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য এই শুভেচ্ছা। বেনাপোল কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা আকছির উদ্দিন মোল্লা জানান, দুর্গাপ‚জা উপলক্ষে ভারতে রপ্তানির জন্য ১৪৫০ মেট্রিক টন ইলিশ অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার প্রথম চালানে ১২ মেট্রিক টন ইলিশ ভারতে গেছে। এবং ১০ অক্টোবরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে বাকি ইলিশ ভারতে পাঠানো হবে।

শুল্কমুক্ত সুবিধায় এই ইলিশ ভারতে রপ্তানি করা হয়েছে। এ ইলিশ ভারতে রপ্তানির জন্য বাংলাদেশি ৯টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পেয়েছেন। প্রথম দিনে জাহানাবাদ সি-ফুডস লিমিটেডের দুটি ট্রাকে ১২ মেট্রিক টন ইলিশ ভারতে গেছে। যার প্রতিকেজি ইলিশের রপ্তানি দাম ১০ ডলার। এবং প্রতিকেজি বাংলাদেশি মূল্য ৮৫০ টাকা। মাছ রপ্তানিকারক খুলনার জাহানাবাদ সি-ফুডস লিমিটেডের প্রতিনিধি নিলা ইন্টারন্যাশনালের মালিক মিহির ম‚খার্জি জানান, আগামী মাসের ১০ অক্টোবরের মধ্যে ১৪৫০ মেট্রিক টন ইলিশের সব চালান পাঠানোর নির্দেশনা রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। প্রথম চালানে দুটি ট্রাকে ১২ মেট্রিক টন ইলিশ ভারতে রপ্তানি হয়েছে।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি মফিজুর রহমান সজন জানান, প্রতিবেশি দেশ ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক বাড়াতে গতবছর দুর্গাপ‚জা উপলক্ষে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ৫০০ টন ইলিশ রপ্তানি করা হয়েছিল। এবারও ১৪৫০ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

এদিকে অতিবৃষ্টি ও বন্যায় সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেওয়ার অজুহাতে ভারত হঠাৎ করে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। হিলির কাস্টমস কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে সিএন্ডএফ এজেন্টরা এ তথ্য জানিয়েছেন।

কাষ্টমস কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে অতিবৃষ্টি ও বন্যা হওয়ায় ভারতের যেসব অঞ্চলে পেঁয়াজ উৎপাদন হতো সেখানে পেঁয়াজের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। যার কারণে পেঁয়াজের সরবরাহ কমায় ভারতের বাজারেই পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। এ অবস্থায় পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি রুখতে রফতানি বন্ধের খবর গতকাল সোমবার ভারত সরকার হিলি কাস্টমসকে জানিয়েছে।

কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সোমবার থেকে সব ধরনের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ থাকবে। এ সংক্রান্ত সরকারি প্রজ্ঞাপন এখনও জারি হয়নি, তবে অচিরেই জারি হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে পেঁয়াজ আমদানির জন্য যেসব এলসি খোলা রয়েছে এবং টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে সেগুলোর বিপরীতেও কোনও পেঁয়াজ রফতানি হবে না।

হিলি স্থলবন্দরের পেঁয়াজ আমদানিকারক সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, কিছুক্ষণ আগে ভারতীয় রফতানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্ট আমাদের জানিয়েছেন যে ভারত কোনও পেঁয়াজ রফতানি করবে না। ভারত সরকার কাস্টমসকে নিষেধ করেছে পেঁয়াজ রফতানি না করতে। আমরা তো এখন বিপাকের মধ্যে পড়ে গেছি। আমরা তাদের বলছি আমাদের যেসব এলসি খোলা রয়েছে সেগুলোর পেঁয়াজ রফতানির জন্য। আমাদের অনেক এলসির বিপরীতে অনেক ট্রাক মাল নিয়ে সড়কে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখন যদি তারা পেঁয়াজ না দেয় তাহলে আমাদের এই পেঁয়াজের কী অবস্থা হবে সেই চিন্তায় পড়েছি।

হিলির মতো সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে হঠাৎ পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। গতকাল সকাল থেকে ভারতীয় কোনো পেঁয়াজের ট্রাক ভোমরা স্থলবন্দরে প্রবেশ করছে না। ভোমরা স্থলবন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তা মহসিন হোসেন বলেন, পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের কোনো কারণ ভারত জানায়নি। লিখিতভাবে ভারতের ঘোজাডাঙা বন্দর কর্তৃপক্ষও কিছু জানায়নি। তবে শুনছি ভারত পেয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে।

ভোমরা স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম জানান, হঠাৎ পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। সকাল থেকেই কোনো পেঁয়াজের ট্রাক বন্দরে প্রবেশ করেনি। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে গেলে দাম নির্ধারণ করে দেয় ন্যাপেট নামে একটি সংস্থা। বর্তমানে এক টন পেঁয়াজের রেট চলছে ৩০০ ডলার। সেটি সম্ভবত বাড়িতে ৫০০ বা ৭০০ ডলার নির্ধারণ করবে। সে কারণে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh