আদিবাসীদের তীরে বিদ্ধ বিশেষজ্ঞের মৃত্যু নিয়ে রহস্য

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৩৮ পিএম

মোয়াসেস ক্যাম্পির পরিষ্কার মনে আছে ৯ সেপ্টেম্বরের ওই ঘটনা। বিশেষ করে তার কানে এখনো বাজছে সেই শব্দটা। ধপাস করে ভারি কিছু একটা মাটিতে পড়ে যাবার শব্দ। শব্দটা শুনেই ক্যাম্পি বুঝতে পেরেছিলেন যে ভয়াবহ একটা কিছু ঘটেছে।

ঘুরে তাকিয়ে তিনি দেখলেন, তার বস ব্রাজিলের আদিবাসী জনগোষ্ঠী সংক্রান্ত নামী বিশেষজ্ঞ রাইলি ফ্রান্সিসকাটো নিথর অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন, তার বুকে বিঁধে আছে একটি তীর। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাকে নিয়ে যাওয়া হলো একটি স্থানীয় হাসপাতালে- সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করা হলো।

তীরটি ছুঁড়েছিল ব্রাজিলের একটি আদিবাসী গোষ্ঠীর লোকেরা। সেরিংগুয়েইরাস নামে আমাজন অঞ্চলের একটি ছোট শহরের এক কৃষি ফার্মের কাছে তাদের দেখা গিয়েছিল। মাত্র ১৩ হাজার লোকের এই শহরটি রন্ডনিয়া প্রদেশে। আমাজনের উষ্ণমন্ডলীয় বনাঞ্চল ছড়িয়ে আছে যে ৯টি ব্রাজিলিয়ান রাজ্য জুড়ে- এটি তার একটি।

সেরিংগুয়েইরাস একটি প্রত্যন্ত জায়গা। সবচেয়ে কাছে যে বড় শহর পোর্তো ভেলিও- তা এখান থেকে ৫০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে।

এখানে আছে একটি আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত এলাকা যার নাম উরু-ইউ-ওয়াও-ওয়াও। এখানে মোট ৯টি উপজাতি বাস করে- এবং তার মধ্যে পাঁচটি গোষ্ঠী আছে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগবিহীন বলে। ব্রাজিলসহ দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে এখনো এমন অনেক জনগোষ্ঠী আছে।


ক্যাম্পি বলেন, এই সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগুলোর একটির ওপর নজর রাখছিলেন ফ্রান্সিসকাটো। তিনি কাজ করছিলেন ব্রাজিলের নৃগোষ্ঠীগুলোর জন্য সে সরকারি প্রতিষ্ঠান ফুনাই- তার জন্য। তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন একটি টাস্ক ফোর্সের যাদের কাজ এই জনগোষ্ঠীগুলোর ওপর নজর রাখা এবং তাদের সুরক্ষা দেয়া। আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর অধিকারের এক বড় প্রবক্তা ছিলেন ফ্রান্সিসকাটো। কিন্তু সে কথা তো আর এই জনগোষ্ঠী জানতো না।

ব্রাজিলে ৩০৫টিরও বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে যাদের সম্পর্কে মূলধারার সমাজ জানে। তারা ২৭৪টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে। অন্যদিকে বহির্বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং যোগাযোগহীন উপজাতির সংখ্যা ৫০ এরও বেশি।

সারা পৃথিবীতে এমন ১০০-রও বেশি জনগোষ্ঠী আছে। তার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি বাস করে আমাজন এলাকায়। এদের সাথে মূলধারার সমাজের সম্পর্ক শান্তিপূর্ণ নয়। তাদের জনসংখ্যা কত, তারা কী ভাষায় কথা বলে তার সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়।

যে গোষ্ঠীর লোকেরা রাইলি ফ্রান্সিসকাটোকে হত্যা করেছে তাদের সম্পর্কেও খুব কমই জানা যায়। তাদেরকে সরকারিভাবে কাউতারিও নদীর বিচ্ছিন্ন লোকেরা বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

যারা ফ্রান্সিসকাটোকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়েছিল তাদের হয়তো বাইরের বিশ্বের লোকদের সম্পর্কে প্রীতিকর অভিজ্ঞতা হয় নি।

ক্যাম্পি বলেন, এই লোকেরা সবসময়ই শিকারী, কাঠুরিয়া এবং কৃষকদের হাতে হয়রানির শিকার হয়। ফলে তাদের এটা জানার কথা নয় যে কে তাদের প্রতি হুমকি আর কে নয়। তারা আমাদের দেখে মনে করেছিল যে আমরা আক্রমণকারী। আমরা এ জন্য তাদের দোষ দিতে পারি না।ক্যাম্পি যা বলছেন তা অতিশয়োক্তি নয়।

আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন সারভাইভাল ইন্টারন্যাশনাল বলছে, আমাজন অঞ্চলে বনভূমি ধ্বংসের কারণে এরকম অনেক উপজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার ঝুঁকিতে রয়েছে। এদের সামনে একটা বড় ঝুঁকি তাদের আবাসস্থলে ঢুকে পড়া লোকজনের সাথে সংঘাত।

এর একটা দৃষ্টান্ত হচ্ছে- ম্যান অব দ্য হোল নামে একজন লোক- যাকে ১৯৯৬ সাল থেকেই মনে করা হয় এমন এক উপজাতির সর্বশেষ জীবিত সদস্য- যাদের সাথে বাইরের মানুষের কোন যোগাযোগ হয়নি। সে কোন ভাষায় কথা বলে তাও অজানা। তার এই নামের কারণ, সে বন্যপ্রাণী শিকারের জন্য এক বিশেষ কায়দায় গর্ত খুঁড়ে রাখতো।

আবাসভূমি ধ্বংস হবার ফলে তাদের খাদ্যের উৎস নষ্ট হওয়াটাও এসব উপজাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হবার আরেকটি কারণ। মাশকো-পিরো নামে একটি জনগোষ্ঠী ২০১৪ সালে তাদের এলাকা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। বাইরের লোকের কাছে তাদের প্রশ্ন ছিলো- যে বন্য শূকর তাদের প্রধান খাদ্য- সেই শূকর তারা কেন আর খুঁজে পাচ্ছে না?

সারভাইভাল ইন্টারন্যাশনালের সারা শেংকার বলছেন, আমাজনের এসব জনগোষ্ঠী এখন তাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।

মোয়াসেস ক্যাম্পি নিজেও ব্রাজিলের একটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক। তার নামের দ্বিতীয় অংশ ক্যাম্পি-ই তার উপজাতির নাম, এবং তিনি দীর্ঘকাল আগেই মূলধারার সাথে যুক্ত হয়ে গেছেন।

ফ্রান্সিসকাটোর মৃত্যু সম্পর্কে তিনি অনর্গল পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলছিলেন বিবিসির সাথে। যোগাযোগবিহীন উপজাতিগুলো ক্যাম্পির কাছেও এক রহস্য। কারণ বাস্তব জীবনে তিনি কখনো এরকম কাউকে দেখেননি। এমনকি তার বস ফ্রান্সিসকাটো তীরবিদ্ধ হয়ে মারা যাবার সময়ও নয়। জঙ্গলের ভেতর থেকে কে তীর ছুঁড়েছে- তা কেউ দেখতে পাননি।

১৯৮০ এর দশকের শেষ দিক থেকে ফুনাই একটা নীতি নেয় যে- বিচ্ছিন্ন এসব জনগোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ করা হবে না। ফুনাইয়ের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট সিডনি পোসুয়েলো বলেন, তাদের কাছাকাছি যাওয়াটা খুবই বিপজ্জনক। তার চেয়েও বড় কথা হলো, এই লোকেরা যেভাবে জীবনযাপন করছে তাতে আমাদের হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকারই নেই।


ব্রাজিলের এই নীতি পরিবর্তনের পেছনে পোসুয়েলোই প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে মনে করা হয়। ব্রাজিলে আইন করে বিচ্ছন্ন উপজাতিগুলোর সাথে যোগাযোগ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে

তিনি বলেন, এই আদিবাসীদের মধ্যে একটা সাধারণ সর্দি-জ্বর ছড়িয়ে পড়লেও তাদের অনেকে মারা যেতে পারে। কারণ এসব রোগ তাদের মধ্যে আগে ছড়ায়নি, তাই তাদের দেহে এটা প্রতিরোধের ক্ষমতাও নেই।

তিনি বলেন, ১৯৭৯ সালে তাদের সাথে এরকমই একটি পূর্বে-যোগাযোগ-হয়নি-এমন জনগোষ্ঠীর সাথে সাক্ষাত হয়েছিল। অনেক সাবধানতা নেয়া হলেও, তাদের সংস্পর্শে এসে ওই লোকদের মধ্যে রোগ সংক্রমণ ঘটে এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের কয়েকজনের মৃত্যু হয়।

তবে ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেয়ার বলসোনারো আমাজন থেকে বাণিজ্যিক সম্পদ আহরণের সমর্থক। এর মধ্যে আছে যোগাযোগবিহীন উপজাতিগুলোর বসতিস্থলগুলোও।

তিনি ক্ষমতাসীন হবার পর থেকে গ্রাম অঞ্চলগুলোতে আদিবাসীদের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা বেড়ে গেছে বলে দাবি করছে অধিকারকর্মীরা। আদিবাসীদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা দেয়ারও বিরোধিতা করছেন তারা।

রাইলি ফ্রান্সিসকাটো অধিকারকর্মী হিসেবে আদিবাসীদের সাথে স্থানীয় বসতিস্থাপনকারীদের বিরোধ মোকাবেলা করেছেন অনেকবার। কিন্তু সেই তিনিই যখন আদিবাসীদের নিক্ষিপ্ত তীরে মৃত্যুবরণ করলেন- এ ঘটনা সবাইকে মর্মাহত করেছে।

আইন অনুযায়ী বাইরের সমাজের সাথে যোগাযোগ কোন সম্প্রদায়ের লোকেদের এরকম হত্যাকাণ্ডের জন্য বিচারের সম্মুখীন করা যায় না।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh