আহমেদ শরীফ
প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:২৭ এএম
ওরুচ রইস নামে তুর্কি জরিপ জাহাজটি এখনো তুরস্কের আন্তালিয়া বন্দরেই আছে। ছবি: বিবিসি
১৮ সেপ্টেম্বর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান ঘোষণা দেন, গ্রিসের সাথে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাস আহরণকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনা প্রশমনে তুরস্ক আলোচনা করতে প্রস্তুত রয়েছে।
গত কয়েক মাস ধরেই ন্যাটোর দুই সদস্য ও প্রতিবেশী দেশ এ দ্বন্দ্বের কারণে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ঘনঘন সামরিক মহড়া চালিয়ে যাচ্ছে।
সাংবাদিকদের এরদোয়ান বলেন, বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো- দুই পক্ষ কি নিয়ে আলোচনা করবে ও কোন কাঠামোতে এই আলোচনা হবে। মধ্যস্ততাকারী দেশগুলোকে তুরস্ক জানিয়েছে, দুই দেশের মাঝে সুসম্পর্ক থাকলে আলোচনা হতে পারে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বা তৃতীয় কোনো দেশে এই আলোচনা হতে পারে।
আল জাজিরা জানায়, দুই দেশের মাঝে গত মাস থেকে উত্তেজনা শুরু হয়, যখন তুরস্ক তার সার্ভে জাহাজ ওরুচ রইসকে গ্রিক দ্বীপ কাস্তেলোরিতসোর কাছাকাছি সমুদ্রের বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে নৌবাহিনীর প্রহরায় পাঠায়। এক মাস সমুদ্রে কাজ করার পর গত ১৩ সেপ্টেম্বর জাহাজটি বন্দরে ফিরে যায় মেইনটেন্যান্স ও জ্বালানির জন্য।
এরদোয়ান বলেন, যদি ওরুচ রইসকে তুরস্ক বন্দরে ফেরত নিয়ে আসে, তাহলে নিশ্চয়ই এর একটা অর্থ রয়েছে। তুরস্ক চাইছে আলোচনাকে একটা সুযোগ দিতে। তবে জাহাজটির মিশন শেষ হয়ে গেছে, এমনটা বলা যাবে না।
এরদোয়ান এমন সময়ে এসব কথা বললেন, যখন তুর্কি ও গ্রিক সামরিক নেতারা ন্যাটোর মধ্যস্ততায় ব্রাসেলসে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। চেক রাজধানী প্রাগে গ্রিসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোস দেনদিয়াস বলেন, তুরস্ক তার উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড থামালে গ্রিস অবশ্যই তুরস্কের সাথে আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক। তবে তুরস্কের ড্রিলিং জাহাজ ‘ইয়াভুজ’ অক্টোবরের ১২ তারিখ পর্যন্ত সাইপ্রাসের অদূরে ড্রিলিং চালিয়ে যাবে, যদিও ইউরোপীয়রা এই কাজের ঘোর বিরোধী।
তুরস্ক কেনই বা শক্তি প্রদর্শনের পথে গেল এবং কেনই বা আবার আলোচনায় বসতে রাজি হলো?
তুরস্কের সাথে গ্রিসের এই দ্বন্দ্বে ফ্রান্স ইতিমধ্যেই গ্রিসের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান প্রেরণ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলোও তুরস্কের বিরুদ্ধে অবরোধের হুমকি দিচ্ছে। গ্রিসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেনদিয়াস বলেন, গ্রিস চাইছে তাদের ইইউর বন্ধুরা তুরস্কের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া যায়, সেটির খসরা তৈরি করুক, যা তুরস্কের জন্যে একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে- বেআইনি কাজ করলে কি ধরনের অবরোধ আসতে পারে।
অপরদিকে এরদোয়ান বলেন, তুরস্ককে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করতে ব্যর্থ হওয়ার পরই গ্রিস আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে। তুরস্কের ওপর সকল হুমকি বিফল হয়েছে।
গ্রিস জানায়, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী প্রতিটি দ্বীপের চারদিকের আঞ্চলিক সাগর ও ‘এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন’ গ্রিসের পাওনা। অপরদিকে তুরস্ক বলছে, গ্রিস ইউরোপীয় দেশগুলোকে দিয়ে তুরস্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের পাওনা সমুদ্রাঞ্চল থেকে বঞ্চিত করতে চাইছে। গ্রিসের অনেক দ্বীপ তুরস্কের উপকূলের একেবারে কাছে থাকায় গ্রিসের দাবি অনুসারে, উপকূলীয় বেশিরভাগ অঞ্চলই তুরস্কের অধীনে থাকছে না। এতে তুরস্ক ইজিয়ান সাগর ও ভূমধ্যসাগরে খনিজ আহরণ থেকেই শুধু বঞ্চিত হবে না, তাদের নৌবাহিনী ইজিয়ান সাগরে অপারেট করার ন্যূনতম অধিকারও হারাবে, যা কৌশলগত দিক থেকে তুরস্কের সক্ষমতাকে একবারেই সংকীর্ণ করে ফেলবে। এই পরিস্থিতি কি করে তৈরি হলো, তা বুঝতে হলে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বর্তমান গ্রিসের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে।
১৮৩২ সালে ইউরোপীয়দের সামরিক সহায়তায় গ্রিস অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে নতুন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। সেই সীমানায় উত্তর গ্রিসের থেসালি, এপিরাস, মেসিডোনিয়া ও থ্রেস অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ইজিয়ান সাগরের পূর্বদিকের বেশিরভাগ দ্বীপও সেই সীমানার মাঝে পড়েনি। ক্রিট ও সাইপ্রাসও ছিল না; দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জও ছিল না। বর্তমান তুরস্কের উপকূলে অবস্থিত থাসস, লিমনস, সামোথরাকি, লেসবস, চিয়স, সারা, সামোস, আর্মেনিসটিস দ্বীপগুলোও গ্রিসের ছিল না। এই সবগুলো দ্বীপই বর্তমান গ্রিস-তুরস্কের সমুদ্রসীমা নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৯৭ সালে স্থলযুদ্ধে গ্রিসের পরাজয় হলেও ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপে ক্রিট দ্বীপ অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে গ্রিসের সাথে যুক্ত হয়।
১৯১১-১২ সালে ইতালি পূর্ব ভূমধ্যসাগরে দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয়। ১৯৪৭ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শান্তি চুক্তি মোতাবেক দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জ গ্রিসকে দেয়া হয়।
বর্তমান গ্রিস তৈরিই হয়েছে ইউরোপীয়দের শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। এখন পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুর্কিরা সেই পথেই এগোতে চেষ্টা করছে; কিন্তু নিজেদের কাছ থেকে দখল করা দ্বীপগুলোকে তুর্কিরা শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফেরত পাওয়ার সাহস দেখাতে পারবে কি? গ্রিকরা তাদের স্বাধীনতা পেতে ইউরোপীয়দের ওপর নির্ভর করেছিল; তুরস্কের সাথে যেকোনো সম্ভাব্য যুদ্ধে গ্রিস তাদের সহায়তাই চাইবে। ইউরোপীয় মধ্যস্ততায় তুর্কিদের সাথে গ্রিসের আলোচনা শক্তি ব্যবহারের পথে বাধাগুলোকেই দেখিয়ে দেয়।
গ্রিস তৈরি হওয়ার পর সীমানা নির্ধারণের যে আইনগুলোকে তুরস্ক মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল, সেই আইন অমান্য করাটাই এখন জাতিরাষ্ট্র তুরস্কের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।