ওয়াসায় কী মধু!

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৪:১৫ পিএম

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে থাকা তাকসিম এ খান, যার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অনেক সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে এবং গত বছর যার দুর্নীতি ও অনিয়ম তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটিও গঠন করেছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। অথচ তাকে আরো তিন বছর ওয়াসার এমডি পদে রাখার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, গত ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা ওয়াসার বোর্ড সভায় সদস্য ওয়ালী উল্যাহ শিকদার বর্তমান এমডির মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, ‘তাকসিম এ খানের তেমন কোনো সফলতা নেই যাতে তাকে এ পদে নতুন করে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।’ ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ওয়াসার এমডি হওয়ার মতো আর কোনো যোগ্য লোক কি দেশে নেই? যার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ, সেই লোককেই কেন বারবার এই পদে রাখা হচ্ছে? তার ক্ষমতার উৎসই বা কী এবং কার প্রশ্রয়ে তিনি এভাবে বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থাকছেন?

রাষ্ট্রায়ত্ত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে নাগরিকদের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। চিকিৎসা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ যেসব সেবা নাগরিকদের প্রতিনিয়ত প্রয়োজন হয়, সেসব পেতে গিয়েই সবচেয়ে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হতে হয়। কারণ এসব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের একটি বড় অংশই অনিয়ম ও লুটপাটের সঙ্গে যুক্ত থাকে।

বিদ্যুতের মিটার রিডার, পানি ও গ্যাসের লাইনম্যান বা এরকম ছোটখাটো পদের কর্মচারীদের বিশাল বিত্তবৈভবের খবরও মাঝে-মধ্যে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। আবার জনগণের পয়সায় পরিচালিত এসব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের যে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষার সুযোগ রয়েছে, তাতে তাদের সেভাবে জবাবদিহির আওতায় আনা যায় না; চাকরি যাওয়া তো দূরে থাক। দু-একজনের শাস্তি হলেও তা প্রতিদিনকার অনিয়ম ও লুটপাটের বিপরীতে খুবই নগণ্য। যে কারণে বলা হয়, সরকারি চাকরি পাওয়া যতটা কঠিন, চাকরি যাওয়া তার চেয়ে বেশি কঠিন।

ওয়াসার এমডির প্রসঙ্গে আসা যাক। তাকসিম এ খান প্রথম নিয়োগ পান ২০০৯ সালের ১৩ অক্টোবর; কিন্তু তার সময়ে ওয়াসা বোর্ড নজিরবিহীন জালিয়াতি করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি জানতে পেরে ওয়াসা বোর্ডকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সতর্কও করেছিল। গত ২০ সেপ্টেম্বর দৈনিক দেশ রূপান্তরের একটি সংবাদে বলা হয়, নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত ও অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়, সে শর্তের কোনোটিই তাকসিম খানের ছিল না। বিজ্ঞপ্তিতে পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনে অথবা সিনিয়র পর্যায়ে সাধারণ প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ২০ বছরের আবশ্যিক অভিজ্ঞতা চাওয়া হলেও পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনে তার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। অভিযোগ রয়েছে, ওই সময়ের ওয়াসা বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাকসিমের সখ্য থাকায় মৌখিক পরীক্ষায় তাকে সর্বোচ্চ নম্বর দেয়া হয়।

২০১২ সালের ১৩ অক্টোবর তাকসিমকে এমডি হিসেবে আরেক দফায় এক বছরের দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই সময় ওয়াসার বিধিবদ্ধ আইনকে পাশ কাটিয়েই এক বছরের জন্য তাকসিম এ খানকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। এরপর আবারও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি এবং পরীক্ষা ছাড়াই তাকে পুনরায় নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১৭ সালের অক্টোবরে পঞ্চমবারের মতো এমডি পদে তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। আগামী ১৪ অক্টোবর শেষ হবে তার এ মেয়াদ। এবার তাকে ষষ্ঠবারের মতো নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।

প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো, ঠিকাদার নিয়োগে সিন্ডিকেট, ঘুষ লেনদেন, পদ সৃষ্টি করে পছন্দের লোককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, অপছন্দের লোককে ওএসডি করাসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে। গত বছর ওয়াসার ১১টি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত চিহ্নিত করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এমনকি হাইকোর্টও এক আদেশে বলেছেন, ‘ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান ইচ্ছাকৃতভাবে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণ বন্ধে হাইকোর্টের দেয়া রায় প্রতিপালন করছেন না।’ সুতরাং যাকে নিয়ে এত আলোচনা ও বিতর্ক; খোদ হাইকোর্টও যার ব্যাপারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন; তাকেই কেন ষষ্ঠবারের মতো ওয়াসার এমডি হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে? তার খুঁটির জোর কোথায়? সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী যেখানে বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলেন, সেখানে বিধি ভেঙে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে বারবার সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন- এরকম একজন ব্যক্তিকে ঢাকা ওয়াসার মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগের ঘটনাটি সাংঘর্ষিক কি না- সেটিই বরং প্রশ্ন।

দ্বিতীয়ত, নিয়ম অনুযায়ী এই পদে নিয়োগের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছিল কি না, কারা আবেদন করেছিলেন, কেন তারা যোগ্য বিবেচিত হলেন না বা কেন বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকই একমাত্র উপযুক্ত প্রার্থী, কেন সংশ্লিষ্ট বিধি অবমাননা করে মেয়াদ শেষের পর একই ব্যক্তিকে নবায়ন দান অপরিহার্য- এসব প্রশ্নের উত্তরও জানা প্রয়োজন। 

কেন প্রতিবার তার নিয়োগ নবায়নের ক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে আইন ও নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছে; তিনি কোন কোন ব্যক্তিকে খুশি রেখে নিজের চেয়ারটি প্রায় স্থায়ী করে ফেললেন, সেসব প্রশ্নের মীমাংসা কোনোদিন কি হবে? শুধু ওয়াসা নয়, জনগণের করের পয়সায় পরিচালিত রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে যেসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও হয়রানির অভিযোগ রয়েছে, তারও কি যৌক্তিক সুরাহা কোনোদিন হবে? জনগণের পয়সায় পরিচালিত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কি আদৌ কখনো জনবান্ধব হবে?

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh