আমাদের একটি স্ববিরোধিতা হলো, আমরা কথায় কথায় আইনের শাসনের কথা বলি। আবার অপরাধীদের বিচারে ক্রসফায়ার বা বিনা বিচারে হত্যাকেও সমর্থন জানাই। বিশেষ করে ধর্ষণ বা এরকম চাঞ্চল্যকর কোনো ঘটনা ঘটলে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি ওঠে। কেউ কেউ অপরাধীকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া বা ক্রসফায়ারে হত্যার দাবি জানান। অথচ বিনা বিচারে হত্যা আইনের শাসনের পরিপন্থি এবং প্রকাশ্যে কাউকে ফাঁসি দেয়া বাংলাদেশের প্রচলিত আইনও অনুমোদন করে না। কিন্তু তারপরও মানুষ অপরাধের বিচারে এ জাতীয় শাস্তির দাবি জানায়। কারণ তারা মনে করে, এগুলো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
প্রশ্ন হলো, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বলতে আসলে কী বোঝায় এবং এ ধরনের শাস্তি সমাজ থেকে অপরাধ দূর করে কি না? সম্প্রতি পরপর কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় হলে বিভিন্ন ফোরাম থেকে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবি ওঠে। সেই দাবির মুখে সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধনী আনে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পরদিন ১৩ অক্টোবর অধ্যাদেশ জারি করেন রাষ্ট্রপতি। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড করায় এই অপরাধ কমে আসবে বলে তার বিশ্বাস।
যারা ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড হলে এই অপরাধ কমবে বলে মনে করেন, তাদের একটি বড় যুক্তি হলো এসিড সন্ত্রাস কমে যাওয়া। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসিড সন্ত্রাস কি শুধু অপরাধীর বিচারে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করার কারণে কমেছে, নাকি সরকারের আন্তরিক পদক্ষেপ (যেমন- এসিড দুর্লভ করে ফেলা) এবং বিপুল সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রচারাভিযানও এখানে বড় ভূমিকা রেখেছে?
২০০২ সালে এসিড সন্ত্রাস বন্ধে দুইটি আইন করা হয়। এসিডের উৎপাদন, ব্যবহার, আমদানি, বিক্রয় বা মজুদ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য করা হয় এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন এবং এসিড অপরাধ দমন আইন—যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয় মৃত্যুদণ্ড।
কিন্তু শুধু আইনের কঠোরতাই নয়, বরং বছরের পর বছর ধরে দেশে এসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলন হয়েছে। গণমাধ্যমে ব্যাপর প্রচার চলেছে। দেশি-বিদেশি সহযোগিতায় একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এসিড-সহিংসতা রোধ, এসিড নিক্ষেপের শিকার নারীদের চিকিৎসা-পুনর্বাসন ও এসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করেছে।
কিন্তু এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বড় ভূমিকা রেখেছে যে প্রথম আলো, গত বছরের ২৪ জানুয়ারি তাদের একটি প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, এসিড-সন্ত্রাসের মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় অধিকাংশ আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাতে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্র ৯ শতাংশ মামলায় অভিযুক্তদের সাজা হয়েছে। এর বড় কারণ, এসিড-সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে আসায় এখন পুরনো মামলাগুলোর প্রতি প্রশাসনের সক্রিয় নজরদারি নেই। মামলা তদারকির জন্য গঠিত জাতীয় এসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের তিন মাস পরপর বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও গত তিন বছরে একটি সভাও হয়নি। এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) তথ্য বলছে, গত ১৯ বছরে প্রায় দেড় হাজার নারী ও শিশু এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হলেও সাজা হয়েছে মাত্র ৩৪৩ জনের।
সুতরাং, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে আইন সংশোধনের ফলে সরকার সমাজের কিছু মানুষের বাহবা পেয়েছে এবং এই দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনও থেমে যাবে, কিন্তু এই আইনেরও পরিণতি হতে পারে এসিড মামলার মতো। শক্ত তথ্য-প্রমাণ না থাকায় বা পুলিশের দুর্বল তদন্ত প্রতিবেদনের কারণে আসামি হয় ছাড়া পেয়ে যাবে অথবা কম সাজা পাবে। বিশেষ করে যেসব অপরাধীর সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং প্রভাবশালীদের সংশ্লিষ্টতা থাকবে; যেসব মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হবে বা মোটা অঙ্কের ঘুষ খাবে; যেসব ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব বেশি তোলপাড় হবে না বা ভিডিও থাকবে না—সেসব মামলার আসামিরা ধর্ষণ করলেও আদালতে তাদের অপরাধ প্রমাণ করা যাবে না। আর ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করতে না পারলে আদালত নিশ্চয়ই কারো চেহারা দেখে বা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিক্রিয়া দেখে শাস্তি দেবেন না। দিতে পারবেন না।
তাছাড়া কেবল মৃত্যুদণ্ডের বিধানের ফলেই যদি এসিড সন্ত্রাস কমে গিয়ে থাকে, তাহলে দেশে কোনো খুন-খারাবি হওয়ার কথা নয়। কারণ খুনেরও সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। দ্বিতীয়ত, বছরের পর বছর ধরে বহু অপরাধীকে ক্রসফয়ার বা বন্দুকযুদ্ধের মোড়কে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে। প্রথমত কথা হচ্ছে, যাদেরকে এভাবে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে তারা সবাই অপরাধী নন। দ্বিতীয়ত, অনেক অপরাধীকে এভাবে বিনা বিচারে মেরে ফেলার কারণে সমাজ থেকে অপরাধ দূর হয়ে গেছে, এমন দাবিও কেউ করতে পারবেন না।
মূলত তারাই অপরাধে জড়ায় যারা মনে করে অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে। পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ নামে এক দর্জি দোকানিকে যে তরুণরা প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছিল, তারা জানতো এই ঘটনা কারও না কারও ক্যামেরায় বন্দি হবেই। বুয়েটের যে শিক্ষার্থীরা তাদের সহপাঠীকে পিটিয়ে হত্যা করলো, তারাও কি জানতো না কোথাও না কোথাও সিসি ক্যামেরায় তাদের গতিবিধি রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে? কিন্তু তাদের মনে এই বিশ্বাস ছিল, তাদের কিছুই হবে না। কারণ তারা ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে আছে। যুগে যুগে ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষেরাই অপরাধে জড়ায়। সুতরাং সমাজকে অপরাধমুক্ত করতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির চেয়েও বেশি জরুরি ক্ষমতার এই বলয় বা বৃত্তকে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করা। সেটি খুব সহজ কাজ নয়।
সুতরাং ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে বলেই কাল থেকে ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটি ভাবলে আমরা বোকার স্বর্গে রয়েছি। কারণ কেউ যখন ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িত হয়, তার মাথায় আইনের বিধিবিধান থাকে না। থাকলে মানুষ খুন করতো না। অন্য কোনো অপরাধে জড়াতো না। কারণ অপরাধী যখন কোনো অপরাধ করে, তখন সে এক ধরনের ঘোরের মধ্যে থাকে। তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। যুক্তি, নীতি-নৈতিকতা, সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা—ইত্যাদি বিষয়গুলো তার মন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ একজন মানুষ যখন সর্বোচ্চ সচেতন থাকেন, তখন তার পক্ষে ধর্ষণ করা সম্ভব নয়।
অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়ার মতো সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু রেখে মৃত্যুদণ্ড তো দূরে থাক, প্রকাশ্যে ফাঁসির বিধান করেও ধর্ষণ পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। কারণ ধর্ষণ শুধু একটি শারীরিক ক্রিয়া নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িত পুরুষের ক্ষমতা প্রদর্শনের চিরায়ত প্রবণতা। যে ক্ষমতা অনেকখানি বাড়িয়ে দেয় তার রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিপত্তি। অর্থবিত্তে প্রভাবশালী বহু লোক ধর্ষণ বা জোর করে কোনো নারীর সাথে ‘সঙ্গম’ করেন; কিন্তু সেই প্রভাবশালীরা সেসব ঘটনা যাতে জানাজানি না হয়, সেজন্য নানাভাবে বিষয়গুলো ম্যানেজ করেন। ধামাচাপা দেন। ফলে ধর্ষণের যেসব ঘটনা জানাজানি হয় বা আলোতে আসে, প্রকৃত ঘটনার তুলনায় তা আসলে কত শতাংশ, তা জানা খুবই কঠিন। অতএব কত শতাংশ নারী ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো প্রভাবশালী পুরুষের সাথে বিছানায় যেতে বাধ্য হন কিংবা ধর্ষণের শিকার হয়েও তা চেপে যান, সেই পরিসংখ্যান জানা অসম্ভব। অতএব জানা বা দৃশ্যের বাইরে থাকা এসব ধর্ষণের সাথে যুক্ত প্রভাবশালী পুরুষদের কোন আইনে ফাঁসি দেবেন হে রাষ্ট্র?