সম্রাটের সাম্রাজ্য থেকে আধুনিক এম্পায়ার

গৌতম দাস

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২০, ০৯:০৬ পিএম | আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২০, ০৭:৫৬ পিএম

কিছু ধারণা আছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যার অর্থ বদলায় বা আরও বিকশিত হয়, সমৃদ্ধ হয় বা আরও বেশি প্রসঙ্গ ধারণ করে। বিকশিত এই অর্থে যে, এর অর্থ আরও নানান দিকে মোড় নেয় বা আরও বৃহত্তর বিষয় কাভার করে থাকে। অর্থাৎ যেসব কনসেপ্টকে ‘ডেভেলপিং কনসেপ্ট’ বলা হয়। এম্পায়ার সে ধরনের একটি কনসেপ্টও বটে।

রাজা আর সম্রাটের ভেদ
প্রথমে ভেদ করে নেওয়া যাক- রাজা আর সম্রাটের মধ্যে মূল পার্থক্য কী? মোটা দাগে রাজা হয় ছোট ভূখণ্ড এলাকার আর সম্রাট হলো বৃহত্তর এলাকার। এটিই সবাই অনুমান করেন। নিজের দেশ ছাড়িয়ে, নতুন যে ভূখণ্ড দখল বা কলোনি করা হয়েছে সেসব এলাকারও সম্রাট তিনি- এমনটা ধরে নেওয়া হয়। হ্যাঁ, কথা ঠিক। তবে কোথাও এর ব্যতিক্রমও দেখা পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া আরেকটি দিক আছে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ধরন প্রসঙ্গে। যেমন- রাজার ভূখণ্ডে বসবাসকারীরা সাধারণত একই ধরনের জনগোষ্ঠী হয়ে থাকে। একই ধরনের বলতে- তারা রেসিয়াল (Racial) বৈশিষ্ট্য বা এথনিক (Ethnic) বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সবাই একই উৎসের হয়ে থাকে।

এখানে রেসিয়াল বৈশিষ্ট্য বলতে বোঝায়- তাদের গায়ের রঙ বা চুলের রঙের মিল; নাক বা দাঁত ইত্যাদির গড়ন সব একই রকম। সেই আদিকাল থেকে আজও একই রকম থাকা জনগোষ্ঠীকে ‘রেসিয়াল জনগোষ্ঠী’ বলে আমরা বুঝে থাকি। একইভাবে এথনিক বৈশিষ্ট্য বলতে বোঝায়- তাদের ভাষা, কালচার বা ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি একই রকম। এমন জনগোষ্ঠীকে ‘এথনিক জনগোষ্ঠী’ বলে।

ইংরেজি রেস আর এথনিক এ দুটিকেই আমরা বাংলা করি এক শব্দে ‘জাতি’ বলে। তবে ধারণায় মূল ফারাকটা হলো- জন্মের আগে থেকেই যা নির্ধারিত অথবা মানুষের যেসব বৈশিষ্ট্যগুলো জন্মগতভাবে নির্ধারিত, তা-ই রেস (Race) বৈশিষ্ট্য। যেমন বাঙালির গায়ের রঙ বাদামি বা কালো, এটি আমাদের নির্ধারিত রেস বৈশিষ্ট্য। অপরদিকে এথনিক বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা জন্মানোর পর সামাজিক সাংস্কৃতিক বা ভূখণ্ডগতভাবে অর্জন করেছি। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো- বড় কোনো বদল না ঘটিয়ে আমরা এখনো সে বৈশিষ্ট্যে রয়ে গেছি। যেমন- আমাদের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, ধর্ম, সংস্কৃতি ইত্যাদি এথনিক বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ।

রাজার রাজত্বে সাধারণত দেখা যায় একই ‘রেস’ ও একই ‘এথনিক’ বৈশিষ্ট্যের লোকজন বসবাস করেন। এখানে রেস আর এথনিক শব্দ দুটির ইংরেজিটাই রেখে দেওয়া হয়েছে। কারণ বাংলায় ‘রেস’ বলতেও ‘জাতি’, আবার ‘এথনিক’ বলতেও সাধারণত ‘জাতি’ শব্দই ব্যবহার করা হয়। তেমনি সম্রাটের সাম্রাজ্যের বলায় দেখা যায়- একাধিক বা কয়েকটি রেসিয়াল ও এথনিক জনগোষ্ঠীর বাসিন্দা। অর্থাৎ, একই ভূখণ্ডে একাধিক বা কয়েক ধরনের জনগোষ্ঠীর বসবাস দেখতে পেতে হলে তা সম্রাটের ভূখণ্ড, বা কোনো সাম্রাজ্যের ভেতরেই সাধারণত দেখতে পাওয়া যায়।

আবার একই ভূখণ্ডে এথনিক দিক থেকে ভিন্ন দুই জনগোষ্ঠীর দেখা পেতে হলে তা অবশ্যই কিছু বিশেষ শর্ত পূরণ করতে হয়। সেটি হলো- অনেক বড় ভূখণ্ড হতে হয়। এথনিক ভিন্নতা, যেমন- একই বৃহত্তর অর্থে বাংলা ভাষার মধ্যেও উচ্চারণে ভিন্নতা, এমনকি কয়েকটি শব্দ একেবারেই আলাদা ও নতুন; এমনটি হলো- একই এথনিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সূক্ষ্ম এথনিক ভিন্নতার উদাহরণ। এমন একাধিক এথনিক ভিন্নতার মানুষের দেখা পেতে হলেও তাদের অনেক বড় ভূখণ্ডের বাসিন্দা হতে হয়। যা আজকের বাস্তবতায় বাংলাদেশের বেলায় কমপক্ষে তিনটি জেলাজুড়ে এমন ভূখণ্ড হতে হবে। যেমন- রংপুর-দিনাজপুরের বাসিন্দারা বৃহত্তর অর্থে একই বাঙালি জনগোষ্ঠী ও মুসলমান হলেও তারা আবার বগুড়ার বাসিন্দাদের থেকে এথনিকভাবে ভাষা উচ্চারণে ভিন্ন! এ ছাড়া খাদ্যাভ্যাসেও ভিন্নতা পাওয়া যাবে। বিশেষ করে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, বা রান্নার ক্ষেত্রে বড় ভিন্নতা আমরা দেখতে পাই।

আবার বাংলাদেশে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত আমরা সবাই একই রেস বা বাঙালি এবং মোটা দাগে একই এথিনিক জনগোষ্ঠীরও বাসিন্দা আমরা। যদিও সূক্ষ্ম এথনিক বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যও আছে। সম্ভবত আমাদের রেস ও এথনিক মিল অনেক বেশি বলেই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে কোনো একটি সম্রাটের কথা জানা যায় না; বরং সবই রাজা। অনেক রাজার কথা জানা যায়। এমনকি আজকের হিসাবে একই জেলা শহরে একাধিক রাজা ছিল এমন কথাও জানা যায়।

এর বিপরীতে ভারতের বেলায় তার দক্ষিণ আর উত্তরের জনগোষ্ঠী চোখে পড়ার মতো আলাদা। সবাই ভারতীয়, এমন একটি বৃহত্তর রেসের কথা বলা যায় যদিও। এখনকার পাকিস্তানের দুর্গম উত্তর থেকে দক্ষিণে ভারতের কন্যাকুমারী পর্যন্ত একই কথা বলা হয় বটে; কিন্তু ভারতের দক্ষিণের আসল ফারাক শুরু হয় দাক্ষিণাত্য থেকে। উত্তর থেকে দক্ষিণে, নিঃসন্দেহে এথনিক দিক দিয়ে তো বটেই, রেসের দিক থেকেও আলাদা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়া ভাষার ক্ষেত্রে বিরাট এথনিক ভিন্নতা দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি তাদের দেব-দেবী উত্তর ভারতের দেব-দেবীর চেয়ে একেবারেই আলাদা।

ট্রাইব বা গোত্র
রাজার রাজত্ব বা সম্রাটের সাম্রাজ্য নিয়ে আলাপের ভেতরে ট্রাইবের আলোচনা থাকতে হবে কোথাও। আসলে সাধারণত ট্রাইব থাকে বাইরে। ট্রাইবাল সমাজগুলো সাধারণত রাজার রাজত্ব বা সম্রাটের সাম্রাজ্য গঠন হওয়ারও আগের বিশেষ সমাজ। এই ব্যাপারটা খানিক উল্টেপাল্টে দেখা যাক। রাজা-সম্রাটের আলোচনায় ট্রাইব কোথায় রাখব, তা বুঝতে আরেক গুরুত্বপূর্ণ দাবি হলো- ট্রাইব আমাদের এখনকার সমাজেরও আগেকার যে আরেক সমাজ ছিল তার বিষয়। বর্তমান সমাজেরও আগের সমাজ মানে কী?

আসলে আমরা এখন সমাজ বলতে যা চিনি ও বুঝি বা যাতে অভ্যস্ত, যা ব্যক্তি বা ইন্ডিভিজুয়ালের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়ানো- আমরা সমাজ বলতে এই ব্যক্তিভিত্তিক সমাজের কথাই বলি ও বুঝি। এ কথার মানে কী? এর মানে হলো- আগে এমন এক সমাজ ছিল, যেখানে ব্যক্তি, ব্যক্তিবোধ ইন্ডিভিজুয়ালিজম বলে কিছু ছিল না। হ্যাঁ, গোত্র সমাজে ব্যক্তি নেই, থাকে না। তাহলে কী থাকে? গোত্র প্রধান থাকে, তিনি পুরো গোত্রকে প্রতিনিধিত্ব করেন। গোত্র প্রধান দেখতে ব্যক্তি মনে হলেও তিনি গোত্রের সবার পক্ষ থেকেই কেবল ব্যক্তি। যেমন তিনি কেবল নিজের অর্থে স্বাধীন কেউ নন। তিনিও গোত্রের বন্ধনে ও ভেতরে অ-স্বাধীন; মানে- সামগ্রিক গোত্রের অধীনে আবদ্ধ। তিনি ব্যক্তি না, পুরো গোত্রের হয়ে তাদের ভালো-মন্দের সিদ্ধান্ত নেন। তাই তিনি যা বলেন, সেটিই সবার সিদ্ধান্ত। ওই সমাজের সব সম্পদও তাই গোত্র মালিকানার, ব্যক্তির নয়।

গোত্র সমাজে যেহেতু ব্যক্তিবোধ অনুভব নেই, তাই ব্যক্তিগত ভালোবাসা বা পছন্দ করা বলতে সেখানে কিছু বিরাজ করে না। গোত্র প্রধান যাকে যার সঙ্গে বিয়ে করতে বলবে, সেটিই শেষ কথা। ‘আমি অমুককে ভালোবাসি’- ধরনের কোনো ভাব বা অনুভূতির কদর বা আমল নেই সেখানে।

এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো- পুরনো রাজা বা সম্রাট শাসিত এমনকি ট্রাইবাল সমাজের কথা আমরা যা বলছি, তা এখন এ কালে আর কোথাও প্রচলিত বা চালু নেই বললেই চলে। যদিও ব্যতিক্রম হিসাবে কোথাও রাজা-বাদশাহর রাষ্ট্র অথবা আমাদের মনিপুরি বা পাহাড়িদের মতো ভেঙে পড়া গোত্র সমাজ এখনো আছে; কিন্তু এখানে যে বর্ণনা দেওয়া হলো, এখনকার বাস্তবে তার হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই এ কথাগুলো আইডিয়াল অর্থে নিতে হবে- একটি ট্রাইবাল সমাজ কী ও কেমন অথবা কেন এমন থাকার কথা।

পুরনো দিনের রীতি-রেওয়াজ বা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। যেমন- ট্রাইবাল সমাজের ক্ষেত্রে তা ভেঙে পড়ার মূল কারণ হলো- তারা এখন বৃহত্তর অর্থে কোনো এক আধুনিক রাষ্ট্রের অন্তর্গত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- গোত্র প্রথা হিসেবে গড়ে ওঠা এখানকার ট্রাইবাল সমাজ বহু আগেই, অন্তত ১৯৪৭ সালের পর থেকেই আধুনিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের অংশ ও অন্তর্গত সমাজ হয়ে গেছে। অনেক সময় পুরনো মূল গোত্র সমাজ কোনো নতুন আধুনিক রাষ্ট্রের অংশ ও অন্তর্গত সমাজ হয়ত হয় না; কিন্তু চারপাশের সবাই আধুনিক রাষ্ট্র তৈরি করে ফেলেছে, এমন হয়ে যায়। মূল কথা হলো- পুরনো রাজার সমাজ বা কোনো ট্রাইবাল সমাজ যতই পড়শি আধুনিক রাষ্ট্রের মানুষের সঙ্গে পণ্য বিনিময়, বেচাকেনা, লেনদেন বাড়াবে এবং বাড়াতে সে বাধ্য হবে; ততই তার পুরনো সমাজ ও এর নিয়ম-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। তাহলে কী পড়শি আধুনিক সমাজ-রাষ্ট্রই সব দোষের ভাগীদার? না, তা একেবারেই না। আসলে তাদের পুরনো সমাজই নিজে নিজে টিকতে পারছিল না। ওই সমাজ কেবল তাদের মধ্যে পণ্য বিনিময়, বেচাকেনা করে টিকে থাকতে পারছিল না। আর সে তুলনায় বাইরের সমাজের হাট-বাজারে লেনদেন করলে তা লাভজনকই শুধু নয়, এতে তাদের আয়-রোজগারও বেশি হওয়ার কারণ হয়ে হাজির হয়েছিল।

আমাদের পাহাড়িরা তাদের নিজেদের সমাজের মধ্যে লেনদেনের চেয়ে বাইরের বাঙালি সমাজ, যা তাদের চেয়ে কয়েকগুণ বড় চাহিদার এক সমাজ- পাহাড়ি দশ-বারো লাখ বাসিন্দার জন্য বাইরের ১৬ কোটির বাঙালির সমাজের চাহিদা- এই বাজার ধরতে পাহাড়িরা ট্রাইবাল সমাজ ভেঙে বেরিয়ে আসবেই।

এ ক্ষেত্রে মূল পরিবর্তন কী কী হবে? যেমন পড়শি বাঙালি সমাজের সঙ্গে পণ্য লেনদেনে যা-ই হবে, সেটি না হয় অর্থনৈতিক প্রভাব; কিন্তু আসল পরিবর্তন হবে- আধুনিক সমাজের ব্যক্তিবোধ অনুভূতি ও ব্যক্তি মালিকানাভিত্তিক সমাজের প্রভাব ট্রাইবাল সমাজকে আর ট্রাইবাল থাকতেই দেবে না। তাদের সমাজের অভ্যন্তরীণ বন্ধন দুর্বল হয়ে ক্রমশ তা ব্যক্তিভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত হতে শুরু করবেই। সেটি ইতিমধ্যেই প্রবলভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে গেছে। মনিপুরি বা চাকমা সমাজের অনেকে আধুনিক শিক্ষায় বাঙালিদের কাছাকাছি হয়ে গেছেন। তারা এখন শহুরে মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী হয়ে সারা বাংলাদেশে না হলেও রাজধানী ও বড় শহরগুলোতে বসবাস করছেন। অর্থাৎ, তারা এখন মূলত ব্যক্তিভিত্তিক সমাজে ঢুকে গেছেন। যদিও তাদের গ্রামগুলোতে পুরনো ট্রাইবাল সমাজের জরুরি বা অবশেষগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে হলেও টিকে আছে। তাই এই অর্থে এক মিশ্র-অবস্থায় আমরা পুরনো যে কোনো গোত্রসমাজকে দেখতে পাব।
 
এখনকার দুনিয়া হলো- জাতিসংঘের সদস্য ভিত্তিতে প্রায় ১৯৩ রাষ্ট্রের দুনিয়া। যার মধ্যে রাজা-বাদশাহর রাষ্ট্রগুলোও আছে। ফলে ব্যবহারিকভাবে বাদশাহ বা খলিফাদের দেশেও ব্যক্তি নাগরিক অধিকার বলে ধারণা প্রবল হচ্ছে, পরিচালিত হচ্ছে। রাজা-বাদশাহদেরও তা মেনে নিতে হচ্ছে। যদিও আইনত রাজার দেশে নাগরিক অধিকার আবার কী? ব্যক্তি নাগরিক বলেই যেখানে কেউ নেই, স্বীকৃতি নেই! তবু সৌদি ধরনের সমাজগুলো ভাঙছে, দ্রুত রূপান্তরিত হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে সৌদি আরব তেল বিক্রিভিত্তিক অর্থনীতিতে আর থাকবে না। থাকতে চাচ্ছে না। বহুমুখী আধুনিক উৎপাদন ও মেনুফ্যাকচারিংয়ের সমাজে রূপান্তরিত হতে অর্থনীতি ঢেলে সাজানো ও সংস্কার শুরু হয়ে গেছে। যদিও সেটি কতটা সফলভাবে পারবে, তা দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, এতে প্রধানত তাদের বাদশাহ-খলিফার সমাজ ভেঙে ছাড়খার করে তা ব্যক্তিভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত হয়ে যাবেই। যা শুরু হবে মিউনিসিপ্যাল সার্ভিস দান অর্থে প্রজাদের ব্যক্তি নাগরিক স্বীকার করে নিয়ে; আর যা শেষ হবে রাজা-খলিফা শাসন উৎখাত করে এক রিপাবলিক রাষ্ট্র, মানে পাবলিকই রাষ্ট্রক্ষমতার সবকিছুর নির্ধারক- এই অর্থভিত্তিক নতুন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে।

গোত্র সমাজ সম্পর্কে আরও কিছু কথা

গোত্র সমাজ মানে হলো- সমাজ নিয়ে আমাদের প্রচলিত যেসব ধারণা, তার বাইরের আলাদা এক সমাজ। গোত্র বা ট্রাইবাল সমাজ মানে হলো- যেখানে ব্যক্তিবোধ অনুভূতি একেবারেই নেই। এ জন্যই সেখানে ‘অনার কিলিং’ আছে বা থাকতে পারে। অর্থাৎ, আপনার কোনো বোন ইচ্ছামতো যে কোনো পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক করতে পারবে না। তাই এমন যদি সে করে বসে, তবে আপনি আপনার গোত্রের ইজ্জত-সম্মান রক্ষার্থে বোনকে মেরে কেটে ভাসিয়ে দেবেন- এই রেওয়াজ পালন হতে এখনো প্রায়ই শোনা যায়। যদিও বাংলাদেশে এখন আর খুনোখুনির ব্যাপারটা না থাকলেও, ট্রাইবাল মেয়েরা আধুনিক পড়ালেখা করার পরে বাঙালিদের বিয়ে করবে- এ ব্যাপারে পাহাড়িদের মধ্যে শক্ত করে বাধা তৈরির চেষ্টা আছে। অন্তত রাজনৈতিক বলপ্রয়োগের।

এ কালে সবচেয়ে বড় জটিলতা হলো- গোত্র সমাজ ও এর চর্চা ক্ষয়ে একেবারে শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই, নতুন ব্যক্তিভিত্তিক সামাজিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে গোত্র সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলো মাখামাখি করে রয়ে যায়। এর বড় বড় সংকটগুলো দেখা যায় পাকিস্তানের সর্ব উত্তরে বা উত্তর-পশ্চিমের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ধরা যাক, কোনো গোত্র সমাজ হয়তো কোনো এক পুরনোকালে ইসলামে কনভার্ট হয়ে গিয়েছিল। এখন চোখের বদলে প্রতিশোধ হিসেবে চোখ তুলে নেওয়া- এটি মূলত ট্রাইবাল প্র্যাকটিস; কিন্তু ইসলামে কনভার্ট হওয়ার পরও এই চর্চা কোথাও প্রবলভাবে থেকে যেতে পারে! ওই গোত্র সমাজের হয়ত খেয়ালই নেই যে, এটি কী ইসলামের প্র্যাকটিস না, গোত্র সমাজের প্র্যাকটিস।

সেখানে সবচেয়ে বড় আর পুরনো ট্রাইবাল সমাজ যা এখনো টিকে আছে, সেটি হলো পশতুন বা পাঠানদের গোত্র সমাজ। বিশেষ করে আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের মধ্যবর্তী এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাদের বসবাস, যা আবার হাজারটা পাঠান উপ-গোত্রে বিভক্ত। আর সবচেয়ে বড় কথা- এটি না আফগানিস্তান, না পাকিস্তানের কর্তৃত্বাধীন কোনো রাষ্ট্রীয় এলাকা। বরং দুই রাষ্ট্রই এর স্বাধীন ভূখণ্ড অস্তিত্ব স্বীকার করে। তাদের স্ট্যাটাস হলো- পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাদের ট্রাইবাল প্রধানের একটি চুক্তি আছে। ওই চুক্তি বলে তারা স্বাধীন এবং এক নন-স্টেট অস্তিত্ব। পাকিস্তান রাষ্ট্র বা সংসদে পাস হওয়া কোনো আইন তাদের ওপর আপনাআপনি প্রযোজ্য হবে না। যদি তা তাদের সঙ্গে কথা বলার পর তারা তা অনুমোদন করে। এ ছাড়া প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে এক সরকারি কর্মকর্তা সেখানে স্থানীয় পর্যায়ে থাকে, যাকে ‘এজেন্ট’ বলা হয়। তিনি গোত্র প্রধানের সঙ্গে ডিল করেন বা যোগাযোগ সম্পর্ক রাখেন ও সমন্বয় করেন। এমনটা শুরু হয়েছিল অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ, যা হয়েছিল ১৮৩৯, ১৮৭৮ এবং সর্বশেষ ১৯১৯ সালে, এই যুদ্ধের এক সেটেলমেন্ট হিসেবে।

আফগান রাজা রুশ সম্রাট বা জারের সঙ্গে এক সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন- এই খবর শুনে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার শাসক ব্রিটিশরা এটিকে নিজেদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ বা হুমকি মনে করে আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিল। ওই যুদ্ধে ব্রিটিশরা বিরাট ভূখণ্ড দখলে নেওয়ার পর ব্রিটিশ-পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মাঝে যে রাষ্ট্র সীমান্ত টানা হয়েছিল- এটিই ‘ডুরান্ড লাইন’ বলে পরিচিত; কিন্তু এর ফলে নতুন অসুবিধা হলো- এটি হাজারের ওপর পাঠান গোত্র সমাজকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বিভক্ত করে ফেলে। এতে আগের মতো গোত্র সমাজে তাদের অবাধ চলাচল মারাত্মক বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আর তা বাধাগ্রস্ত করে মূলত ব্রিটিশ সীমান্ত পোস্টগুলো। এই ক্রম বিক্ষুব্ধতা থেকে এক পর্যায়ে ১৮৭৮ সালে আবার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তবে এটি হয়েছিল পাঠান ট্রাইবের সঙ্গে ব্রিটিশ আর্মির। এটি তাই আফগানিস্তান নয়, ব্রিটিশ আর্মি বনাম পাঠান গোত্র সমাজের লড়াই। শেষে ব্রিটিশরা আপস করা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করে। এতে পশতুনরা ওই ভূখণ্ডের ওপর ব্রিটিশদের একমাত্র এখতিয়ার মেনে নেওয়ার বিনিময়ে ডুরান্ড লাইন ভেঙে দেওয়া হয়। ফলে আগের মতো স্বাধীনভাবে চলাচলের স্বাধীনতা ফিরে পায় পশতুনরা। ব্রিটিশ সীমান্ত পোস্টও পাকিস্তানের অনেক ভেতরে কোয়েটা পর্যন্ত পাকিস্তানের দিকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

এরই নিট ফলাফল হলো- পশতুন গোত্র বা ট্রাইবাল সমাজ কোনো আধুনিক রাষ্ট্রে হারিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে আরও দীর্ঘস্থায়ী আয়ু লাভ করে। কারণ ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে চলে যাওয়ার সময় ব্রিটিশ ভাইসরয়ের সঙ্গে পশতুন গোত্র প্রধানের চুক্তিটি তখন জিন্নাহ পাকিস্তানের নতুন গভর্নর জেনারেল হিসেবে তার সঙ্গে পাঠান গোত্র প্রধানের চুক্তি হিসেবে পুনর্লিখিত করে নেওয়া হয়। যদিও জেনারেল মোশাররফের আমলে, ২০০১ সালের পর ওয়ার অন টেররের যুগে আরেক দফা জবরদস্তিতে পশতুনদের স্বাধীন এলাকা আরও সংকুচিত করে পাকিস্তানের ‘ফেডারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবাল এরিয়া’ গঠন ও সে অঞ্চলকে সরাসরি পাকিস্তানের অধীনে নেওয়া হয়েছিল। তবে এরপরও স্বাধীন পশতুন ভূমি ও এজেন্ট প্রথার অধীন ব্যাপক এলাকা এখনো ট্রাইবাল সমাজ হিসেবেই থেকে গেছে।

তাহলে গোত্র সমাজ প্রসঙ্গে সার কথাটা হলো- অ্যাবসলিউট বা পুরাপুরি বাইরের সমাজের কারও সঙ্গে মিশেনি বা প্রভাবিত হয়নি এমন ‘খাটি’ গোত্র সমাজ এ কালে আর নেই বা তা পাওয়া খুবই কঠিন। সব পুরনো গোত্র সমাজেই পুরনো প্র্যাকটিসের পুরাটা অথবা আংশিক বাদ পড়ে গেছে। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা এসে পুরনো সব ভেঙে দিয়েছে, ক্রমশ আরও ভেঙে চলেছে।

রাজা ও সম্রাটের মিল-ফারাক
শেষ বিচারে সম্রাট বা ইংরাজিতে এম্পায়ার (Empire) শব্দের মূল অর্থ রাজাই; আর সেটি এই অর্থে যে, রাজা মানে ইংরাজি মোনার্ক (Monarch) যে অর্থে। কিং অথবা এম্পায়ার এ দুটি শব্দের অর্থও মোনার্ক করা যায়। যেখান থেকে মোনার্কি শব্দটি এসেছে। আমরা মোনার্কির বাংলা করি ‘রাজতন্ত্র’। আবার মোনার্ক শব্দের ফরাসি উৎসে এর অর্থ ভাঙলে দাঁড়ায় একক শাসন। তাহলে রাজা আর সম্রাট ধারণার মধ্যে এত ফারাক কিসে? রাজা আর সম্রাট শব্দ দুটি সোল বা একক শাসন কর্তৃত্ব বোঝায়। এখানেই কেবল তাদের মিল। তবে অন্যান্য সব বিষয়ে তারা আলাদা।

আমাদের মনে রাখতে হবে- যত পুরনো দিন বা পেছনের দিন দেখতে যাব, ততই লক্ষ্য করব- তখন দেশের নাম আর রাজধানীর নাম আলাদা হতো না। যে অর্থে এখন ভারতের রাজধানী দিল্লি, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। অর্থাৎ, এখন রাজধানী আর দেশ, দুটি আলাদা নাম। এর বিপরীতে সে কালের বাগদাদকে পাব, যেখানে ইরাক বলে কিছু ছিল না। আব্বাসীয় শাসনামালের কথা চিন্তা করলে বাগদাদই সব; ইরাক আবার কী? ইরাক বলে কিছু ছিলও না তখন। আবার রোম নিজেই ছিল খুবই বিখ্যাত। রোম নিজেই সাম্রাজ্য- সাম্রাজ্যের নাম, আবার তা রাজধানীও। এ কালের মতো- ইতালি দেশের নাম আর তার রাজধানী রোম- তা নয়। কেন এমন হলো এবং কবে থেকে?

মোটা দাগে বললে, আগেকার দিনে রাজার রাজ্য বা দেশের সীমানা ব্যাপারটা আজকের মতো এত গভীরভাবে দেখা হতো না। মোটামুটি একটি ভৌগোলিক সীমানা, যেমন- অমুক পাহাড়, অমুক মরুভূমি, অমুক নদী বা হ্রদ ইত্যাদি দিয়ে একটি সীমানা বলা থাকত; কিন্তু তা মাঠে বাস্তবায়ন বা প্রতিষ্ঠা করতে কাউকে তেমন সিরিয়াস থাকতে দেখা যেত না। আজকের দিনের চেক পোস্ট, সীমানা পোস্ট ইত্যাদির মতো চোখ রাখার কিছু সেখানে থাকত না বা দরকার মনে করা হতো না। এভাবেই চলেছিল ১৬৪৮ সালের আগে পর্যন্ত। এরপর সীমানা চিহ্নিতকরণ করতে শুধু ইউরোপ বলে নয়, দুনিয়াকেও সিরিয়াস হতে দেখেছিলাম আমরা।

সীমানা ও সার্বভৌম
ততদিনে খ্রিস্টাব্দের এক হাজার বছর পার হয়ে গেছে, যখন ইউরোপের প্রধান দুটি ঘটনা ঘটে যায়। প্রথমটি হলো- ৪৭৬ সালে রোম সাম্রাজ্যের পতন। যীশুর জন্মেরও প্রায় সাড়ে সাতশ’ বছর আগে যে রোম নাগরিক সমাজ শুরু হয়েছিল, তারই পতন এটি। বলা বাহুল্য, এটি মূল রোম বা পশ্চিম রোমের কথা বলা হচ্ছে। আর শেষের দিকে আলাদা করে গড়া প্রশাসন গ্রিক বা ইস্টার্ন রোম, যার পতন হয় আরও অনেক পড়ে। তবুও মিসর ও সিরিয়া প্রদেশ আগেই তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় মুয়াবিয়াদের হাতে। আর উম্মাইদ ডায়নেস্টির হাতে শাসিত হতে শুরু করে দামেস্ক।

ইউরোপের দ্বিতীয় বড় ঘটনাটি হলো- ৮০০ সাল থেকে হলি রোমান এম্পায়ার নামে আরেক সাম্রাজ্য চালু হয় বা যাত্রা শুরু করে, তিন শতাধিক বছর আগের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রথম রোম এম্পায়ারের কথাকে স্মৃতিতে রেখে। যদিও আগের রোমের সঙ্গে হলি রোমান এম্পায়ার কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়। কিছু পুরনো স্মৃতি ছাড়া এই দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে আর কোনো সম্পর্ক ছিল না। এটি শুরু হয়েছিল জার্মানির ফ্রাঙ্কের রাজা (King of the Franks) ‘শার্লে ম্যাগনে’র হাতে। ইংরাজি চার্লস-এর ফরাসি উচ্চারণ শার্লে আর ম্যাগনাম মানে হলো- গ্রেট। অর্থাৎ চার্লস দ্য গ্রেটের হাতে পত্তন হয়েছিল এই এম্পায়ারের। এটি মূলত জার্মানি ও ফ্রান্সকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো এথনিক জনগোষ্ঠীর পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপজুড়ে বিস্তৃত এক সাম্রাজ্যের ভূখণ্ড। আর তা টিকে ছিল ১৮০৬ সাল পর্যন্ত। আগের রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে এর মিল ও ফারাক হলো- পুরনো রোম ৩১৩ সালের পর থেকে ক্যাথলিক খ্রিস্টান সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। প্রথম দিকে রোমের দু’চারজন ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্ম চর্চা করত; কিন্তু সম্রাট তা পছন্দ না করে তাতে বাধা দেওয়া শুরু করেন। এক পর্যায়ে নিপীড়ন ও শাস্তি প্রয়োগও শুরু করেন; কিন্তু এতে ক্যাথলিকদের মনোভাব পুরো ঘটনাকে উল্টে দেয়। তারা রোম সম্রাটের সব অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করে হাসিমুখে ধর্মচর্চা চালিয়ে যেতে থাকে। আর এটিই স্থানীয় বাসিন্দাদের খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলে। এক পর্যায়ে বাসিন্দারা শাসকের অত্যাচার অপছন্দ করা শুরু করে। আর এতে দেখা যায়, ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে, এক পর্যায়ে পরবর্তী সম্রাট নিজেই খ্রিস্টান হয়ে সবদিক রক্ষা পাবে মনে করেন। এভাবে খোদ রাজাই ক্যাথলিক ধর্মানুসারী হয়ে গেলে প্রাচীন রোম খ্রিস্টান ক্যাথলিক রোম সাম্রাজ্য বলে পরিচিতি পেয়ে যায়। তবে খ্রিস্টান হওয়ার পর মাত্র প্রায় দেড়শ’ বছরের মতো রোম সাম্রাজ্য টিকে ছিল।

এদিকে, এর সঙ্গে তুলনা করলে ৮০০ সাল থেকে শুরু হওয়া নতুন হলি রোমান এম্পায়ার, শুরু থেকেই ক্যাথলিক খ্রিস্টান সাম্রাজ্য হিসেবে যাত্রা শুরু করে। শুধু তা-ই না, শুরু থেকেই এই এম্পায়ারের ওপর চার্চ ও পোপের ভূমিকা ছিল অনেক বিশাল। আর বলাই বাহুল্য, আস্তে আস্তে সারা ইউরোপই বলতে গেলে হলি রোমান এম্পায়ারের অধীনস্থ হয়; কিন্তু পরের আটশ’ বছরের মধ্যে এর কেন্দ্রীয় প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং স্থানীয় রাজারা বাস্তব ক্ষমতাধর হয়ে উঠতে শুরু করেন। স্থানীয় রাজাদের ভূমিকা প্রধান হয়ে উঠতে শুরু করলেও আনুষ্ঠানিক কেন্দ্রীয় প্রশাসন বা সরকার তখনো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়নি। আজকের ইউরোপ যেমন বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত, তা সে সময় থেকেই স্পষ্ট হতে শুরু করে।    

ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৬৪৮ সালে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে জার্মানির ওয়েস্টফিলিয়া শহরে অনুষ্ঠিত ‘ওয়েস্টফিলিয়া চুক্তি’র কারণে। কারণ সে সময় আরও অনেকগুলো সমঝোতা বা চুক্তির সঙ্গে স্থানীয় রাজাদের ভূখণ্ডের সীমানা কতদূর হবে, তা নিয়ে পড়শি রাজাদের মধ্যে এক সমঝোতাও হয়েছিল। অর্থাৎ, প্রকারান্তরে নিজস্ব ভূখণ্ড চিহ্নিত করা এবং ওই ভূখণ্ডের ওপর সব এক্তিয়ারের অধিকারী রাজা বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়। এতে কেন্দ্রীয় প্রশাসন আরেক দফা গুরুত্ব হারায়; স্থানীয় রাজারাই মূল ক্ষমতা এবং সার্বভৌম ক্ষমতা হিসেবে হাজির হয়েছিল। রাজাদের এসব ভূখণ্ড ডিমার্কেটেড আর ভূখণ্ডের ওপর এখতিয়ার কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেওয়াতে এই সীমানাই এখনকার ইউরোপের স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর সীমানা বলে তখন থেকেই এঁকে দেওয়া হয়েছিল।

সার কথায় রাজার রাজ্য বা সম্রাটের সাম্রাজ্য ধারণার সঙ্গে এবার ‘সীমান্ত আর সাবভৌম’ একক কর্তৃত্ব ধারণা বিকশিত হয়েছিল। ‘রাষ্ট্র’ সার্বভৌম ধারণার যাত্রা তখন থেকেই।

কর, খাজনা বা সালামি
ততদিনে রাজা বা সম্রাটরা কর বা খাজনা তুলে রাজ্যের কোষাগার ভরে তোলার বন্দোবস্ত হিসেবে রাজ্য বা সাম্রাজ্যকে গড়ে তুলে ফেলেছেন; কিন্তু মুখ্য প্রশ্ন- রাজার কর বা খাজনা জিনিসটা কী? একেবারে শুরুর দিকে রাজার কর বা খাজনা দাবি যে খামোখা, মানে এর সপক্ষে দেওয়ার মতো রাজার কাছে কোনো সাফাই নেই, সে সম্পর্কে রাজারা পরিষ্কার ছিলেন। মূল কথা হলো- রাজা যে কর বা খাজনা নেন, এর বিনিময়ে তারা প্রজাদের কোনো কিছুই দেন না। অর্থাৎ, রাজা বিনিময়ে প্রজাকে কোনো সার্ভিস দেবেন এমনও নয়।

এ জন্য আসলে সেকালে শব্দগুলোও ছিল তেমনই অর্থহীন। তেমনই কিছু শব্দ ‘সালামি বা সম্মানী’। আমরা বাংলায় সরাসরি কর বা খাজনা বলি। কোনো কোনো দেশে সেকালে কর বা খাজনার বিকল্প প্রচলিত আরেক শব্দ হলো ট্রিবিউটারি (Tributery), যার বাংলা মানে হবে শ্রদ্ধাবশত বা শ্রদ্ধা দেখানোর প্রতীক হিসেবে অর্থপ্রদান করা। আবার অনেক সময় রাজা এমন কিছু তারিখ আগেই ঘোষণা করে দেন, যেদিন প্রজারা রাজার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন; কিন্তু খালি হাতে তো দেখা হয় না। টাকা-পয়সাসহ জমিতে ফলানো কোনো ফসল সঙ্গে নিয়ে আসবেন। যেমন- আমাদের পাহাড়িরা এটিকে পুণ্যার্হ্য বলে। তো সার কথা হলো- রাজা বিনিময়ে প্রজাদের কিছুই দেবেন না; কিন্তু রাজাকে অর্থ দিতে হবে। এমনকি সেকালে হয়তো কোনো এক রাজার রাজ্য পেরিয়ে পরের রাজ্যে হাঁটুরেরা যাওয়া আসা করে ব্যবসার প্রয়োজনে। সেক্ষেত্রে যে রাজ্যের ওপর দিয়ে হেঁটে যায়, সেই রাজাকে ‘সালামি’ দিয়ে যেতে হয়। এর চেয়ে প্রত্যক্ষ খামোখা আর কী হতে পারে! তবে খামোখা এমন অর্থ দেওয়ার রেওয়াজ এখান থেকেই। পরবর্তীকালে অন্তত কিছু সার্ভিস বা সেবা প্রজাদের দেওয়ার রেওয়াজ আসে, যেন খাজনা তোলার অন্তত কিছু একটা দৃশ্যমান সাফাই হাজির থাকে। তবে খাজনার সমমূল্যের পরিমাণ সার্ভিস কখনোই দেওয়ার কথা ভাবা হয়নি। সেখান থেকে আজও পাবলিকের রাষ্ট্রে যে ট্যাক্স নেওয়া হয়, সেখানেও ট্যাক্সের সমমূল্যের পরিমাণ সেবা নাগরিককে প্রতিদান দিতে হবে এমন কোনো নিয়ম বা সামঞ্জস্য কোনো রাষ্ট্রে মানা হয় না। সার কথায় ট্যাক্সের পরিমাণ কত হবে, এটি সবসময়ই শাসকের খেয়ালি ইচ্ছামতো বিষয় হিসেবেই থেকে গেছে।

তবে একালে আধুনিক উন্নত কিছু শহরে গ্যাস, বিদ্যুৎ বা পানি সরবরাহের বিনিময়ে যে ট্যাক্স ধরা হয়, সেখানে কিছু সামঞ্জস্য টানার চেষ্টা দেখা যায়। যেমন- ট্যাক্স বাড়াতে হলে বিনিময়ে বাড়তি কী সুবিধা দেওয়া হবে, এর সাফাই দেখাতে হয়। ধরা যাক, অস্ট্রেলিয়ায় এক নগরে পানি সরবরাহ এক আমেরিকান কোম্পানি করে থাকে। এই ট্যাক্স বাড়াতে হলে বিনিময়ে বাড়তি কী সুবিধা দেওয়া হবে, এর এক তালিকা দিয়েছে। এখন কম্পিউটারের এক ম্যাথমেটিক্যাল মডেল তৈরি করে এর পক্ষে সাফাই আছে কিনা তা বের করা সম্ভব। সাধারণত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এ কাজ করে থাকে। যা-ই হোক, এটি অবশ্যই সব দেশের সরকার বা নগর সার্ভিসের চিত্র নয়। সার কথায়- ট্যাক্স মানেই তা খামখেয়ালি, সমমূল্যের সার্ভিস ফেরত দান নয়। সেটি ট্যাক্সের নামে চাঁদা তোলার শুরুর দিন থেকেই; যে কোনো রাজার, যে কোনো রাজ্যের নিয়ম থেকে।

তবে সাধারণত দেখা যেত- রাজাদের আমলে বেশিরভাগ রাজাই ট্যাক্সের বিনিময়ে যে কোনো নাগরিক সেবা দিতে হবে, সেটিও ঠিকমতো চালিয়ে যেতে পারেননি অদক্ষতার কারণে। হয়তো তার রাজ্যের ওপর দিয়ে ব্যবসায়ীরা পণ্য নিয়ে যায়, অথচ রাজা একটু নিরাপত্তার ব্যবস্থাও দিতে পারে না। এমনটা দেখতে পাওয়াই ছিল সেকালে স্বাভাবিক। পরবর্তীকালে এই প্রসঙ্গে এসে সম্রাটরা তাদের সাম্রাজ্যে এসব কমন সুবিধাদির ব্যবস্থা করে দক্ষতা দেখাতে পেরেছিলেন। এ জন্যই সে এম্পায়ার। যেমন অটোম্যান সাম্রাজ্য এ ব্যাপারে এক দক্ষ সাম্রাজ্যই ছিল। তারা রাজস্ব সংগ্রহ করত প্রচুর, খরচও করত প্রচুর। এখানে মূল কথা হলো- একসঙ্গে বসবাস করতে গেলে বিশেষত কোনো নগরে, সেখানে ন্যূনতম কিছু কমন ফেসিলিটির খুবই দরকার হয়ে পড়ে। যেমন- পানি, ড্রেনেজ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ইত্যাদি সার্ভিস সরবরাহ করবে কে?

এখান থেকেই ‘অবকাঠামো’ বা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ধারণাটি হাজির হয়েছিল। ধারণাটি হলো- পানি, ড্রেনেজ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ইত্যাদি সার্ভিস সরবরাহ ব্যবস্থাটা হতে হবে ‘না লাভ না ক্ষতি’র নীতির ভিত্তিতে। কেন? কারণ, যেহেতু এই সার্ভিসগুলো ব্যবহার করেও সমাজের মূল উৎপাদন বা নানা ধরনের মেনুফ্যাকচারিং কোম্পানি গড়ে উঠবে, ফলে এসব সার্ভিসগুলোতেও যদি বাণিজ্যিক কোম্পানির মতো মুনাফা করা হয়, তবে সব মেনুফ্যাকচারিং কোম্পানির উৎপাদিত পণ্যের দাম অনেক বেশি রাখতে হবে, ওই মুনাফার কারণে। তাই ওসব কমন ফেসিলিটিস যারা হাজির করবে, সেগুলোর অবকাঠামো খাতে কম সুদের বিনিয়োগ ঢালতে হবে। শক্ত ও বিন্যস্ত অবকাঠামো থাকলে মূল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সহজেই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে, এটিই হলো মূল সূত্র।

ঢাকার মানুষদের আয়সীমা বেশি বা অন্যভাষায় বললে ক্রয়ক্ষমতা সমাজে সবচেয়ে বেশি যাদের, তারা ঢাকা শহরেই থাকে, সংখ্যায়ও অনেক। তাই ৪৬০ উপজেলার প্রতিটি, যে যা ভালো ও দক্ষতার সঙ্গে উৎপাদন করতে পারে তা যদি ঢাকার বাজারে আনতে পারে, তবে উপযুক্ত ক্রেতা পাওয়ায় তাদের টিকে যাওয়া সহজ হতে পারে। কাজেই প্রত্যেক উপজেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা যত সহজ ও উন্নত হবে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি তত গতি পাবে। অতএব উপজেলায় আর উপজেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারলে অর্থনীতি তড়তড়িয়ে বাড়বে। ততই রাষ্ট্র এম্পায়ারের ভূমিকায় হাজির হয়ে যাবে।

অর্থাৎ, এম্পায়ার ধারণাটি এখানে আর কেবল সম্রাটের সাম্রাজ্যের মধ্যে আটকে থাকছে না। আলাদা হয়ে যাচ্ছে। যার মূল অর্থ একটা দক্ষ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা; যেটা অবকাঠামোগত কমন সুবিধাদি দক্ষতার সঙ্গে হাজির করতে সক্ষম। আর তাতে স্বভাবতই রাষ্ট্র বা মিউনিসিপ্যালিটির রাজস্ব আদায় বিপুল বাড়িয়ে তুলতেও সক্ষম হবে। বেশি আদায় ও বেশি খরচ করার মুরোদ হবে যেখান থেকে।

  • চলতি শতকের আমেরিকা রাষ্ট্র নিজের আয়-ব্যয় মেটাতে দিনকেদিন অক্ষম হয়ে পড়ছে, আর রাষ্ট্র নিয়মিত বাজার থেকে ধার করে নিজের ব্যয় নির্বাহ করে চলেছে। যেটি এখন প্রায় ১৮ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এখন তাই প্রতি তিন-চার বছর পরপর আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে কংগ্রেসের অনুমোদন নিতে হয় নতুন করে ধার নেওয়ার জন্য। আর ওই অনুমোদন পাওয়ার আগের কয়েক সপ্তাহ হয় করুণ অবস্থা
এ জন্য প্রায় তিনশ’ বছরের কলোনি দখল যুগের অবসানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে দুনিয়ায় আবার প্রধান হয়ে উঠে এক এম্পায়ারের ধারণা। তবে অবশ্যই এটি পুরনো সম্রাটের সাম্রাজ্যের মধ্যেকার এম্পায়ার ধারণা নয়। এর পেছনে মূল কারণ- দুনিয়া স্বাধীন কলোনিমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে ভরে উঠেছিল ১৯৪৫ সালের পর থেকে। আর তাতে সবমিলিয়ে এখন প্রায় ১৯৩টি রাষ্ট্র আছে। এসব রাষ্ট্রেরও কমন কিছু গ্লোবাল ফেসিলিটি, বিশেষ করে রাষ্ট্রগুলো পারস্পরিক পণ্য-বিনিময় বাণিজ্য যাতে সহজেই করতে পারে, সেজন্য একটা কমন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা চালু হয়েছিল আমেরিকার নেতৃত্বে। আমেরিকা সেই গ্লোবাল অর্ডারের নেতা- এক আধুনিক এম্পায়ারের ভূমিকা আমেরিকা পালন করে গেছে। না, অনেকে আমেরিকাকে রাজনৈতিক মূল্যায়নে ইম্পেরিলিস্ট বা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র বলে থাকে। না, আমার কথাটা সেই অর্থে নয়। এটি গ্লোবাল ম্যানেজমেন্ট, একটা অর্ডার বা শৃঙ্খলা কায়েমের নায়ক হিসেবে আমেরিকার এম্পায়ার ভূমিকার কথা বলা হচ্ছে।

একটা মজার উদাহরণ দেওয়া যাক- চলতি শতকের আমেরিকা রাষ্ট্র নিজের আয়-ব্যয় মেটাতে দিনকেদিন অক্ষম হয়ে পড়ছে, আর রাষ্ট্র নিয়মিত বাজার থেকে ধার করে নিজের ব্যয় নির্বাহ করে চলেছে। যেটি এখন প্রায় ১৮ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এখন তাই প্রতি তিন-চার বছর পরপর আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে কংগ্রেসের অনুমোদন নিতে হয় নতুন করে ধার নেওয়ার জন্য। আর ওই অনুমোদন পাওয়ার আগের কয়েক সপ্তাহ হয় করুণ অবস্থা। যেমন- আমেরিকা রাষ্ট্র যাদেরকে ডেইলি পে-ভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে, কংগ্রেসের অনুমোদন না পাওয়ায় তাদের কাজে আসতে বারণ করে থাকে। অথচ ওবামা আমলে এমনও ঘটেছে যে, জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামকে (WFP) ওবামা প্রশাসনের কমিটমেন্ট ছিল ১০০ মিলিয়ন ডলার চাঁদা দেওয়ার। এখন একদিকে আমেরিকার ডেইলি পেমেন্ট কর্মীদের কাজে না আসতে বললেও, ওই ১০০ মিলিয়ন ওবামা প্রশাসনকে যেভাবেই হোক যোগাড় করে দিতেই হচ্ছে কেন?

কারণ আমেরিকা এক এম্পায়ার, আমেরিকার নেতৃত্বের এক গ্লোবাল সিস্টেমের এম্পায়ার সে। তাই এর কমিটমেন্টের মূল্য অনেক ওপরে। নিজে না খেয়ে হলেও এম্পায়ারের কমিটমেন্ট তাকে রক্ষা করতেই হবে। এটাই এম্পায়ার!

অর্থাৎ, এর লেজ ধরে বলা যায়- আগামী অর্থনৈতিক দুনিয়া যদি আমেরিকার জায়গায় চীনের নেতৃত্বের এক সিস্টেম হয়, তবে চীনকেও এমন এম্পায়ারের ভূমিকা ও কর্তব্যকর্মের দায় নিতে হবে। যেমন- এখন যে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন তৈরি হচ্ছে, এর উৎপাদন ও বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে এই ভ্যাকসিন দিতে যে খরচ হবে এর পুরোটা না হলেও বিরাট এক খরচের ভর্তুকির অংশ চীনকে বহন করতে হবেই। কারণ, বাংলাদেশ চীনের ফেভারিট ক্লায়েন্ট স্টেট। এই হলো পালনীয় একালের আধুনিক এম্পায়ারের ভূমিকা!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh