প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে বাড়ছে ধর্ষণ

মাহমুদ সালেহীন খান

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২০, ১০:২০ পিএম

সিলেটের এমসি কলেজ এবং নোয়াখালীর ঘটনায় সপ্তাহখানেক ধরে ধর্ষণের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ চলছে। আবার বেশিরভাগ ধর্ষণের খবরই কিন্তু সংবাদপত্রে আসে না। সামাজিক মর্যাদাহানিসহ বিভিন্ন কারণে ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেয়া হয়। সংবাদপত্রে যেসব ঘটনা প্রকাশিত হয়, তার সামান্যই বিচারের মুখ দেখে। ২০০১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেখলে আতঙ্কিত হতে হয়। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর তথ্যানুসারে এই সময়ে মোট ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৩ হাজার ৬৩৮ জন, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার দুই হাজার ৫২৯ এবং ধর্ষণের শিকার শিশুর সংখ্যা ছয় হাজার ৯২৭ জন।

মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৭০৩ নারী। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ২৪৫ জনকে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৪৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে; আর অক্টোবরের প্রথম দু’সপ্তাহে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২০৮ নারী। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা ও পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কেবল আইন আর প্রতিবাদেই রাশ টানা যাবে না ধর্ষণের মতো ঘটনার। আইনের কঠোর বাস্তবায়ন, দ্রুত বিচার ও অপরাধীদের ছাড় না দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে, যা নিশ্চিত করার দায়ভার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বর্তায়। কারণ আমরা দেখছি, ধর্ষকরা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকে। প্রশাসন তাদের আড়াল করার চেষ্টা করে। পাশাপাশি বদলাতে হবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি।’

তিনি আরো বলেন, বিচার প্রক্রিয়াটিই অপরাধী বা ধর্ষক-বান্ধব; ভিকটিম-বান্ধব না। একটা ধর্ষক ভাববে- আমার বিচার হবে না। বিচার হলেও মানুষ এক সময় ভুলে যাবে। তার বড় ভাই এবং গডফাদাররা বিচারের কাঠগড়া থেকে টেনে তুলবেন। তাহলে আপনি মৃত্যুদ- কেন, আরো অনেক কঠোর আইন করেও এ জাতীয় সামাজিক অপরাধ বন্ধ করতে পারবেন না।’

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনাসহ বেশিরভাগ ধর্ষণের ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ ক্যাম্পাসে ধর্ষণ বা দলগত ধর্ষণের ঘটনা গত তিন দশক ধরেই ঘটছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলের ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, ‘বিচারহীনতা এবং ভয়ের সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণ অনেকটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। বিচার না পাওয়া এবং ভয়ের কারণে অনেকে মামলা করছেন না। ক্ষমতা আর বিত্তের কাছে বিচারপ্রার্থীরা অসহায় হয়ে পড়ছেন। আর অপরাধীরাও জানে যে, তাদের কিছু হবে না। তাই তারাও ধর্ষণের মতো ঘটনা থেকে বিরত হচ্ছে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময়ে পরিসংখ্যান দিয়ে থাকি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এসব পরিসংখ্যান অসম্পূর্ণ। পত্রিকায় সব খবর আসে না। সব ভুক্তভোগী থানা-পুলিশের কাছেও যান না। প্রথমত, লোকলজ্জার ভয়ে। দ্বিতীয়ত, তারা ভাবেন, অভিযোগ করেও কোনো লাভ হবে না। বিশেষ করে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যদি হন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী কিংবা প্রভাবশালী বা তাদের পরিবারের সদস্য। আমরা দেখেছি, যেসব নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়, সেসব ঘটনায় আসামিরা গ্রেফতার হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচারও হয়। আর বাকি মামলা শেষ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। আসামিরা ছাড়া পেয়ে যায় রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়ে।’

কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের মতো ঘটনা উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। ধর্ষণের ফলে শুধু একটি নারীই ধর্ষিত হয় না, ধর্ষিত হয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র সমাজ।’

কী করলে ধর্ষণের সংখ্যা কমিয়ে আনা যায় এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সমাজ না বদলালে অবস্থা বদলাবে না, ধর্ষণও কমবে না। আমাদের নেতা-মন্ত্রীরা চড়া গলায় কথা বলেন- আইন নিজস্ব গতিতে চলবে, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। অথচ বাস্তবে আইন নিজস্ব গতিতে চলে না। আদালতের রায়ে শাস্তি পেলেও রাজনৈতিক প্রভাবে তারা ক্ষমা পেয়ে যায়। পুলিশ স্বেচ্ছায় এসব মামলা শেষ করে না। ক্ষমতাধর ব্যক্তি কিংবা নেতার হুকুমেই তা ঘটে। যেসব অপরাধের সঙ্গে রাজনীতির সম্পৃক্ততা থাকে, সেখানে কাকে ধরা আর কাকে ছাড়া হবে- তা ঠিক হয় রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ থেকে।’

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘যার ক্ষমতা আছে, সে এক ধরনের বিচারহীনতার সুবিধা ভোগ করে। সেই সুবিধা তাকে নানা অপকর্মে প্ররোচিত করে। এর মধ্যে ধর্ষণ একটি। এর জন্য বর্তমান অবক্ষয়গ্রস্ত দলীয় রাজনীতি সবচেয়ে দায়ী। ক্ষমতার সুবিধা নিতে দলে দুর্বৃত্ত-অপরাধীরা নেতৃত্বের আসন পর্যন্ত বাগিয়ে নেয়। যখনই কারও অপরাধের খবর ফাঁস হয়ে যায়, তখন বলা হয়- সে আসলে আমাদের দলের কেউ নয়, অথবা অনুপ্রবেশকারী। এটি রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা চাই, অবিলম্বে ধর্ষণের মহামারি বন্ধ হোক। সরকারের প্রথম এবং প্রধান এজেন্ডা হোক দেশ থেকে ধর্ষণ বন্ধ করা। এ জন্য সরকারকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ঘোষণা করতে হবে।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ূম মনে করেন, ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে এ অপরাধ কমিয়ে আনা যাবে না। তিনি বলেন, ‘বিএনপির সময় ছাত্রদল এবং যুবদলের ওপর ধর্ষণের অভিযোগ ছিল। এখন ছাত্রদল ও যুবদল আছে; কিন্তু তারা ধর্ষণ করছে না। এর মূল কারণ হলো- তাদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। যেহেতু এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, তাই ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা এই ধরনের কাজ করছে। আসলে সহিংসতার দুটি রূপ। পুরুষের ক্ষেত্রে হাত-পা কেটে হত্যা করা এবং নারীর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহিংসতা হলো ধর্ষণ। এই দুটি অপরাধই কমে আসবে না, যদি রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করা না যায়।’

বাসদ নেতা রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘ধর্ষণের মতো জঘন্য আক্রমণের শিকার নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দরিদ্র হলেও, সমাজের কোনো অংশের নারীই নিরাপদ নন। যে কোনো বয়স বা অঞ্চল, শিক্ষিত বা নিরক্ষর, গৃহবধূ বা কর্মজীবী, উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্ত সবক্ষেত্রেই নারীরা যে আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্কে থাকেন, তার কারণ- ধর্ষকরা সবসময় ক্ষমতা বলয়ের কাছাকাছি থাকে। সাম্প্রতিক জঘন্যতম ঘটনাগুলোর সঙ্গে যুক্তরা তারা সবাই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত।’

এ বাসদ নেতা আরো বলেন, ‘নারীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি, প্রচারমাধ্যমে উপস্থাপনের মনোভাব, ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে হেয় করার পদক্ষেপ প্রতি মুহূর্তে নারীকে অপমানের ঝুঁকির মধ্যে রাখে। এসবের বিরুদ্ধে সামাজিক ও আইনি সুরক্ষা তৈরি করা দরকার। আর ধর্ষণের মতো ঘটনায় দ্রুত শাস্তি দেয়া দরকার। শাস্তির ভয় অপরাধীদের কিছুটা হলেও নিবৃত্ত করে; কিন্তু নারীর জন্য নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিবেশ সৃষ্টির আন্দোলন শক্তিশালী রাখতে না পারলে ধর্ষণ ও অসম্মানের হাত থেকে নারীর মর্যাদা রক্ষা সম্ভব নয়।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh