রবিবার থেকে ৩ ঘণ্টা করে বন্ধ ইন্টারনেট-ডিস

তার টানাটানিতে শঙ্কায় গ্রাহকরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২০, ০১:৫২ পিএম | আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২০, ০৪:৪৯ পিএম

বিকল্প ব্যবস্থা ও আগাম কোনো খবর বা সময় না দিয়ে অব্যাহতভাবে ঝুলন্ত তার অপসারণের প্রতিবাদে রবিবার (১৮ অক্টোবর) থেকে প্রতিদিন তিন ঘণ্টা করে বন্ধ ইন্টারনেট ও ক্যাবল টিভিসেবা বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠান ইএসপিএবি ও কোয়াব। অথচ তারের জঞ্জাল সরাতে উচ্চ আদালত ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নির্দেশ দিয়েছেন। আর এই তার অপসারণ করার নামে রশি টানাটানিতে ব্যস্ত আছে সংশ্লিষ্ট সরকারি বেসরকারি সংস্থা, রেগুলেটরি কমিশন এবং অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো।

এদিকে, ক্যাবল কাটায় ইন্টারনেট কিংবা স্যাটেলাইট সংযোগ সেবা পেতে চরম ভোগান্তি পড়েছে রাজধানীর লাখ লাখ মানুষ। দেশের দুই শেয়ারবাজারের লেনদেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমনকি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যক্রমও হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট না পেলে বন্ধ থাকবে এটিএম সেবাও। এতে শত শত কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা করছেন প্রযুক্তিবিদরা। অন্যদিকে, যারা করোনার কারণে অনলাইন ক্লাস, পরীক্ষা, অফিস, ভার্চুয়াল সভা, কেনাকাটাসহ উচ্চ গতির ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল, তাদের সমস্যা আরো বেশি।

ইএসপিএবি ও কোয়াবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- ক্যাবল কাটা বন্ধ না করা পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা তাদের সেবা বন্ধ রাখবে। জানা গেছে, রাজধানীর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ঝুলন্ত তার অপসারণ অভিযান শুরু করেছে। এতে কাটা পড়ছে ইন্টারনেট ও ক্যাবল টিভি সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর তারগুলো। এ অবস্থায় গত সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) ও কেবল অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) নেতৃবৃন্দ সেবা বন্ধের এ হুঁশিয়ারি দেন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাসাবাড়ি, অফিস ও ব্যাংকসহ সব পর্যায়ে ইন্টারনেট ডাটা কানেক্টিভিটি এবং ক্যাবল টিভি বন্ধ রাখার প্রতীকী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে আইএসপিএবি ও কোয়াব। বিকল্প ব্যবস্থা না করে বিনা নোটিশে বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে ইন্টারনেট ও ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক অপসারণের হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে গত দুই মাসে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২০ কোটি টাকার ক্যাবল সংযোগ দিতে হয়েছে। এতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইন্টারনেট ও ক্যাবল টিভি অপারেটর ব্যবসায়ীরা।

আইএসপিএবি সভাপতি এম এ হাকিম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিকল্প ব্যবস্থা আমাদেরকে না করে দেয়া পর্যন্ত অনুরোধ করব তার অপসারণের কাজটা থামিয়ে রাখার জন্য। আগামী ১৭ অক্টোবরের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান না করা হলে আগামী ১৮ অক্টোবর রবিবার থেকে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত সারা দেশে বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, ব্যাংকসহ সকল পর্যায়ে ইন্টারনেট ডেটা কানেক্টিভিটি ও কেবল টিভির সেবা প্রতীকীভাবে বন্ধ রাখা হবে। যতদিন আমাদের এই সমস্যার সমাধান না হচ্ছে, ততোদিন তিন ঘণ্টা করে সেবা বন্ধ থাকবে।

তবে দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- সম্প্রতি সড়কে মাথার ওপর ঝুলে থাকা বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে বিপজ্জনকভাবে পেঁচিয়ে থাকা তারের জঙ্গল অপসারণে অভিযান শুরু করেছে ঢাকা সিটি করপোরেশন। মাটির নিচ দিয়ে এসব সংযোগ থাকার কথা থাকলেও যত্রতত্র মাথার ওপর দিয়ে ক্যাবল টানা হচ্ছে। এতে নগরীর সৌন্দর্য বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি জনজীবনে ঝুঁকি বাড়ছে। বাড়ছে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা। ঝুলতে ঝুলতে অনেক স্থানে তারগুলো মাটি পর্যন্ত স্পর্শ করছে। এ কারণে অনেক পথচারী ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে পারেন না। এগুলো থেকে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। এছাড়া ঝুলে থাকা ডিশ বা ইন্টারনেটের ক্যাবল থেকে অগ্নিকাণ্ডও ঘটছে। কখনো দেখা যায়, পুরোনো তারে ত্রুটি দেখা দিলে সেগুলো না কেটেই নতুন তার লাগিয়ে দেয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে তারের জঞ্জাল দিন দিন বেড়েই চলেছে।

ডিএসসিসি বলছে, বিদ্যুতের খুঁটিতে তার ঝুলিয়ে সংগঠন দুটি সেবা দিচ্ছে। সংগঠন দুটি এভাবে সেবা দেওয়ার বিষয়ে সিটি করপোরেশন থেকে কোনো অনুমতি নেয়নি। উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ পরিবাহী তারের সঙ্গে ইন্টারনেট, টেলিফোন ও ক্যাবল টিভির এসব তার অপসারণে সরকার দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে আসছে। যদিও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ক্যাবল সরানোর জন্য দুই মাসের বেশি সময় দিয়েছে আইএসপিএবি ও কোয়াবকে। এছাড়া বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ, এনটিটিএনগুলোকে দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য নির্দেশনা, ডাক্ট সার্ভিস তৈরি, রোড ক্রসিং ও পয়েন্ট তৈরির মতো উদ্যোগ নিয়েছে ডিএনসিসি।

আইএসপিএবির সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, আমাদের মৌখিকভাবে বলা হচ্ছে, আন্দোলনে না যেতে। কিন্তু আমাদের কোনো উপায় নেই। ক্যাবল কাটা বন্ধ করা এবং বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ না করা পর্যন্ত সময় দেওয়া হলো—এমন লিখিত ঘোষণা পেলেই কেবল আমরা সিদ্ধান্ত বদলাবো। আইএসপিএবির পরিচালক নাজমুল করিম ভূঁইয়া বলেন, আমরা ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে নই। তবে সিটি করপোরেশন বলছে যে বিকল্প ব্যবস্থা আমাদের করে নিতে হবে। তবে ঢাকা শহরে এই ধরনের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। যার কারণে আমরা ধর্মঘটে যাচ্ছি।

কোয়াবের সভাপতি এস এম আনোয়ার পারভেজ বলেন, আমাদের হাতে কোনো বিকল্প নেই। আমাদের কর্মসূচিতে যেতেই হচ্ছে। ক্যাবল কাটার কারণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় আমাদের ৩৫-৪০ শতাংশ নেটওয়ার্ক বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার এম এ হাকিম সাংবাদিকদের জানান, এখন পর্যন্ত ডিএসসিসির সঙ্গে আমাদের কোনো আলোচনা হয়নি। ফলে বিষয়টির কোনো মীমাংসাও হয়নি বলে তিনি জানান।

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে রাজধানীতে ঝুলে থাকা বিদ্যুৎ, ডিশ ক্যাবল, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি), মোবাইল কোম্পানি, বিটিসিএলের ল্যান্ড ফোনের তারসহ সব ধরনের তার বিশ্বের আধুনিক শহরের মতো মাটির নিচ দিয়ে স্থাপন করা হবে। এ লক্ষ্যে ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) প্রকল্পের আওতায় দুটি প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাট হোম এবং সামিট কমিউনিকেশনকে মাটির নিচে তার সরিয়ে অবকাঠামো স্থাপনের লাইসেন্স দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, তাদের তৈরি ভূগর্ভস্থ ফাইবার অপটিকসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেবা দেবে সংস্থাগুলো। 

প্রকল্প অনুযায়ী সরকারি সংস্থাগুলোর তার মাটির নিচে চলে গেলেও বেশির ভাগ ডিশ-ক্যাবল অপারেটর আর ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের তার এখনো মাটির ওপরেই রয়ে গেছে। রাজধানী ঢাকার প্রায় সব রাস্তার পাশেই মাথার ওপরে তারের জঞ্জাল। গত এক দশক ধরে এজন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা ও উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়। যদিও বেশ কিছু এলাকায় এরই মধ্যে বিদ্যুতের তার মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তবে ক্যাবল টিভি ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সহযোগিতা না পাওয়ায় এসব সেবা সংস্থার তারের জঞ্জাল এখনো মাটির নিচে নেওয়া সম্ভব হয়নি। অথচ তারের জঞ্জাল সরাতে উচ্চ আদালত ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নির্দেশ দিয়েছেন। আর এই তার অপসারণ করার নামে রশি টানাটানিতে ব্যস্ত আছে সংশ্লিষ্ট সরকারি বেসরকারি সংস্থা, রেগুলেটরি কমিশন এবং অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো।

টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে ফিক্সড ব্রডব্যান্ডের গ্রাহক সংখ্যা ৮৫ লাখ ৭১ হাজার। যদিও আইএসপিএবি বলছে সংখ্যা কোটির বেশি। বর্তমানে দেশে ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৭৫০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ব্যবহার হয়। এর মধ্যে ৯৫০ থেকে ১ হাজার জিবিপিএস ব্যবহার হয় ফিক্সড ব্রডব্যান্ডে। অবশিষ্ট ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করেন মোবাইল অপারেটররা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh