খাসোগি হত্যার দুই বছর: নৃশংসতা বাড়িয়েছে সৌদি রাজতন্ত্র

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২০, ১০:০৮ এএম

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

চলতি মাসের ২ তারিখ সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে।

এ সময়ে দুটি বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আসেনি- এক. হত্যাকাণ্ডের হুকুমদাতারা বিচারের ঊর্ধ্বে রয়ে গেছে এবং দুই. সৌদি যুবরাজ ‘এমবিএস’ খ্যাত মোহাম্মদ বিন সালমানের শাসন কাঠামোটি রাজতন্ত্রের ইতিহাসে নৃশংসতম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর সাংবাদিক খাসোগি ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে গিয়েছিলেন বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত কাগজপত্র সংগ্রহ করতে। তুর্কি বাগদত্তা হেতিজে সেঙ্গিজকে বিয়ে করার জন্য ওই কাগজপত্র জরুরি ছিল। ওই দিন তার বাগদত্তাও সাথে ছিলেন। তিনি বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। খাসোগি আর ফেরেননি। 

সৌদি আরব প্রাথমিকভাবে জানায়, দূতাবাসে প্রবেশের এক ঘণ্টার মধ্যেই খাসোগি সেখান থেকে কাজ শেষে বেরিয়ে যান। এক্ষেত্রে ধোঁকা দিতে খাসোগির কাপড় পরিয়ে তার মতো দেখতে এক লোককে ব্যবহার করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডে তাদের সংশ্লিষ্টতার দাবি অস্বীকার করে সৌদি আরব। তবে পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তারা স্বীকার করে যে, একজন সৌদি গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিজ উদ্যোগে এই হত্যা অভিযান পরিচালনা করেন। অথচ তদন্তে জানা যায়, সৌদি আরবের একদল আততায়ী দূতাবাসের ভেতরেই খাসোগিকে হত্যা করেন। এরপর টুকরো টুকরো করে রাসায়নিক দিয়ে গলিয়ে দেয়া হয়েছে দেহের প্রতিটি অংশ। 

মার্কিন তদন্ত সংস্থা সিআইএ ও পশ্চিমা দেশগুলো বলে আসছে, এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা সৌদি যুবরাজ এমবিএস। তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত দেহরক্ষী এ হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছে। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও হুকুমদাতাদের বিচারে কোনো আশার আলো নেই। এমনকি খাসোগি হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয়া জ্যেষ্ঠ সৌদি কর্মকর্তা সৌদ আল-কাহতানিকেও বিচারের আওতায় নেয়া হয়নি। 

  • (জি-২০ কার্যত এমবিএসকে দায়মুক্তি দেওয়ার সম্মেলন বলেই বিবেচিত হতে পারে- সেই সাথে তাকে আরো সাংবাদিক-অ্যাক্টিভিস্ট হত্যা-নির্যাতনের ব্যাপক ছাড় দেয়া। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশের নেতারা মাঝে-মধ্যেই চীন-রাশিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে ব্যাপক সোচ্চার হয়ে ওঠেন। এমবিএসকে দায়মুক্তি দিয়ে বিশ্বনেতাদের মানবাধিকারের কথা বলার অধিকার আছে কি-না, সেই প্রশ্ন আগামীর জন্য তোলা থাকল.....)

প্রশ্ন উঠেছে, যখন কোনো ব্যক্তি তার নিজ দেশের দূতাবাসে এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হন; তার দায় কার ওপর বর্তায়? তদন্তে পাওয়া তথ্যে এ বিষয়টি নিশ্চিত যে, হত্যাকাণ্ডটি ছিল পরিকল্পিত, দূতাবাসে হত্যার মানে এর দায় রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়। ক্ষমতা কাঠামোর শীর্ষ থেকে নির্দেশ না দিলে এমন পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা অসম্ভব। আর সৌদি রাজতন্ত্রে এখন সব ক্ষমতা রয়েছে যুবরাজের হাতে, যার আদেশ ছাড়া দেশটিতে কারও পক্ষে নিঃশ্বাস নেয়াও সম্ভব নয়!

গত মাসে সৌদি রাজতন্ত্র খাসোগি হত্যায় জড়িত আট নিচু স্তরের আততায়ীকে সাত থেকে ২০ বছর কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। জাতিসংঘের তদন্তকারী অ্যাগনিজ ক্যালামার্ড একে ‘বিচারের প্রহসন’ বলে উল্লেখ করেছেন। পুরো বিচার প্রক্রিয়া গোপনে পরিচালিত হয়েছে, এমনকি অভিযুক্তদের নামও প্রকাশ করা হয়নি। সৌদি কর্তৃপক্ষ আজ পর্যন্ত খাসোগির দেহাবশেষের সাথে কী করা হয়েছিল, তা জানায়নি।

উল্লেখ্য, একসময়ের সৌদি সরকারের প্রিয়ভাজন খাসোগি রোষাণলে পড়েন ২০১৭ সালের জুনে এমবিএস যুবরাজ হওয়ার পর। এমবিএসের উত্থান ঘটতে থাকলে খাসোগির জন্য পরিস্থিতি আরো প্রতিকূল হয়ে পড়ে। কিছু সংস্কারপন্থী নীতি গ্রহণ করলেও শুরু থেকেই ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমন-পীড়নে মনোযোগী ছিলেন তিনি। ব্যবসায়ী, অ্যাকটিভিস্ট, ধর্মীয় নেতা তো বটেই, রাজপরিবারের অনেক সদস্যও শিকার হন এমবিএসের রোষের। খাসোগিও ছেড়ে কথা বলেননি। তাই তাকে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে হয়। এ সময় তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে নিয়মিত কলাম লিখতে শুরু করেন। 

এক কলামে তিনি লিখেন, ‘সৌদি আরব এর আগে এতটা নিপীড়নমূলক রাষ্ট্র কখনোই ছিল না।’

সৌদি সরকারের সমালোচনা করে গুম হওয়া আলোচিত প্রথম ব্যক্তি নাসের আল-সাঈদ। ১৯৭৯ সালে গুম হয়ে যান তিনি। এরপর আরো অনেক অ্যাকটিভিস্টেরই এই পরিণতি হয়েছে দেশটিতে। সম্প্রতি এ ধরনের প্রবণতা আরো বেড়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে নিখোঁজ রয়েছেন সৌদি রাজপরিবারেরই তিন সন্তান। কারণ তারা সরকারের সমালোচনা করেছেন। ২০১৮ সাল থেকে অন্তত ২৫ নারী অধিকারকর্মীকে বন্দি করা হয়। তাদের কেউ এখন পর্যন্ত পুরোপুরি মুক্ত নন। কেউ কারাগারে বন্দি, কেউ গৃহবন্দি, আবার কেউ প্রতিদিন থানায় হাজিরা দিচ্ছেন। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগও নেই। 

আমিরাতে পড়াশোনা করতেন মানবাধিকারকর্মী লুজাইন আল-হাথলুল। তাকে ২০১৭ সালের মার্চে সেখান থেকে অপহরণ করে নিয়ে আসা হয় সৌদি আরবে। পরে কিছুদিন কারাগারে রাখার পর ছেড়ে দেয়া হলেও দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তার স্বামী থাকতেন জর্ডানে। তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিবাহবিচ্ছেদ করতে বাধ্য করা হয়। ২০১৮ সালের মে মাসে অধিকারকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড়ের মধ্যে আবারো আটক করা হয় লুজাইনকে। তারপর থেকে বন্দি রয়েছেন তিনি। কারাগারে বিভিন্ন সময়ে তাকে নির্যাতন করা হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে।

মার্কিন মিত্র হিসেবে সৌদি আরবের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলোও খুব বেশি আলোচনায় আসে না আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। এমনকি ইয়েমেনে দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আগ্রাসন চললেও তা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের। তবে খাসোগি হত্যাকাণ্ড খানিকটা বেকায়দায় ফেলেছে সৌদি আরবকে। বিভিন্ন পশ্চিমা লবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, নারীদের গাড়ি চালানো, থিয়েটার-সিনেমা হল খুলে দেয়ার মতো সংস্কার নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অথচ যারা এসব সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন, তারা এখনো বিনা বিচারে কারাবন্দি। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশ্ন তোলাটাই এমবিএসের কাছে সবচেয়ে বড় অপরাধ- এ কারণেই তাদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়া হচ্ছে। 

সম্প্রতি কানাডায় নির্বাসিত সাবেক সৌদি গোয়েন্দা কর্মকর্তা সাদ আলজাবরিকে হত্যার জন্য একটি আততায়ী দল পাঠানো হয়। আলজাবরিকে হত্যা করা সম্ভব না হলেও, দেশে ফিরিয়ে আনতে তার দুই সন্তান ও এক ভাইকে মুক্তিপণ হিসেবে বন্দি করে রেখেছে সৌদি রাজতন্ত্র।

জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর কোণঠাসা হয়ে পড়লেও নভেম্বরে রিয়াদে অনুষ্ঠিতব্য জি-২০ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আবারো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুনর্বাসিত হতে যাচ্ছেন এমবিএস। যদিও করোনাভাইরাস মহামারির জন্য সম্মেলনটি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হবে, তবে এতে আয়োজক হিসেবে ব্রিটেনের বরিস জনসন, ফ্রান্সের ইমানুয়েল ম্যাখোঁ, জার্মানির এঙ্গেলা মেরকেল, কানাডার জাস্টিন ট্রুডোর মতো বিশ্বনেতাদের কাতারে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পাচ্ছেন এমবিএস। 

এই জি-২০ কার্যত এমবিএসকে দায়মুক্তি দেয়ার সম্মেলন বলেই বিবেচিত হতে পারে। সেইসাথে তাকে আরো সাংবাদিক-অ্যাক্টিভিস্ট হত্যা-নির্যাতনের সুযোগ তৈরি করে দেয়া। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশের নেতারা মাঝে-মধ্যেই চীন-রাশিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে ব্যাপক সোচ্চার হয়ে ওঠেন। 

এমবিএসকে দায়মুক্তি দিয়ে বিশ্বনেতাদের মানবাধিকারের কথা বলার অধিকার আছে কি-না, সেই প্রশ্ন আগামীর জন্য তোলা থাকল।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh