শেখর দত্ত
প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২০, ০৩:২৮ পিএম
কোনো দলে অন্তর্ভুক্ত নন, তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্ধ এক সমর্থক বন্ধু গত সোমবার টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনের আগে ‘জিরো টলারেন্স’ কি দুর্নীতি বা অনৈতিক ঘটনা ঘটার আগে, নাকি পরে কার্যকর হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন? এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হবো, কখনো ভাবিনি। তাই প্রশ্নটা শুনে একটু হকচকিয়ে গেলাম। এককথায় কীভাবে উত্তর দেব? তাকে বললাম, এভাবে বলছেন কেন? তিনি বললেন, যুবলীগ নেত্রী পাপিয়া ও তার স্বামীর বিচারে ২০ বছর জেল হওয়ার পর বন্ধুদের নিয়ে এ বিষয়ে কথা হচ্ছিল। শুরুতেই সেখানে দুই পক্ষ হয়ে গেল। বন্ধুটির পক্ষ উৎসাহভরে বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স কার্যকর হতে শুরু করেছে। ধর্ষকদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং ১২০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করতে হবে বলে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, অধ্যাদেশ জারি হবে। এবার জিরো টলারেন্স কার্যকর হবে।’
আর সংখ্যায় বেশি অপরপক্ষ এটা মানতে নারাজ। তাদের কথা হলো, ‘পাপিয়া তো দলের ছত্রছায়ায় এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই সব কাজ দিনের পর দিন করে গেছে। ক্যাসিনোর ক্ষেত্রেও এটা হয়েছে। এরকম হতেই থাকবে। চাপে পড়লে কিছু ধরা হবে, শাস্তিও হবে। আবার এসবও হবে। আর ধর্ষণের আইন তো আগেও ছিল। ওটা কতটুকু কার্যকর হয়েছে। তাই আইন থাকলেই কেবল হবে না। কার্যকর করাটাই তো বড় কথা। চাপে পড়লে কিছু হয়। তারপর আবার সেই তালেই চলে। তাই জিরো টলারেন্স নীতি খাতা-পত্রে থেকে যাবে। গোড়া না কেটে আগা কাটলে কিছু হবে না। যাহা বায়ান্ন তাহা-ই তেপান্ন হবে। দুর্নীতি ও অনৈতিকতার টিকিটিও ধরা যাবে না।’
বলাই বাহুল্য, তর্ক-বিতর্কের ধরন অনুধাবন করে মন্দের মধ্যে ভালো লাগল এ জন্য যে, মানুষ দেশে দুর্নীতি ও অনৈতিকতার অবসান নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে। দেশ তো মানুষের। মানুষ যদি কেবল নিজের সমস্যা নয়, সব ধরনের সমস্যা-সংকট নিয়ে ভাবেন, সোচ্চার হন; যার যার অবস্থান থেকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে থাকেন, তবে সমস্যা-সংকট সমাধানের পথে অগ্রসর হতে বাধ্য। বন্ধুটিকে তখনকার মতো দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎসাহী হতে নানা কথা বললাম; কিন্তু তিনি তর্ক-বিতর্কের উত্তর তেমন মনমতো না পেয়ে উৎসাহিত হলেন না। কি আর করা! বাস্তবে এমন অনেক সময় আসে, শত কথা বলেও মানানো যায় না কাউকে। আবার কখনো সময়টা এমন হয়, উৎসাহিত করার দরকার পড়ে না বরং কথা বললে উৎসাহ জোটে।
প্রকৃত বিচারে বিশেষভাবে ক্ষমতাসীন দলের নামধারীদের দুর্নীতি, অনৈতিকতা, দখল-দাপট প্রভৃতি বাড়াবাড়ির মধ্যে বর্তমান সময়টা হতাশাজনক। এ হতাশাটা ছড়িয়ে পড়ছে, মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে। তদুপরি মানুষ চোখের সামনে দেখছে, ক্ষমতাসীন নামধারী একটা ক্ষুদ্র অংশ আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হচ্ছে। বখাটে, রাস্তা বা হোটেল-গ্যারেজের ছেলেটা রাতারাতি বাড়ি-গাড়ি করে ফেলছে। তাই এখন কথায় চিড়া ভেজানো খুব শক্ত। হতাশাকে উৎসাহে পরিণত করা খুব কঠিন।
ইতিমধ্যে করোনা-দুর্যোগের মধ্যেও পদ্মা সেতুর ৩২তম স্প্যান বসানো শেষ হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে চলছিল দুর্নীতির কত না কেচ্ছা! নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু হবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য বিষয় ছিল না। কত যে ভিন্নমত বা টিটকারি তখন শোনা গেছে। এখন তা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে; কিন্তু স্প্যান বসা নিয়ে কাউকে কোনো উৎসাহ প্রকাশ করতে দেখি না।
ছাত্রলীগের বিশাল ধর্ষণবিরোধী সমাবেশ প্রচারে আসে না। মাদ্রাসা বা অন্য কোথাও ধর্ষণ হলে তেমন সাড়া জাগে না; কিন্তু ক্ষমতাসীন নামধারী কেউ যুক্ত থাকলে তা বিরাট ইস্যু হয়ে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে, এ প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সবার। প্রকৃত বিচারে মানুষ পড়ে আছে, বর্তমানের দুর্নীতি-দখল-দাপট-অনৈতিকতা নিয়ে ভাবনা-চিন্তার মধ্যে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বিশেষত বন্যার কারণে বাড়ছে। মানুষ রয়েছে উদ্বিগ্নতার মধ্যে।
হাওয়া ভবনের দুর্নীতি, লুটপাট ও অনৈতিকতার কথা বর্তমান দিনগুলোতে কেউ সাধারণভাবে শুনতে চাইছে না। দুর্ভাগ্য যে, মুজিববর্ষ বা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী নিয়ে কোনো আবেগ-অনুভূতি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। বর্তমান নিয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে আছে। আইন প্রণয়নের চাইতে মানুষ প্রয়োগ নিয়ে ভাবছে। মনে করছে প্রয়োগ হবে না। বিষয়টা ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের জন্য খুবই উদ্বেগের কারণ হওয়া প্রয়োজন।
তাই কথাটা তো রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এক নয়। এর মধ্যে দলে বাড়ছে দুর্নীতি-দখল-দাপট-অনৈতিকতা। যেন অনেকটা ঝড়ের মতো। মনে করার কারণ রয়েছে যে, এটা এ পর্যায়ে এসে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তাই বিএনপির বিপরীতে মানুষ যেভাবে আওয়ামী লীগের ওপর ভরসা করত, সেই ভরসা কিন্তু আর তেমনভাবে থাকছে না। দুর্নীতি-দখল-দাপট-অনৈতিকতা খোদ আওয়ামী লীগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এখন মানুষ প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগ দেখার অপেক্ষা করছে।
প্রসঙ্গত বলতেই হয়, দুর্নীতি ও অনৈতিকতা বিষয়ে প্রচারের ধরন বা ঘটনাগুলোর বেশি করে রাজনৈতিক রঙ দেওয়া এবং এমনকি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়ার মধ্যে কারও কোনো ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত থাকতেই পারে; কিন্তু এর সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে কেন, তাও ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। কোথায় দল ও দলীয় নেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রক্ষা করবে তা নয়, বরং দেশের শেষ ভরসার জায়গাটাকে পর্যন্ত আঘাত করে চলছে। প্রায় একযুগ ক্ষমতায় থাকার পর এবং উন্নয়নের ধারায় দেশকে এগিয়ে নেওয়ার পর এমনটা কল্পনা করা যায় না।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আরোহণের পর ক্ষমতার প্রসাদ জুটেছিল আমার কপালে। প্রথমে অগ্রণী ব্যাংক এবং সুবিখ্যাত হলমার্ক কেলেংকারির পরে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদে তিন বছর করে ছয় বছর পরিচালক ছিলাম। বন্ধুরা অনেকেই বলেছেন, এটা নাকি আমার রাজনৈতিক কাজের স্বীকৃতি। অবশ্য স্বীকৃতির ব্যাপারটার কোনো বিষয় বলে না ভেবে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নিমজ্জিত হয়ে অভিজ্ঞতা নিতে চেষ্টা করেছি। সিপিবি করার সময় মাঠে-ময়দানের অভিজ্ঞতার পাঠ নিয়েছিলাম।
ব্যাংকে পদায়ন হওয়ার পর প্রথমেই ভেবে নিয়েছিলাম সুযোগ যখন পেয়েছি, তখন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কীভাবে চলে এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা নিতে হবে। অ্যাকাউন্টিংয়ের বকলম এক ব্যক্তি, যিনি নিজের ব্যালেন্সসিটের বামদিক আর ডানদিককে কোনোদিন মিলাতে পারেনি, সেই আমি অডিট কমিটির সদস্য হয়ে, বিজ্ঞজনদের সঙ্গে কাজ করেছি। তখন বৈঠকগুলোতে প্রায়ই বলতাম, দুর্নীতি হওয়ার পর অডিটে দুর্নীতিবাজ ধরা পড়ে; কিন্তু আগে ধরার উপায় কী? ধরা পড়ার পরও আছে ঝামেলা। প্রমাণ করতে হবে তিনি দোষী। দিতে হবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ। দোষী হিসাবে রায় বের হওয়ার আগে তাকে দোষী বলা যাবে না। সে এক সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া। তারপর আছে তদবির। দুর্নীতিবাজদের আবার চেইনটা ভালোই থাকে। আমার মনে হয়েছে এ যেন এক গোলক ধাঁধা!
কত স্লোগান, বক্তৃতা আর লেখালেখি করেছি লুটপাটের অর্থনীতি নিয়ে; কিন্তু বাস্তবতা কঠিন ও জটিল। এখনো ভাবি হলমার্কের টাকাটা তো জনগণের, রাষ্ট্রের। ওটার কি হবে! কি হয়েছে! এর অবশ্য আর খোঁজ পাইনি। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্রে যদি এই অবস্থা চলে এবং বিচার যদি প্রলম্বিত হয়; তবে নিচে কী হতে পারে! কেননা এটা তো আমাদের জানাই আছে যে, দুর্নীতি হচ্ছে বহুমাত্রিক ব্যাধি। পেশিশক্তির ব্যবহার ও অপরাধের শিকড় রয়েছে দুর্নীতির মধ্যে। যার ফলে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে অবক্ষয় বা পচন শুরু হয়। তাই অর্থনীতি রাজনীতি শিক্ষা স্বাস্থ্য প্রশাসন প্রভৃতি কোনো ক্ষেত্রেই ইস্পিত লক্ষ্য অর্জিত হয় না।
সবশেষে প্রাচীন ভারতের কৌটিল্যর সঙ্গে তুলনীয়, ইতালির রেঁনেসার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের রূপকার, যার ভাগ্যে প্রশংসা-সমালোচনা দুই-ই সমান জুটেছে। বেকন-হেগেল-স্পিনোজা-রুশো প্রমুখ জ্ঞানী-গুণীরা যার প্রশংসা করেছেন, সম্রাট নেপোলিয়ান আর ক্রমওয়েল যার বই হাতে রাখতেন, আবার যাকে বলা হতো ‘বদের ওস্তাদ’; সেই নিকোলাই মেকিয়াভেলির কথা স্মরণ করে গভীর বেদনা নিয়ে লেখাটা শেষ করছি। মেকিয়াভেলির বিশ্বাস ছিল: ‘সবদিক থেকে যে ব্যক্তি নির্মল ও সততাশীল হতে ইচ্ছুক, অচিরে বা বিলম্বে অসাধু সংখ্যাধিক্যের মধ্যে তার ধ্বংস অনিবার্য।’ তিনি লিখেছেন যে, রাষ্ট্রকে মজবুত করার জন্য যে কোনো উপায়ের আশ্রয় নিতে হবে, প্রয়োজন দেখা দিলে হতে হবে নিষ্ঠুর। রাষ্ট্র নিষ্ঠুর হবে? সৎ সব ধ্বংস হবে? আসলে এসব ভাবতেই পারি না। তার উক্তি দিয়েই লেখাটা শেষ করছি, ‘সৎ মানুষের কর্তব্য হলো দুঃসময় ও ভাগ্যের খেলায় যে শুভটা সে নিজে সাধন করতে পারেনি, সেটা অন্যদের শেখানো পথে সম্ভব না।’
শেখর দত্ত
কলাম লেখক, রাজনীতিক