ফ্রান্সে ইসলামের বাস্তবতা

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২০, ১০:২২ এএম

ফ্রান্সে এক শিক্ষককে হত্যার পর ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাখোঁ তথাকথিত ‘উগ্রবাদী ইসলামের’ বিরুদ্ধে অভিযানের ঘোষণা দেন। 

অভিযানের শুরুতেই এক মসজিদের ইমামের তথাকথিত ‘উগ্রবাদী’ চিন্তা ধারণ করার জন্য মসজিদটিকেই বন্ধ ঘোষণা করা হয় ও আরো কঠোর পদক্ষেপ আসছে বলে উল্লেখ করা হয়। 

কিছুদিন আগেই প্যারিস থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে এক শহরে ৪৭ বছর বয়সী স্কুল শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি ফরাসি কারিকুলাম অনুযায়ী বাক স্বাধীনতা বিষয়ে পড়াতে গিয়ে ২০১৫ সালে শার্লি এবদো ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদের (সা.) ব্যাঙ্গচিত্র প্রদর্শন করেন। এরপর এক মুসলিম ছাত্রীর বাবা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে ছাত্রদের সামনে অশ্লীল ছবি প্রদর্শনের অভিযোগ করেন। অনলাইন ভিডিওতে প্যাটির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা ছাড়াও তিনি প্যাটির পদচ্যুতি দাবি করেন। এরপর গত ১৬ অক্টোবর প্যাটিকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করেন ১৮ বছর বয়সী চেচেন বংশোদ্ভূত শরণার্থী আব্দুল্লাখ আবুইয়েদোভিচ আনজোরভ। 

আনজোরভ এক অডিও বার্তায় বলেন, তিনি নবী মুহাম্মদের (সা.) অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছেন। এরপর পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু হয়। 

ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর চ্যানেলকে এক ছাত্র বলেন, প্যাটি প্রতি বছরই বাক স্বাধীনতা পড়াতে গিয়ে মুহাম্মদের (সা.) ব্যাঙ্গচিত্র ছাত্রদের দেখাতেন। এই হত্যাকাণ্ডের দুদিন পর আইফেল টাওয়ারের কাছে দুইজন নারী হিজাব পরিহিত অপর দুই মুসলিম নারীকে ছুরিকাঘাত করে। আক্রমণের সময় তারা মুসলিম নারীদেরকে ‘নোংরা আরব’ বলে গালি দেন। এই ঘটনাগুলো ফরাসি সমাজে ইসলামোফোবিয়াকেই শুধু সামনে টেনে আনছে না, ফ্রান্সের সেক্যুলার সংস্কৃতির ভিতের মাঝে পরস্পরবিরোধী চিন্তাগুলোকেও আলোচনায় নিয়ে আসছে।

ফরাসিরা প্যাটির হত্যাকাণ্ডকে ফরাসি রিপাবলিকের ওপর হামলা হিসেবে দেখছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ বলেছেন, ‘প্যাটি হলো ফরাসি রিপাবলিকের প্রতিচ্ছবি।’ ফ্রান্সের পার্লামেন্টে জাতীয় সংগীতের পরপরই এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় প্যাটির জন্য। পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ফেরান্ড বলেন, “প্যাটির হত্যাকাণ্ডে ফ্রান্স ঐক্যবদ্ধ, কারণ প্যাটির পেছনেই রয়েছে ‘হিউম্যানিস্ট’ ফরাসি রিপাবলিক।” 

ফরাসি স্বরাষ্ট্র দফতর জানায়, বন্ধ করে দেয়া মসজিদ থেকে প্যাটিকে ভীতি প্রদর্শন করতে আহ্বান জানানো হয়েছিল। তাদের দাবি, মসজিদ থেকেই প্যাটির হত্যার ‘ফতোয়া’ আসে। ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন আরো একধাপ এগিয়ে টেলিভিশনে এসে বলেন, ‘ফ্রান্সের সুপার মার্কেটে বিভিন্ন জাতির জন্যে আলাদা খাবার পাওয়া যায়। ফলে ফ্রান্সের ঐক্য প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে ও বিচ্ছিন্নতা দানা বাঁধছে।’ 

ফরাসি মানবাধিকারকর্মী ইয়াসির লুয়াতি সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে বলেন, ‘ফ্রান্সে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার নামে সর্বত্র ক্যামেরা বসানো হয়েছে, অনেক আইন পাস হয়েছে ও ইন্টারনেটে গোয়েন্দাগিরি করা হচ্ছে; কিন্তু তারপরও এমন ঘটনা রাষ্ট্রের ব্যর্থতারই প্রকাশ। নির্বাচনের ১৮ মাস আগে প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ মহামারি ও অর্থনৈতিক দৈন্যতা ঢাকতে এক ব্যক্তির কর্মকাণ্ডকে ব্যবহার করে পুরো মুসলিম সমাজকে টার্গেট করছেন।’ 

ম্যাখোঁ বলছেন, ‘ফ্রান্স ঐক্যবদ্ধ’। তবে সেই ঐক্যের মাঝে মুসলিমরা নেই। একইসাথে তিনি ডানপন্থীদের মাঝেও তার সমর্থন বৃদ্ধি করতে চাইছেন। ইসলামোফোবিয়া কমাতে কাজ করা মুসলিম এনজিওগুলোকেও টার্গেট করা হচ্ছে। তবে ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবীরা ফ্রান্সে ইসলামোফোবিয়া রয়েছে, সেটি স্বীকার করতে নারাজ। দ্য গ্লোবাল পলিসি রিসার্চের সিনিয়র ফেলো জ্যঁ রোঁলা বলেন, ‘ফ্রান্স নিজেকে সেক্যুলার ধারণার ঝাণ্ডাবাহী মনে করে; যেখানে মানুষের আইনকে স্রষ্টার আইন থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। আর ফরাসিরা এই চিন্তাকে রক্ষা করতে সবকিছু করবে।’ 

তিনি আরো বলেন, “‘উগ্রবাদী ইসলামের’ বিরুদ্ধে যথেষ্ট শক্ত ভূমিকা না নেয়ার সমালোচনা রয়েছে ম্যাখোঁর বিরুদ্ধে। ফ্রান্সের সমস্যা ইসলামোফোবিয়া নয়, বরং ইসলামের রাজনৈতিক চিন্তাই আসল সমস্যা।” 

ফরাসি পত্রিকা লে ফিগারোর প্রবীণ সাংবাদিক রনোঁ জিরাঁদ আরো কঠোর ধারণা পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘মুসলিমরা ফ্রান্সে এসে বিনামূল্যে শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার পর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে বরং ফরাসি সেক্যুলার স্কুল, যা তাদের সমাজের একটা স্তম্ভ, সেটিকে আক্রমণ করেছে। ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীতে মুসলিমরা রয়েছে; অনেক মসজিদও রয়েছে ফ্রান্সে। তবে ফ্রান্সের সেক্যুলার চিন্তা বলছে, ধর্ম ও রাজনীতি থাকবে আলাদা। নিজের বাড়িতে ধর্মকর্ম করায় কোনো বাধা থাকবে না; তবে প্রকাশ্যে ধর্মের কোনো ভূমিকাই থাকবে না। যারা ফ্রান্সের এই চিন্তাধারাকে ভালোবাসতে পারে না, তাদের ফ্রান্স ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।’ 

ওয়াশিংটন পোস্ট মনে করিয়ে দিচ্ছে, ১৯০৫ সালে ফ্রান্সে যে সেক্যুলার আইন তৈরি হয়েছিল, তা মূলত ক্যাথলিক চার্চের প্রভাবকে কমানোর জন্য। সে সময় ফ্রান্সের বেশিরভাগ জনগণই ছিল ক্যাথলিক। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স তার উপনিবেশগুলোকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলে বহু মুসলিম ফ্রান্সে এসে হাজির হয়; এভাবেই ফ্রান্সে ইসলামের আবির্ভাব হয়। বর্তমানে ফ্রান্সে মুসলিম জনসংখ্যা একেবারে কম নয়; যা ফ্রান্সের বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ১৯৬২ সালে আলজেরিয়া থেকে ফ্রান্সের লজ্জাজনক বিদায়ের পর ফরাসিদের কাছে ইসলামের একবিন্দু উপস্থিতিও অসহ্য হয়ে দাঁড়ায়। যদিও ফ্রান্সে ক্যাথলিক অনুষ্ঠানের দিনগুলোতে এখনো রাষ্ট্রীয় ছুটি থাকে, অথচ ইসলামের যে কোনো দৃশ্যমান ব্যাপারকে ফরাসিরা তাদের সেক্যুলার চিন্তার বিরোধী হিসেবে দেখতে থাকে। যেমন হিজাব বর্তমানে ফ্রান্সে সবচেয়ে আলোচ্য বিষয়গুলোর একটা। 

ফ্রান্সের সেক্যুলার আদর্শের মাঝেই পরস্পরবিরোধী অবস্থান রয়েছে। বাক স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সেক্যুলার চিন্তার ভিত্তি হিসেবে ধরলেও ধর্মীয় আবেগকে আঘাত করেই তারা বাক স্বাধীনতাকে ওপরে স্থান দিয়েছে। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্যাথলিকদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করলেও সংখ্যালঘু মুসলিমদের অনুভূতি তাদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। উল্টো মুসলিমদের ধর্মকর্ম পালনকে ফরাসিরা দেখেছে ফ্রান্সের সেক্যুলার ব্যবস্থার প্রতি হুমকি হিসেবে। 

ফ্রান্স এখন দ্বিধাবিভক্ত- মুসলিমরা কি ফ্রান্সের সেক্যুলার বাস্তবতার শিকার; নাকি ফরাসিরা ইসলামিক বাস্তবতার শিকার? তারা কি ইসলামোফোবিয়া কাটাতে ইসলামকে পরিবর্তন করতে উদ্যত হবে; নাকি সেক্যুলার আইনের চাপে সহিংসতাকে আরো বৃদ্ধি করবে? যেদিকেই তারা পা বাড়াক না কেন, ফরাসি রিপাবলিক যে আরো দুর্বল হচ্ছে, তা এখন নিশ্চিত।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh