হাসন রাজার প্রপৌত্রের পাঠ-প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে

হেলাল মহিউদ্দীন

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২০, ১১:৪৯ এএম

হেলাল মহিউদ্দীন

হেলাল মহিউদ্দীন

সাম্প্রতিক দেশকাল অনলাইনে ১ নভেম্বর ২০২০ সংখ্যায় জনাব সামারিন দেওয়ানের লেখা একটি পাঠ-প্রতিক্রিয়া আমার নজরে এসেছে। ‘কী ঘর বানাইলাম আমরা?’ শিরোনামে আমার একটি কলামের বিপরীতে জনাব দেওয়ান তার পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। 

উল্লেখ্য আমার লেখাটির বিষয়বস্তু হাসন রাজা ছিলেন না। নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে লিখতে গিয়ে হাসন রাজা সম্পর্কিত একটি ‘লোকগল্প’ অনুক্রমনিকায় উল্লেখ করা ছিল। আমি লিখেছিলাম- “পিতামহের কাছে একটি ‘লোকগল্প’ শুনেছিলাম। ‘সত্য-মিথ্যা’ যাই হোক, সেই গল্পটি এ রকম- ক্ষমতার দাপটে দেওয়ান হাসন রাজা চূড়ান্ত লম্পট হয়ে ওঠেন। এটি যে ‘লোকগল্প’ তা বলেছি। সত্য-মিথ্যা নিয়ে যে আমার নিজেরই সন্দেহ আছে শুরুর দুই বাক্যেই তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছি। তবু জনাব দেওয়ান সরাসরি আক্রমণ করে বসেছেন। লিখেছেন- ‘লেখক হেলাল মহিউদ্দীন কলামটিতে মরমি শিল্পী দেওয়ান হাসন রাজা সম্পর্কে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলেছেন’।”

জনাব দেওয়ানের পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্তিগত ক্রোধ যেভাবে উপছে পড়েছে, তা একজন মিউজিয়মের কিউরেটরের নিকট হতে একেবারেই অপ্রত্যাশিত। লোকগল্পটি যে বহুল প্রচলিত সেই প্রমাণ তাৎক্ষণিক গুগল সার্চ হতেই দিচ্ছি। ইচ্ছে আছে পরবর্তিতে এই বিষয়ে যতটুকু সম্ভব আরো তথ্যের সন্নিবেশ ঘটানোর। লোকগল্পের প্লট হুবহু এক থাকে না। দেখা যাক আমি ব্যতীত আর কে কে কী কী লিখেছেন-

‘অত্যাচারী জমিদার থেকে বাউল সাধক হাসন রাজা’ শিরোনামের নিবন্ধে নিবন্ধকার সাইফ ইমন লিখেছেন, ‘হাসন রাজা নাইওরি নৌকায় হামলা করতেন। নৌকা থেকে মেয়েদের তুলে নিয়ে যেতেন। এভাবে চলতে থাকলে একদিন হাসন রাজার মা নাইওরি নৌকায় নিজেকে তার শিকার হিসেবে উপস্থাপন করেন। হাসন রাজা যখন দেখলেন তার নিজের মা-কে তিনি তুলে নিয়ে এসেছেন তখন লজ্জা পেয়ে হাসন রাজা এ পথ থেকে ফিরে আসেন। হাসন ক্ষমা চেয়ে মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়েন। এর পরই তার মধ্যে বৈরাগ্যের সূচনা হয়েছিল।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৪ অক্টোবর, ২০১৯)। 

অজানা হাসন রাজা শিরোনামের নিবন্ধে নিবন্ধকার সেলিনা আক্তার লিখেছেন--‘…যৌবনে তার হাওরের নাইওরি নৌকায় হামলা চালানোর ঘটনা। মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে যেতেন। তাকে ফেরানোর জন্য তার মা নিজে একদিন নাইওরি নৌকায় অজ্ঞাত নাইওরি সেজে যাত্রা করেছিলেন এবং লজ্জাকর অবস্থায় ফেলে ছেলেকে এই সর্বনাশা পথ থেকে ফিরিয়েছিলেন।’ (প্রথম আলো, ৮ জুলাই ২০১৭ উত্তর আমেরিকা সংস্করণ)।

“...যৌবন এবং অর্থ তাকে করে তোলে ব্যভিচারী। ভোগবিলাস আর নারী সম্ভোগে তিনি হয়ে উঠলেন অক্লান্ত। নিজের এই লাম্পট্যকে তিনি নিজেই একটি গানে লিখেছিলেন- ‘সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া’। নিত্য নতুন নারী সঙ্গী ও নতর্কীভোগী হাসান রাজার ঘরে একদিন তার মা নর্তকীর বেশে এলেন।” (শৌনক দত্ত তনু, হাসন রাজা, মুক্তগদ্য, এপ্রিল ১৫, ২০১৩)।

সরাসরি নারীদের তুলে নেয়ার তথ্য না হলেও তার লাম্পট্য বিষয়ক বয়ান যথেষ্ঠই আছে। হাছন রাজা ও তার বাউল ভাবদর্শন গবেষণা নিবন্ধে তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী লেখেন, “হাছন রাজা- ধমনিতে তার জমিদারের নীল রক্ত, হাতে ভোগের উপচে পড়া পেয়ালা এবং জীবনের এক অংশ ভোগ-সম্ভোগে মত্তও ছিলেন তিনি।”  অল্প বয়সে জমিদারি, সংসার ও বিপুল বিত্তবৈভব হাতে পেয়ে জমিদার হাছন রাজা কিছুটা বেপরোয়া হয়ে ভোগ-বিলাসে মেতে ওঠেন। নারীর প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। হাছন পরিবারের উত্তরসূরি সাদিয়া চৌধুরী পরাগ ‘প্রেম বাজারে হাছন রাজা’ নিবন্ধে লেখেন, ‘জমিদার দেওয়ান হাছন রাজা যৌবনে বহু সুন্দরী রমণীর শয্যাসঙ্গী হয়ে সন্তান-সন্তানাদির জন্মদান করেছিলেন।’ (প্রসঙ্গ হাছন রাজা- আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত। বাংলা একাডেমি, ঢাকা। ১৯৯৮, পৃষ্ঠা. ১৪৮)। 

হাছন দৌহিত্র অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ জানান, ‘কবির ৪ জন পত্নী ছাড়াও ১৬ জন উপ-পত্নী ছিল’ (অন্য দিগন্ত, আগস্ট ১৭, ২০১৯)।

 “হাসন যৌবনে ছিলেন ভোগবিলাসী এবং সৌখীন। নারীদের সাথে মেলা-মেশা ছিল তার নিত্যদিনের ঘটনা। প্রতি বছর, বিশেষ করে বর্ষাকালে, নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ নৌবিহারে গিয়ে কিছুকাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে রাখতেন বলে বিশেষজ্ঞ পাঠ ও শ্রুতি থেকে জানা যায়।” (হারুনুর রশীদ, হাছন রাজাকে নিয়ে নতুন নাটক ‘হাছনজানের রাজা”, মুক্তকথা, মার্চ ২২, ২০১৯)

উপরের উদাহরণগুলো হতেই স্পষ্ট যে লোকগল্পটির টীকাভাষ্য আমি একাই টানিনি। আমার লেখা টীকা-লোকগল্পটি খোদ সিলেটেই  বহুল প্রচলিত। হাওড়ে ইউএনওমেনের ‘জেন্ডার-বেইজড ভায়োলেন্স’ প্রকল্পে গবেষণার কাজ করতে গিয়েও এই একই লোকগল্পই খানিকটা ভিন্নভাবে শুনেছি। আমার কাছে গল্পই মনে হয়েছে। আমার কলামে ‘লোকগল্প’ উল্লেখ সহকারে উদাহরণটি টানা হয়েছে একটি আক্ষেপ প্রকাশ করার রূপক হিসেবে। নারীলিপ্সু হাসনকে ঠেকাতে হাসনের মা নিজেই একদিন নববধূ সেজে হাসনের বাগানবাড়িতে নীত হন। এই উপক্রমনিকার আলোকে উপসংহারে লিখেছিলাম, ‘সেদিনের হাসনের শিক্ষা হয়েছিল। মা সার্থক হয়েছিলেন। হাসন নিবৃত্ত হয়েছিল। এ যুগের হাসনরা অনেক বেশি ক্রুর, নিষ্ঠুর ও বীভৎস। দুনিয়াবি লোভে লোভাতুর এই যুগের হাসনদের নিবৃত্ত হবার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়।’ লোকগল্পে অনেক কাল্পনিক বিষয় থাকে। ‘বাগানবাড়ি’ও যেহেতু আমার গল্পকারের সূত্র হতে শোনা- সঠিক তথ্য হয়ত নাও হতে পারে!

তিনি অভিযোগ করেছেন- “সত্যিকারের” কোনো “প্রমাণ পত্রের” হদিস দিইনি। প্রমাণ-পত্র দেয়া একেবারেই অনাবশ্যক ও অপ্রয়োজনীয় ছিল বলে দিইনি। কারণ লেখাটি হাসন রাজা বিষয়ক মোটেই নয়, গবেষণা প্রবন্ধও নয়। পত্রিকার কলাম গবেষণা প্রবন্ধ নয়। অন্য লেখা হতে দেয়া উপরের প্রমানগুলোই “লোকগল্প” সম্পর্কিত “সত্যিকারের প্রমাণ”। “লোক্গল্প” বলতে কি কারো ব্যক্তিগত কথা বা সিদ্ধান্ত বুঝায়, না-কি জনশ্রুতি বুঝায়? বর্তমান লেখকের মত বুঝায়? মোটেই নয়। “লোকগল্প”টি যে অন্যদের শ্রুতিকথন, এবং টীকাভাষ্য মাত্র, তা আটপৌরে পাঠকেরও বোঝার কথা। সেই অর্থে একজন মিউজিয়ম পরিচালকের “সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলছেন” শব্দবন্ধের ব্যবহার নিতান্তই অশালীন ও আপত্তিকর। 

নৃবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই বলছি সক্রোধ প্রতিক্রিয়াটি অ-কিউরেটরসুলভ ও অ-লেখকসুলভ। তিনি কি “লোকগল্প” বা জনশ্রুতি কী সেই সম্পর্কে মোটেই ওয়াকিফহাল নন? তার মিউজিয়মে কি লোকগল্প বা জনশ্রুতিগুলোর সংগ্রহ রাখা হয় না? হাসন রাজা সম্পর্কিত নেতিবাচক লেখা, দলিল-দস্তাবেজ কি অবাঞ্চিত ও অগ্রহণযোগ্য? পেশাদার কিউরেটরগণ নির্মোহ হন, এবং কখনোই আবেগের আতিশয্যে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে ওঠেন না। অপ্রীতিকর তথ্যও তাদের কাছে সমান গুরুত্ববহ। 

একজন লিখিয়ে হিসেবে প্রত্যাশা জনাব দেওয়ান “লোকগল্প” শব্দটি ব্যবহারের অন্তর্নিহিত যৌক্তিকতা বোঝার চেষ্টা করবেন। “সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলছেন” না লিখে ‘লোকগল্পটি সঠিক নয়’ লিখলে তার প্রতিক্রিয়াটি বিশেষ শোভন ও রুচিশীল হাসন-পাঠ হয়ে ওঠতে পারত। সবশেষে হাসন রাজা সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্যের সন্নিবেশ ঘটানোর জন্য জনাব দেওয়ানকে অশেষ ধন্যবাদ। 

- লেখক ও অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh