‘সবার কাছ থেকেই ভ্যাকসিন সংগ্রহের চেষ্টা করতে হবে’

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২০, ০৯:২৯ এএম | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৩০ এএম

ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন আনার ব্যাপারে বাংলাদেশ যে প্রাথমিক চুক্তি করেছে তা ইতিবাচক। 

অন্তত তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আসছে সিরাম থেকে। এতে করে দেড় কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দিয়ে নিরাপদ রাখা যাবে। কিন্তু দেশের অবশিষ্ট সাড়ে ১৫ কোটি মানুষ সুরক্ষার বাইরে রয়ে যাবে। তাদের জন্য যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিন আনার চেষ্টা করতে হবে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ভারত নির্ভরতা নয়, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিটি কোম্পানির ভ্যাকসিন বাংলাদেশে আনা উচিত। তাহলে সব ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সম্পর্কে যেমন জানা যাবে, তেমনি কোন ভ্যাকসিনটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য অধিক উপযুক্ত তাও জানা হয়ে যাবে। ভ্যাকসিন আনার ক্ষেত্রে যেমন দর কষাকষির সুযোগ থাকবে, তেমনি উন্নত ভ্যাকসিন বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও এ সুযোগটি কাজে লাগানো যাবে।

এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে নিজের শরীরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে প্রতিটি মানুষকে কমপক্ষে দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিতে হবে। এক ডোজ নেয়ার ২৮ দিন পর আরেক ডোজ ভ্যাকসিন নিতে হবে। এভাবে গোটা দেশ সুরক্ষিত করতে অন্তত ৩০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োজন হতে পারে।

তাছাড়া সামনের দিনগুলোতে মানুষকে ‘করোনাভাইরাস থাকবে’ এ বাস্তবতা মেনে নিয়েই টিকে থাকার চেষ্টা করতে হবে। ফলে সবাইকে দুই ডোজ ভ্যাকসিন দেয়ার পর আরো ভ্যাকসিন সংগ্রহে রাখতে হবে। কারণ ছয় মাস অথবা এক বছর পর্যন্ত দুই ডোজ ভ্যাকসিনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকবে বলে ধারণা দেয়া হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে। ফলে সামনের দিনগুলোতে প্রতি বছরই হয়তো বিশালসংখ্যক ভ্যাকসিনের দরকার হবে।

সম্প্রতি বৈশ্বিক ড্রাগ জায়ান্ট ফাইজার ও জার্মানির বায়োএনটেকের যৌথ প্রচেষ্টার ভ্যাকসিন ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ওই ভ্যাকসিনটিও দেশে আনার চেষ্টা করতে হবে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘বেক্সিমকোর মাধ্যমে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিনের জন্য চুক্তি করায় ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে গেল। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদন করে বিক্রি করবে। আমাদের আরো ভ্যাকসিন লাগবে। তবে সিরাম ইনস্টিটিউট হয়তো তিন কোটির বেশি ভ্যাকসিন বাংলাদেশকে দিতে পারবে না। কারণ তাদের ভারতের জনগণকে আগে ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে হবে। সেইসাথে অন্যান্য দেশের সাথে সম্পাদিত চুক্তির আলোকেও ভ্যাকসিন দিতে হবে। তাই বাংলাদেশ সরকারকে যেসব দেশ বা কোম্পানি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা করছে, সবার কাছেই যেতে হবে। সবার কাছ থেকেই ভ্যাকসিন সংগ্রহের চেষ্টা করতে হবে। এভাবে সব কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে পারলে, দেখা যাবে দেশের সব নাগরিকের জন্য ভ্যাকসিন সংগ্রহ হয়ে যাবে।’

উল্লেখ্য, ভারত থেকে বেক্সিমকো ফার্মা ভ্যাকসিন এনে সরকারকে সরবরাহ করবে। সরকার বেক্সিমকো থেকে ভ্যাকসিন কিনে নেবে। প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের দাম পড়বে সাড়ে চারশ’ টাকা। বেক্সিমকো প্রাথমিক পর্যায়ে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আনার চুক্তি করেছে। এটি অবশ্য একটি প্রাথমিক চুক্তি। এখন পর্যন্ত ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও সুইডিশ-ব্রিটিশ কোম্পাানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা ঘোষণা করতে পারেনি যে, তাদের ভ্যাকসিন মানব শরীরে কত শতাংশ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা (অ্যান্ডিবডি) গড়ে তুলতে পারবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, কোনো ভ্যাকসিন মানব শরীরে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে সে ভ্যাকসিনই মানব দেহে প্রয়োগের অনুমতি দেয়া হবে। প্রসঙ্গত, যেকোনো ওষুধ বৈশ্বিক বাজারে বিক্রি বা প্রয়োগ করতে হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়।

এ বিষয়ে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘চীনা পণ্য বিশ্ব বাজারে খুবই সস্তা দরে বিক্রি হয়। সে হিসাবে সরকার দর কষাকষি করলে চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন সস্তায় কিনতে পারবে। এখন পর্যন্ত সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন অভ্যন্তরীণভাবে প্রতিটি ডোজ ৬০ ডলারে (প্রায় পাঁচ হাজার ১০০ টাকা) বিক্রি হচ্ছে। সরকার ইচ্ছা করলে সে ভ্যাকসিন অনেক কম দামে কিনে আনতে পারে। ইন্দোনেশিয়া সাড়ে ১২ ডলারে চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন কেনার প্রাথমিক চুক্তি করেছে। বাংলাদেশের সাথে অবশ্য চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক অনেক ভালো। আবার বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে বলে চীনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক বেশি। চীনারাও চায় বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে। বাংলাদেশ সরকার আমাদের দেশের এ অবস্থানটি দেখিয়ে চীনা ভ্যাকসিন কম দামে নিয়ে আসতে পারে একটু চেষ্টা করলেই।’

ডা. লেলিন চৌধুরী রাশিয়ান ভ্যাকসিন আনার জন্য প্রচেষ্টা চালাতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রথম দিকে রাশিয়া তাদের ভ্যাকসিনের ব্যাপারে কোনো তথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে না দিলেও, তারা ল্যানসেটের মতো বিখ্যাত সাময়িকীতে ওই ভ্যাকসিন বিষয়ক পর্যালোচনা পাঠিয়েছে। ল্যানসেট যাচাই না করে কোনো গবেষণা পত্র ছাপায় না। ফলে বলা যায়, রাশিয়ান ভ্যাকসিনও বেশ কার্যকর।

লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘রাশিয়ান ভ্যাকসিনের ট্রায়াল ভারতেও হচ্ছে। সিরাম ইনস্টিটিউট ছাড়া আরও দুটি বায়োটেক কোম্পানি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উৎপাদনে কাজ করছে। তবু তারা রাশিয়ান ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করছে। কারণ ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের জন্য ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে হবে। বাংলাদেশেরও উচিত রাশিয়ান ভ্যাকসিন নিয়ে আসা।’

ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে রাশিয়ান ভ্যাকসিন তুলনামূলক সস্তা হবে বলেও মনে করেন তিনি।

উল্লেখ্য, চীনা ও রাশিয়ান ভ্যাকসিনের ব্যাপারে শুরুর দিকে যত বিরূপ প্রচারণা ছিল, এখন অনেকটা কমে গেছে। বিশেষ করে ল্যানসেটে রাশিয়ার ভ্যাকসিনের গবেষণা পত্র প্রকাশিত হওয়ার পর বিরূপ প্রচারণা বন্ধ হয়ে গেছে। ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণা পত্রে দেখা গেছে, রাশিয়ার ভ্যাকসিন দ্বিগুণ কার্যকর।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh