ড্যাপে বিদ্যালয়ভিত্তিক অঞ্চল ঠেকাতে তৎপর আবাসন ব্যবসায়ীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৪৫ এএম

সম্প্রতি জনসাধারণের মতামত গ্রহণের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে সংশোধিত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)। সেখানে এমন অনেক কিছুই রয়েছে, যা নগরবাসীর জন্য স্বস্তির সংবাদ বয়ে আনতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

তবে একইসাথে এই ড্যাপকে নিজেদের সুবিধা মতো পরিবর্তন-পরিবর্ধনের জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রিয়েল এস্টেট ও ল্যান্ড ডেভেলপার কোম্পানিগুলো।

নতুন এই অঞ্চল পরিকল্পনায় এমন বেশ কিছু বিষয় যৌক্তিকভাবে উত্থাপিত হয়েছে, যা ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যেসব প্রস্তাবনা এই প্রস্তাবিত ড্যাপে দেয়া হয়েছে, তা নগরজীবনে সময়, অর্থ ও শারীরিকভাবে ইতিবাচক ভূমিকা পালনে ব্যাপক সহায়ক হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। 

প্রস্তাবিত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১৬-২০৩৫ এর আওতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ শিক্ষা সেবার উন্নয়ন; সেখানে বলা হয়েছে, পুরো রাজউক এলাকায় বিদ্যমান সরকারি বিদ্যালয়ের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। যে কারণে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার চাহিদা পূরণে বিদ্যালয়গুলো অক্ষম। আবার বর্তমান বিদ্যালয়গুলোর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বেশির ভাগ স্কুল বিক্ষিপ্ত বা বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

ড্যাপ পরিকল্পনায় বলা হয়, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার চাহিদা মেটাতে অক্ষম হওয়ার সাথে সাথে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। এ কারণে প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় বিদ্যালয়গুলো জনসংখ্যার ঘনত্ব অনুসারে বণ্টন করা হয়েছে। এছাড়া বিদ্যমান বেশিরভাগ বেসরকারি বিদ্যালয়ের খরচ বহন করা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। এ কারণে বিদ্যালয়গুলোর সুযোগ-সুবিধা সাধারণ মানুষের আওতার মধ্যে দেয়ার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত বিদ্যালয়গুলো সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সংবিধানের অবস্থান তুলে ধরে বলা হয়, আমাদের সংবিধানে শিক্ষাকে একটি বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ১৭(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য ও আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। সংবিধানের এই নীতিকে বিবেচনায় এনে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন পরিকল্পনা দেয়া হয়েছে- ‘সবার জন্য শিক্ষা- প্রতিপাদ্য যেন শহরের সব স্থানে বাস্তবায়নযোগ্য হয়, তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত। তাই শিক্ষার খরচ যাতে সর্বস্তরের মানুষের পক্ষে সাশ্রয়ী হয়, সে জন্য চাহিদার ৮০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের দায়িত্ব সরকার পালন করবে।’

এখানে আরো বলা হয়, শিক্ষাগত সুযোগ-সুবিধার জন্য সাধারণ বিবেচনা একটি অঞ্চলে বিদ্যালয়বিষয়ক মানদণ্ড তৈরি করার জন্য জনসংখ্যা, ভূমির ব্যবহার ও পথচারীবান্ধব পরিবেশের কথা বিবেচনা করা উচিত। স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে দূরে, প্রধান সড়কের কাছাকাছি ও বায়ুদূষণের উৎস (শিল্পকারখানা) বা সম্ভাব্য বিপজ্জনক স্থাপনার কাছাকাছি অবস্থিত হওয়া উচিত নয়, বিদ্যালয় জনবসতির কাছাকাছি দূরত্বে থাকা উচিত ও হাঁটা দূরত্বে অবস্থানের জন্য নগরের বেশির ভাগ বিদ্যালয় আবাসিক এলাকার ৭৫০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ভিত্তিক অঞ্চলের ধারণা অনুসরণ করা যেতে পারে।

ড্যাপে বিদ্যালয়ভিত্তিক অঞ্চলের ধারণা

প্রস্তাবিত ড্যাপে বিদ্যালয়ভিত্তিক অঞ্চলের একটি বিশদ ধারণা প্রদান করা হয়েছে। এখানে বলা হয়- যারা যে এলাকায় বসবাস করবে, তাদের ছেলেমেয়েরা সেই এলাকায় অবস্থিত স্কুলে ভর্তি হবে। এই ধারণাকে নগর-পরিকল্পনার ভাষায় বলা হয় বিদ্যালয়ভিত্তিক অঞ্চল ধারণা বা স্কুল ডিস্ট্রিক্ট কনসেপ্ট। পৃথিবীর উন্নত প্রায় সব দেশে এই ধারণা বলবৎ আছে। বর্তমানে আমাদের দেশে যে যেখানে পারে স্কুল তৈরি করে এবং ভালো স্কুল যেখানেই থাকুক, সবাই চান তাদের ছেলেমেয়েদের সেখানে ভর্তি করাতে। 

উদাহরণস্বরূপ ঢাকা শহরের প্রেক্ষাপটে বলা যায়- রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আইডিয়াল, হলিক্রস অথবা ভিকারুননিসা নূন স্কুলের কথা। প্রায় সব অভিভাবকই তাদের ছেলেমেয়েদের এসব স্কুলে ভর্তি করাতে চান, বাসা হোক মিরপুর অথবা যাত্রাবাড়ীতে। ফলে অভিভাবকসহ ছোট ছোট শিশুদের যে কী নিদারুণ কষ্ট বা দুর্ভোগে পড়তে হয়, তা সবারই জানা। শুধু তা-ই নয়, ঢাকা শহরের দুর্বিষহ যানজটের অন্যতম কারণও এটি। নগরবাসীকে এ থেকে পরিত্রাণ পেতে এই বিদ্যালয়ভিত্তিক অঞ্চল ধারণার বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। এই ধারণা বাস্তবায়ন করতে হলে শহরের প্রতিটি এলাকায় স্কুল থাকতে হবে কিংবা না থাকলে নিশ্চিত করতে হবে। সব স্কুলের সমমান নিশ্চিত করতে হবে। ভালো এবং স্বনামধন্য স্কুলের একাধিক শাখা বিভিন্ন এলাকায় করা যেতে পারে। 

এই ধারণা বাস্তবায়িত হলে যেসব সুবিধা পাওয়া যাবে বলে মনে করা হয়, তা হলো- ভালো স্কুলে ভর্তি হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা ধীরে ধীরে কমে যাবে। ট্রাফিক জ্যাম অনেকটা কমে যাবে। প্রতিটি এলাকার সুষম উন্নয়ন হবে। অভিভাবকসহ বাচ্চাদের দূরের স্কুলে যাতায়াতের কষ্ট বা দুর্ভোগ কমে যাবে।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, স্কুলকেন্দ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত হলে শহরে আবাসন ব্যবসায়ীদের যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিদ্যমান আছে, তা ব্যাপকভাবে কমে যাবে এবং এর ফলে তাদের অতিরিক্ত মুনাফা লাভের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে এই ধারণাটি যেন বাস্তবায়ন করা না যায় তার জন্য সরকারের বিভিন্ন মহলে জোর তদবির চালাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরামর্শক ও নগর পরিকল্পনাবিদ খন্দকার নিয়াজ রহমান বলেন, ‘মেট্রোরেল নির্মাণের টাকায় অনেক ভালো কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেত। শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল বা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলে মানের একটি স্কুলও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ঢাকায় স্থাপন করতে পারেনি কোনো সরকার। কারণ হিসেবে দেখানো হয়- জমি নেই, টাকা নেই। সংশোধিত ড্যাপে আমরা বলেছি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৬৩০টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিটি স্কুলের সামনে একটি প্রশস্ত খেলার মাঠ থাকবে। জমি কিনে এই স্কুলগুলো বানাতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের হিসাব অনুযায়ী, জমি কেনা ও ভবন নির্মাণ বাবদ এই ৬৩০টি স্কুল স্থাপনে খরচ হবে ৫২ হাজার কোটি টাকা। এই স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠা করা গেলে ঢাকার ৮০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী সরকারি স্কুলে পড়ার সুযোগ পাবে। এক অর্থবছরে সম্ভব না হলেও পাঁচ অর্থবছরে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে দীর্ঘ দিনের এই সমস্যাটি লাঘব হতে পারে।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh