হামিম উল কবির
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২০, ০৮:৫৭ এএম
করোনাভাইরাসের আতঙ্কে যখন মানুষ বিহ্বল তখন রাজধানীতে নতুন করে শুরু হয়েছে ডেঙ্গু আতঙ্ক। চলতি মাসের প্রথম ১৬ দিনে অন্য যে কোনো মাসের চেয়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে।
করোনাভাইরাস মোকাবেলা করা যত কঠিন, ডেঙ্গু মোকাবেলা তার চেয়ে অনেক বেশি সহজ; কিন্তু তা করতে পারেনি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কম।
রাজধানীবাসীর অভিযোগ, রাতের বেলা মশা তাড়ানোর কোনো ব্যবস্থা না নিলে বসা যায় না। আবার করোনাভাইরাস সংক্রমণও বাড়ছে। গত ১৬ নভেম্বর ৭০ দিন পর দেশে সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেশে কোন মাত্রায় পৌঁছাবে এ ধারণা জনস্বাস্থ্যবিদরাও দিতে পারছেন না। সামনের শীতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আসুক বা না আসুক, এখনকার চেয়ে যে সংক্রমণ বাড়বে, তাতে দ্বিমত নেই কারও মধ্যে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস আতঙ্কের মধ্যে মানুষের যখন দিশেহারা অবস্থা ঠিক এ সময়ে ডেঙ্গু আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে জনসাধারণের মানসিক শক্তি আরো ভেঙে পড়বে। দেখা দেবে নতুন বিপর্যয়। ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে একইসাথে করোনাভাইরাস ও ডেঙ্গু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে মানুষ। দুটি ভাইরাসে একসঙ্গে আক্রান্ত হলে যে মারাত্মক অবস্থা তৈরি হবে, তা বলাই বাহুল্য। মানুষের মধ্যে ভাইরাস বিষয়ক ট্রমা দেখা দিতে পারে। ফলে মানুষের ইচ্ছাশক্তি অথবা কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
নভেম্বরের প্রথম ১৬ দিনে সারাদেশে ২৫৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন। বৃদ্ধির এ গ্রাফ গত ৫ নভেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিনই বেড়েছে। মাঝখানে ৯ নভেম্বর একদিনে আক্রান্তের সংখ্যা কম ছিল। সেদিন সারাদেশে মাত্র ছয়জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শনাক্ত হয়। ৫ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত দৈনিক যথাক্রমে ১০ জন, ১২ ও ১৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। ৮ নভেম্বর ২৪, ৯ নভেম্বর ৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এরপর ১০ থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত তিন দিনে সারাদেশে যথাক্রমে ২৫, ২৫ ও ১৯ জন আক্রান্ত হয়েছে ডেঙ্গুতে। ১৩ থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত যথাক্রমে ১৪ জন, ২১, ২১ ও ১৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়।
এ হিসাব কেবল স্বাস্থ্য অধিদফতরে রিপোর্ট করে এমন হাসপাতাল থেকে নেয়া। এর বাইরে আরও অনেক হাসপাতাল রয়েছে, যারা স্বাস্থ্য অধিদফতরকে ডেঙ্গু বিষয়ে কোনো রিপোর্ট করে না। এছাড়া চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরাও রয়েছেন। সব হাসপাতাল ও চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের এক করা হলে দেখা যাবে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণের চেয়েও বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য অনুসারে, গত জানুয়ারিতে ১৯৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫, আগস্টে ৬৮, সেপ্টেম্বরে ৪৭, অক্টোবরে ১৬৩ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। এর মাঝখানে মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই মাসে যথাক্রমে ২৭, ২৫, ১০, ২০ ও ২৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এ আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জনের, যদিও রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) মাত্র একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি নভেম্বরে কমপক্ষে একটি নিম্নচাপ হতে পারে। তা থেকে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দীর্ঘক্ষণ বৃষ্টি হতে পারে। নভেম্বরে বৃষ্টি হলে তা থেকে মশার প্রকোপ ডিসেম্বরেও থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
বাড়ছে কভিড-১৯
করোনাভাইরাস সংক্রমণও বেড়ে যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। গত ১৬ নভেম্বর করোনাভাইরাস শনাক্ত হন দুই হাজার ১৩৯ জন। সর্বশেষ ৭ সেপ্টেম্বর দেশে একদিনে দুই হাজার দুই জন আক্রান্ত হয়েছিল। গত জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসের মতো আতঙ্কজনক সংক্রমণের হার এখন অবশ্য নেই। ওই তিন মাসে দৈনিক চার হাজারের বেশি করোনাভাইরাস আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে আগামী শীতে সংক্রমণ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ এখনো শুরু হয়নি। এখনো প্রথম সংক্রমণের পর্যায়ই চলছে। যেটুকু সংক্রমণ বেড়েছে তা স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ না মানার ফল। ১৬ নভেম্বর সারাদেশের ২১৬ আরটি পিসিআর মেশিনে ১৫ হাজার ৭৬৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
সারাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা মোট নমুনা পরীক্ষার ১৬.৯৯ শতাংশ হলেও ১৬ নভেম্বর করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার ছিল ১৩.৫৭ শতাংশ। এর বিপরীতে বাংলাদেশে মোট শনাক্তের ১.৪৩ শতাংশ মৃত্যবরণ করেছেন।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ার ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম মোজাহেরুল হক বলেন, ‘মূলত স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে না মানার কারণেই নতুন করে সংক্রমণ বাড়ছে। মাঝখানে সংক্রমণের হার কমে সাড়ে ১০ শতাংশে পৌঁছেছিল; কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে ধীরে ধীরে সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কঠোর হতে পারতো। স্বাস্থ্যবিধিতে নানা ধরনের শাস্তির কথা রয়েছে। বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করা, বাইরের কোনো কিছু ধরলে হাত ধোয়া ও একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে স্বাস্থ্যসম্মত দূরত্ব বজায় রাখার যে আইন, তা মানতে বাধ্য করতে পারলেই সংক্রমণ অনেক কমে যেত।’
করোনাভাইরাসের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এটি সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনা খুব সহজ না। সামনের দিনগুলোতে আমাদের এ ভাইরাসকে সাথে নিয়েই বাঁচতে হবে; কিন্তু ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা খুবই সহজ। এডিস মশার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়ায় ডেঙ্গু ভাইরাস। এডিস মশার বংশ বিস্তারের পথ ধ্বংস করে দিতে পারলে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এজন্য সিটি করপোরেশনকে ব্যাপকভিত্তিক মশার ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। লার্ভা ধ্বংসে পানিতে মশার ওষুধ ছিটাতে হবে। এডিস মশা ডিম ছাড়ে- এমন আধার ধ্বংস করে দিতে হবে।’