আজারবাইজানের যুদ্ধজয় এবং অতঃপর

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৫১ এএম

 শুশার ঐতিহাসিক ইউখারি গোভহার আগা মসজিদে আজান দিচ্ছেন এক আজারি সেনাসদস্য। ছবি: এএডটকম

শুশার ঐতিহাসিক ইউখারি গোভহার আগা মসজিদে আজান দিচ্ছেন এক আজারি সেনাসদস্য। ছবি: এএডটকম

১২ নভেম্বর তুরস্কের পত্রিকা ডেইলি সাবাহর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নাগোর্নো-কারাবাখের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর শুশাতে ২৮ বছর পর মসজিদ থেকে আজান দেয়া হয়। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা এক ভিডিওতে দেখা যায়, শুশার ঐতিহাসিক ইউখারি গোভহার আগা মসজিদের মিনার থেকে একজন আজারি সেনাসদস্য আজান দিচ্ছে। ২৭ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া আজারবাইজানের সাথে আর্মেনিয়ার যুদ্ধ ১০ নভেম্বর রুশ মধ্যস্ততায় থামার পর এখানকার ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো আলোচনায় আসছে। 

শুশা শহর কারাবাখের রাজধানী স্তেপানাকার্ট থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে ও শুশা স্তেপানাকার্টের প্রায় দুই হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। স্তেপানাকার্টের সাথে আর্মেনিয়ার যোগাযোগের রাস্তার ওপর অবস্থিত শুশা; আর তাই শুশার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার অর্থ হলো স্তেপানাকার্টের নিয়ন্ত্রণ নেয়া। 

৮ নভেম্বর আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ শুশা পুনর্দখলের ঘোষণা দেন। শহরটি আজারিদের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার কারণেই আর্মেনিয়া যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা দেন, উভয় পক্ষ ‘সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি’তে সম্মত হয়েছে, যা অত্র অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি সমঝোতার দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করবে। 

তিনি আরো বলেন, ‘উভয় পক্ষ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা ধরে রাখবে ও রুশ শান্তিরক্ষী সেনারা দুই পক্ষের মাঝে অবস্থান নেবে। রুশ সেনারা নাগোর্নো কারাবাখের সঙ্গে আর্মেনিয়ার যোগাযোগের জন্য একটি করিডোর নিয়ন্ত্রণে রাখবে।’ রুশ বার্তা সংস্থাগুলো জানায়, এক হাজার ৯৬০ জন রুশ সেনা ও ৯০টি সাঁজোয়া যান শান্তিরক্ষায় মোতায়েন হবে। 

ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, যুদ্ধবিরতির পর আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানে বিক্ষুব্ধ জনতা পার্লামেন্ট ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে ও বিভিন্ন দফতর ভাঙচুর করে। আর্মেনিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকল পাশিনিয়ান এক ঘোষণায় জানান, সার্বিক সামরিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে একটা ‘অকল্পনীয় যন্ত্রণাদায়ক’ চুক্তি স্বাক্ষরে তিনি বাধ্য হয়েছেন। অপরদিকে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলিইয়েভ বলছেন, এক ‘লৌহ হস্ত’ পাশিনিয়ানকে চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করেছে। তিনি এই চুক্তিকে আর্মেনিয়ার ‘আত্মসমর্পণ’ বলে আখ্যা দেন। আলিইয়েভ আরো বলেন, ‘একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মাঝে কারাবাখের একটা বড় এলাকা থেকে আর্মেনিয়া সেনা প্রত্যাহার করতে সম্মত হয়েছে। আর আজারবাইজানের বন্ধুরাষ্ট্র তুরস্ক যুদ্ধবিরতি ধরে রাখতে সহায়তা দেবে।  

শুশার মসজিদের ইতিহাসের সাথে অত্র অঞ্চলের সংঘাতের গভীরতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। ইউরেশিয়ানেট জানায়, ইউখারি গোভহার আগা মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৮৮৫ সালে। সোভিয়েত আমলে মসজিদটিকে জাদুঘর হিসেবে আখ্যা দিয়ে নামাজ পড়া বন্ধ করে দেয়া হলেও, ১৯৮৮ সালে আবার নামাজ পড়া শুরু হয়। ১৯৯২ সালের ৮ মে শুশা শহর আর্মেনীয়দের দখলে যাওয়ার পর থেকে এই মসজিদ থেকে আজান প্রচার করা হয়নি। গত বছরের ডিসেম্বরে আর্মেনীয়রা মসজিদটি মেরামত করে জাদুঘর হিসেবে জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়। তবে এই মসজিদের মেরামত আজারিরা ভালো চোখে দেখেনি। আর্মেনীয়রা কারাবাখ দখলের পর সেখানকার ছয় লাখেরও বেশি আজারি তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। 

শুশার এক শিক্ষক নুনে হাকোবিয়ান মসজিদ মেরামতের পর মন্তব্য করেন, তিনি এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে পছন্দ করেন; তবে তার মতে, এই মসজিদ তৈরি হয়েছে খ্রিস্টান ভূমিতে। আরটার পোগোসিয়ান নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘কারাবাখের কর্তাব্যক্তিরা এই মসজিদের মেরামত চাইলেও জনগণ চায় না। তারা মনে করে, এখানে একটি মসজিদ থাকলে মুসলিমরা কোনো এক সময় মনে করবে যে, এই ভূমি মুসলিমদের।’ 

শুশার আর্মেনীয়দের কথায় অত্র অঞ্চলে আর্মেনীয় ও আজারিদের মাঝে দ্বন্দ্ব কতটা গভীর, তার প্রমাণ মেলে। উভয় পক্ষের দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে রয়েছে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো। মসজিদ মেরামত করে কারাবাখের আর্মেনীয়রা ঘোষণা দেয়, আজারিরা আর্মেনীয়দের ইতিহাস ধ্বংস করলেও আর্মেনীয়রা তার উল্টোই করেছে। তবে আজারিদের দাবি, আর্মেনীয়রা মসজিদ মেরামত করে এটিকে ‘পারস্যের মসজিদ’ বলে আখ্যা দিচ্ছে, যা এখান থেকে আজারিদের ঐতিহ্য মুছে ফেলার একটি চক্রান্ত। 

কারাবাখের মন্ত্রী আরতাক গ্রিগোরিয়ান বলেন, ইরানি প্রকৌশলীরা সহায়তা করতে এসে এই মসজিদকে ‘পারস্যের মসজিদ’ বলেই আখ্যা দিয়েছে; তাই তারাও সেটিই বলেছেন। দুই পক্ষের কথায় জাতিগত চরম মেরুকরণেরই বিষয়টিই উঠে এসেছে, যা অত সহজে পরিবর্তনীয় নয়। আজারিরা নিজেদের তুর্কি জাতির অংশ বলে মনে করলেও পারসিক আখ্যা দেয়াটা তাদের পছন্দনীয় নয়। 

কমপক্ষে ১৩শ’ মানুষ এই যুদ্ধে নিহত হন বলে বার্তা সংস্থাগুলো জানায়। যদিও অনেকেই এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে বলে মনে করেন। এই হত্যাযজ্ঞ প্রায় তিন দশক ধরে চলা যুদ্ধাবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। তুর্কি ও ইসরায়েলি মনুষ্যবিহীন ড্রোন ও বাকুর তেল বিক্রির অর্থে কেনা বিপুল অস্ত্রের সমাহার আজারবাইজানকে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে একচ্ছত্র প্রাধান্য দিলেও তুরস্কের সমর্থন ছাড়া আজারিদের পক্ষে এতদিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে আর্মেনীয়রা সহায়তা চাইলেও পুতিন সরাসরিই বলে দেন যে, শুধু আর্মেনিয়া আক্রান্ত হলেই রাশিয়া আর্মেনিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জড়াবে। কারাবাখ যেহেতু আজারবাইজানের এলাকা বলে স্বীকৃত, তাই সেখানকার যুদ্ধে রাশিয়া জড়াবে না। আজারবাইজানকে তুরস্কের সরাসরি সমর্থনই শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত করে যে, রাশিয়া যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন ব্যতিত অন্য কোনো ভূমিকা নেয়নি। 

এই যুদ্ধ শেষ হলো রাশিয়া ও তুরস্কের ভূমিকায়; যা ‘ওএসসিই মিনস্ক গ্রুপ’কে অর্থহীন করে তুলেছে। সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র নীরব থেকে তুরস্ককে সমর্থন দিয়ে যাওয়ায় একদিকে মিনস্ক গ্রুপের সদস্য ফ্রান্সের প্রভাব যেমন আরো কমেছে; তেমনি যুক্তরাষ্ট্র যে এই অঞ্চল নিয়ে তেমন মাথা ঘামাবে না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল। প্রধানমন্ত্রী পাশিনিয়ানের পশ্চিমা সমর্থিত সরকারের খুঁটিও দুর্বল হলো, যা রাশিয়াকে খুশিই করবে। 

তবে ককেশাসে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু রাষ্ট্র আর্মেনিয়াকে সহায়তা না দেয়ায় মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রের কাছে কি বার্তা গেল, তা এখন আলোচ্য বিষয়। আবার চরম জাতিগত দ্বন্দ্বের ফলে আজারবাইজানের জয় এখনো শুধু সামরিক। অপরদিকে, বৃহত্তর মধ্য এশিয়ায় কৌশলগত জয়ের ফসল গেছে তুরস্কের ঘরে, যা তাদের আরো আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির দিকেই ঠেলবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh