সাগর-রুনি হত্যা: মাইলফলক স্পর্শের অপেক্ষা!

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২০, ০৪:৩৫ পিএম

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ায় তারিখ ৭৬ বারের মতো পিছিয়েছে। তার মানে আর ২৪ বার পেছালেই এটি শততম তারিখ পেছানোর মাইলফলক স্পর্শ করবে। প্রশ্ন হলো- পৃথিবীর আর কোনো মামলার তদন্ত প্রতিবেদন কি এ রকম ৭৬ বার পিছিয়েছে? সবশেষ গত ২২ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল; কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদন জমা না দেওয়ায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২৯ ডিসেম্বর পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন। ধারণা করা যায়, ২৯ ডিসেম্বরও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হবে না এবং এভাবে তারিখ পেছাতে পেছাতে হয়তো একদিন সত্যি সত্যিই শততমবার কোনো মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় পেছানোর রেকর্ড গড়বে বহুল আলোচিত এই হত্যা মামলা।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমার একটি ব্যক্তিগত অনুভূতিও জড়িত। রুনি আপার স্বামী সাগর সারোয়ার দেশে এসে মাছরাঙা টেলিভিশনে যোগদানের আগে জার্মানির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ডয়চেভেলেতে কাজ করতেন। সে কারণে জার্মানির ভিসা ফরম পূরণ এবং এ সম্পর্কিত অন্যান্য কাজে তিনি দক্ষ ছিলেন। আমার বাসা থেকে এই সাংবাদিক দম্পতির বাসা হাঁটাপথ। আমার ছোট খালা তখন জার্মানিতে যাওয়ার কাগজপত্র রেডি করছিলেন। এসব দেখে দেওয়ার জন্য একাধিকবার রুনি আপার বাসায় গিয়েছি। তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা তৈরির একটা বড় কারণ ছিল এটিএন বাংলা। আমি তখন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ঢাকা ট্রেড সেন্টারের তৃতীয় তলায় এবিসি রেডিওতে কাজ করি। আর ওই ভবনের সপ্তম তলায় এটিএন বাংলায় কাজ করেন মেহেরুন রুনি। আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। সেই সম্পর্কের সুবাদে ছোট খালার কাগজপত্র নিয়ে তার বাসায় যেতাম।

ভয়াবহ ব্যাপার হলো- যেদিন (২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে) এই সাংবাদিক দম্পতি খুন হলেন, তার পরদিন সকাল ৯টায় এবিসি রেডিওর সংবাদ পড়ছিলাম। স্টুডিওর যে কম্পিউটারের স্ক্রিনে লেখা দেখে আমরা পড়তাম, সেটি ‘নিউজ বস’ সিস্টেমে নিউজরুমের সঙ্গে যুক্ত ছিল। অর্থাৎ, সংবাদ চলাকালে যেকোনো এডিটর সেই বুলেটিনে প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন করতে পারতেন।

১২ ফেব্রুয়ারি সকাল পৌনে ৯টার দিকে যখন স্টুডিওতে ঢুকি, তখন পর্যন্ত রুনি আপা এবং সাগর ভাইয়ের খুনের ঘটনাটি আমাদের অজানা। খবর পড়তে পড়তে কম্পিউটারের মনিটরে দেখলাম, রানডাউনে একটা নতুন আইটেম যুক্ত হয়েছে। প্রথম লাইনটি পড়লাম- ‘রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন এটিএন বাংলার সাংবাদিক মেহেরুন রুনি এবং তার স্বামী সাগর সারোয়ার।’ পরিষ্কার মনে আছে, এই লাইনটি পড়ার পর কয়েক সেকেন্ড আমার মাথা পুরোপুরি শূন্য হয়ে যায়। গলা থেকে স্বর বের হচ্ছিল না। কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। পেশাদারিত্বের কারণে কোনোমতে সংবাদ শেষ করে স্টুডিও থেকে বেরিয়ে আসি। সকালে নিউজরুমে খুব বেশি লোক ছিলেন না, যারা ছিলেন তারা সবাই রুনি আপাকে চিনতেন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। সবাই নির্বাক।

এই সাংবাদিক দম্পতির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবাদে প্রতি বছর তাদের মৃত্যু দিবস এলে মন ভার হয়ে যায়। আর যখনই সংবাদমাধ্যমে খবর দেখি- আবারও পেছাল সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময়, তখন মনে প্রশ্ন জাগে- এই প্রতিবেদন কি আদৌ কোনো দিন আলোর মুখ দেখবে? আর যদি এই প্রতিবেদন দাখিল করাও হয়, সেখানে কী থাকবে? তা কি মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে? কী এমন রহস্য বা কত বড় শক্তি এই ঘটনার পেছনে রয়েছে যে, তদন্তকারীরা কিছুই বুঝতে পারছেন না? প্রযুক্তির এত উৎকর্ষ সাধিত হলো; আমাদের আইন-শৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী এত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলো, অথচ তারা একটি হত্যা মামলার কোনো কূল-কিনারা করতে পারছে না!

কিসের ভিত্তিতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে।’ এমনকি পুলিশ কর্মকর্তারাও বলেছিলেন, তারা ক্লু খুঁজে পেয়েছেন; তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। প্রশ্ন হলো- তারা কি বুঝে-শুনেই কথাগুলো বলেছিলেন কিংবা তাদের কাছে কি আসলেই কোনো তথ্য ছিল, নাকি এমন কোনো শক্তি এই ঘটনার পেছনে রয়েছে, রাষ্ট্রও যাদের ছুঁতে চায় না? 

প্রথমে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন পুলিশের একজন এসআই। চার দিন পর চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্তভার হস্তান্তর করা হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে। দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হলে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হত্যা মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয় র‌্যাবের কাছে। তারাও এই ঘটনার কোনো কূল-কিনারা করতে পারছে না। প্রশ্ন হলো- কী এমন রহস্য লুকিয়ে আছে যে, পুলিশ-ডিবি-র‌্যাব সবাই ব্যর্থ হচ্ছে এই ঘটনার জট খুলতে?

এই ঘটনার বিচার দাবিতে সাংবাদিক সংগঠনগুলো ব্যাপক আন্দোলন করলেও কিছু দিনের মধ্যেই তা স্তিমিত হয়ে যায়। এ জন্য সাংবাদিকদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং বিশেষ সুবিধা নিয়ে কারও কারও চুপ হয়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়। এখনো প্রতি বছর ১২ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের একটি অংশ এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে মানববন্ধন করেন; কিন্তু আর কত বছর এভাবে বিচার চাইতে হবে? তা ছাড়া কোনো প্রভাবশালী মহল যদি সত্যিই এই মামলার সঠিক তদন্তে বাধা সৃষ্টি করে, তাহলে সেই বাধা ডিঙিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আখেরে কী করতে পারবে? এই হত্যা রহস্যের জট না খোলার পেছনে একটি বড় কারণ ঘটনা নিয়ে সৃষ্টি হওয়া নানারকম গুজব ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। প্রথম দিকে নানারকম গাল-গপ্পো সংবাদপত্রেও এসেছে। এগুলো যেমন তদন্ত ব্যাহত করেছে, তেমনি তদন্ত সঠিক পথে না থাকায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে নানারকম গুজব ছড়ানো হয়েছে, এমন ধারণাও অমূলক নয়। 

এই মামলার বাদী, মেহেরুন রুনির ভাই নওশের রোমানের অভিযোগ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদিচ্ছার অভাবেই তদন্তে অগ্রগতি হচ্ছে না। তিনি জানান, শুরুর দিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তার পরিবারকে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানালেও গত কয়েক বছর ধরে এ বিষয়ে কোনো ধরনের যোগাযোগ করছে না। তাই তারা বিচারের আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছেন। 

প্রশ্ন হলো- আমরাও কি এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলায় বিচারের আশা ছেড়ে দেবো এবং তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় শততমবার পেছানোর মাইলফলক স্পর্শের অপেক্ষায় থাকব?

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh