বাঙালির ঐতিহাসিক হবিবুল্লাহ

শাহেদ সাখাওয়াৎ খান

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০৩:১১ পিএম

আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ- একজন শিক্ষাবিদ, লেখক এবং ঐতিহাসিক। বাংলা অঞ্চল, ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস প্রণয়নের পাশাপাশি গোটা বিশ্ব ইতিহাসের গতিবিধির তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ একজন পর্যবেক্ষক। তার লেখার সুবিশাল বিস্তৃত জগতে পাঠের কোনো কমতি ছিল না। পক্ষিবিশেষজ্ঞদের একটা বিশেষ দিক রয়েছে তা হলো- স্থিরতার সঙ্গে চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ করা এবং পাখির আচরণ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা। হবিবুল্লাহ ছিলেন তেমন-ই এক নিবিষ্ট লেখক যার চিন্তার উৎকৃষ্টতার গুণে সমাজে আজও সমধিক পরিচিত। তার লক্ষ্য ছিল ইতিহাসের সামাজিকীকরণ, যে জন্য তিনি সাধারণ্যে ইতিহাসকে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন।

বাংলা, বাঙালি এবং বাংলাদেশকে দেখার একটি বিশেষ দৃষ্টি ছিল আবু মহামেদ হবিবুল্লাহর। বাংলাদেশপ্রেমী এই লেখকের দেশপ্রেম প্রসঙ্গে প্রমাণ পাওয়া যায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা ‘মুক্তবঙ্গের স্মৃতি’তে। সেখানে তিনি লেখেন- ঢাকা থেকে একদিন কলকাতায় আসেন ঐতিহাসিক হবিবুল্লাহ। আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কথা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা স্বাধিকার দাবি করছি বটে; কিন্তু আমাদের আসল লক্ষ্য স্বাধীনতা।’ আমি তাকে সাবধান করে দিয়ে বলি, ‘খবরদার, ও কথা মুখে আনবেন না। পাকিস্তানি সেনা ভীষণ অত্যাচার করবে।’ তিনি ভয় পান না।

আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ এমন-ই এক ঐতিহাসিক যার মধ্যে দিয়ে উঠে আসে বাঙালির চিন্তার বিশেষ দিকগুলো। স্বাধীনতার জন্য গত শতকের ছয়ের দশকে বাঙালি শিক্ষিত সমাজে একটি স্বর তৈরি হয়েছিল তা অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্মৃতিচারণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

লেখক আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার বাবুনিয়া নামক গ্রামে ১৯১১ সালের ৩০ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯২৬ সালে হুগলী মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৩ সালে ইতিহাসে প্রথম শ্রেণিতে এমএ সম্পন্ন করে- তিনি ইতিহাসে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে যান। ১৯৩৬ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দেশে ফিরে তিনি ১৯৩৮ সালে প্রথমে কলকাতা মাদ্রাসার গ্রন্থাগারিক পদে যোগদান করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে লেকচারার হন। দীর্ঘ ১০ বছর চাকরি করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে রিডার পদে যোগদান করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান পদ অলংকৃত করেন। তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন, ১৯৮২ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতি ছিলেন।

তিনি তার লেখার মাধ্যমে বাংলা ও বাঙালির ভাবাদর্শ কী সে বিষয়ে বিশেষ আলোকপাত করেন। একটি লেখায় তিনি বলেন, ‘ভাষা, সাহিত্য, শিল্প ও কলা, সমাজব্যবস্থা ও চিন্তাপ্রণালি এমনকি জীবনাভ্যাস ও জীবনানুশীলনের বাহন যে শিল্প, এসবের মধ্য দিয়েই বাঙালির একটি বিশিষ্ট মানসিকতার পরিচয় মেলে, যার সঙ্গে বহির্বঙ্গের পার্থক্য তর্ক করে বোঝাতে হয় না। বাঙালি মাত্র- কি হিন্দু, কি মুসলমান, ন্যায়তই হোক কি অন্যায়তই হোক, বহির্বঙ্গীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আত্মীয়তা বোধ করে। রাজনীতি ও ইতিহাসের পক্ষে এটিই চরম কথা। বাঙালির আর্থিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের পক্ষে উত্তর-ভারতীয় পরিবেশ কল্যাণকর নয়, ইতিহাস তার সাক্ষ্য এবং দৃষ্টিশক্তি আচ্ছন্ন না হলে এখনো পথে-ঘাটে এর প্রমাণ দেখা যায়। কাজেই বাংলার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নে কোনো বাঙালি ভিন্ন মত হতে পারে না।’

আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ ছিলেন মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও জীবনবোধের এক সাহসী মানুষ। আত্মনিষ্ঠ ইতিহাস মূল্যায়ন এবং চিন্তক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো : সাহিত্য-সংস্কৃতি ইতিহাস, আলবেরুণীর ভারততত্ত্ব (অনুবাদগ্রন্থ)। নিবিষ্ট সাহিত্যচর্চার জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারেও ভূষিত হন। গুণী এই লেখক-শিক্ষাবিদ আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ ১৯৮৪ সালের ৩ জুন ৭৩ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। ৩০ নভেম্বর তার জন্মের দিন এগিয়ে আসছে। কিন্তু যে মুক্তবুদ্ধির চর্চার যাত্রা আবু মহামেদ তার লেখনীর মাধ্যমে শুরু করেছিলেন, তা আজ কোথায়, সে প্রশ্নটি রয়ে যায় অন্তরালে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh