অরুন্ধতী বসু
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:১০ এএম
কভিড-১৯ মহামারি কেড়ে নিয়েছে ১০ লাখেরও বেশি মানুষের জীবন। মাত্র কয়েক মাসে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে।
বর্তমান দিনযাপন, অভ্যাসের গতিপথে পরিবর্তন না আনলে ভবিষ্যতে আমরা কেমন ধ্বংসযজ্ঞের সম্মুখীন হতে পারি, তার একটি চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব।
প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাদী ও করপোরেটবান্ধব দেশগুলো জনস্বাস্থ্যের মতো জরুরি ব্যবস্থাটিকে দক্ষতার সাথে গড়ে তুলতে পারেনি। ফলস্বরূপ কভিড-১৯-এর প্রকোপে বিশ্বের অনেক অঞ্চলে সার্বিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এটি এই ধ্বংসযজ্ঞের পূর্বরূপ মাত্র।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্বজুড়ে গভীরতর ক্ষত সৃষ্টি করা বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে এ মুহূর্তে কাজ শুরু না করলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে এক অনাকাক্ষিত ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হবে মানবসভ্যতা। ব্রাজিলে উপরোক্ত সব সমস্যাই বিদ্যমান। বৈচিত্র্যময় এই দেশটিতে রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত বৈষম্য। বনভূমি উজাড় করার প্রবণতাও আগের মতোই রয়েছে। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি প্রকট হয়ে উঠছে।
মহামারির মতো সংকটের সাথে জলবায়ু পরিবর্তন- এসব নিয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে রয়েছে ব্রাজিলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সম্প্রদায়, বিশেষ করে আদিবাসীরা। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রতিটি সংকটকে আরো ঘনীভূত করে তোলে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিতে ফেডারেল রাষ্ট্রটি অক্ষম বা বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে নারাজ ক্ষমতাসীন শাসককুল। এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠীগুলোকে। ব্রাজিলে তথাকথিত উন্নয়ন হলেও, তাদের অবস্থান বা জীবনযাপনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নেই। একই পরিস্থিতিতে আটকে আছে তারা, যা তাদের ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংস বা বিলুপ্তির দিকে। অর্থাৎ এক ধ্বংসযজ্ঞ থেকে জন্ম হচ্ছে আরেক ধ্বংসযজ্ঞের।
সময়মতো কভিড-১৯ মহামারি রোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি ব্রাজিল সরকার। দেশটিতে ভয়াবহ আকারে বেড়েছে সংক্রমণ। পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজনও বাদ পড়েনি করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে। এ অবস্থায় ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলের রাজ্য আমাপা এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বাসিন্দারা রয়েছেন পানি সংকটেও।
জলবায়ু পরিবর্তন, ব্রাজিল সরকারের অবহেলা ও বেপরোয়া মনোভাবের কারণে গত ৩ নভেম্বর ভেঙে পড়ে আমাপার বিদ্যুৎ গ্রিড। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় গোটা রাজ্যজুড়ে। এদিন আমাপা রাজ্যের রাজধানী মাকাপার মূল সাবস্টেশনটিতে থাকা ট্রান্সফরমারে হঠাৎ আগুন লেগে আমাপার ১৩টি শহর ও এ রাজ্যের ৯৯ শতংশেরও বেশি, প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অঞ্চলটিতে এ সময় ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন বজ্রপাতের কারণে ট্রান্সফরমারে আগুন লেগেছে। অল্প সময়েই এ সমস্যার সমাধান হতে পারে; কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় যোগাযোগের পরিসরও সীমিত হয়ে যায়। তাই সেই দিনটিতে আসলে কি হয়েছিল, তখন পর্যন্ত কেউই সঠিক জানতেন না।
ব্রাজিলের আমাপা রাজ্যের এই ভয়াবহ সংকটকে বিশ্ববাসীর জন্য সতর্কবার্তা বলে দাবি করছেন দ্য রুলসের (রুলস কাজ করে বৈষম্য ও দারিদ্র নিয়ে) সহ-প্রতিষ্ঠাতা আলনুর লাধা, চিলিয়ান লেখন ও স্বতন্ত্র গবেষক ফেলিপে ভিভিয়েরস এবং মিডিয়া নিনজার মিডিয়া এডিটর রাইসা গালভাও। তারা আলজাজিরায় এক নিবন্ধে লিখেছেন, এ পরিস্থিতি বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে হতে পারে। ৩৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন থাকার পর পুরো আমাপা বৃষ্টির পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। স্থানীয় দোকানগুলোয় নিত্যপণ্যের অভাব দেখা দেয়। রেফ্রিজারেটরে মজুদ খাবারগুলো নষ্ট হতে শুরু করে।
রাজ্যের হাসপাতালগুলো কভিড-১৯ রোগীতে পরিপূর্ণ। হাসপাতালে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে ডমেস্টিক পাওয়ার জেনারেটর ব্যবহার শুরু হলে সৃষ্টি হয় এক ভয়াবহ বিশৃঙ্খলার। এ সময় কয়েকটি ধনী এলাকায় বিদ্যুৎ এলেও রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এখনো রয়েছেন অন্ধকারে। চারদিন বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন থাকার পর আমাপাবাসী ক্ষোভ প্রদর্শন ও ফেডারেল কর্তৃপক্ষের সহায়তার দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করেন। বিক্ষোভ সমাবেশ পণ্ড করতে ব্যবহার করা হয় রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস। বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন থাকার আটদিন পর তদন্ত করে দেখা যায়, বজ্রপাতের কারণে সাবস্টেশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, ট্রান্সফরমারে আগুন লেগেছে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। এর দায়িত্বে ছিল স্প্যানিশ করপোরেশন আইসোলাক্স। চলতি বছরের জানুয়ারিতেই প্রতিষ্ঠানটি বেসরকারীকরণ অভিযানের সময় চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। হাজার হাজার মানুষের দুর্ভাগ্যের কারণ হিসেবে দায়ী করে প্রতিষ্ঠানটিকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি আইসোল্যাক্স। এমনকি দায় স্বীকার করে আমাপাবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনাও করেনি।
আমাপায় রয়েছে তিনটি হাইড্রো ইলেকট্রিক প্ল্যান্ট। ব্রাজিলের দ্বিতীয় শীর্ষ বিদ্যুৎ উৎপাদক রাজ্য পারার সাথে সীমান্ত রয়েছে আমাপার। ব্রাজিলে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ হয় আমাপা থেকে। তা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ বিভ্রাটে পড়তে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। তাই সঙ্গত কারণেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছে আমাপাবাসী। রাজ্য ও ফেডারেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভ অব্যাহত ছিলই। বিদ্যুৎ বিভ্রাটে উদ্ভূত ‘নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ বৃদ্ধির’ দোহাই দিয়ে ১৫ ও ২৯ নভেম্বরের নির্বাচন স্থগিত করার ঘোষণা দেয়া হয় গত ১২ নভেম্বর। আসলে এই সংকটে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে চেয়েছিলেন রাজনীতিকরা। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা ছিল বেশি।
মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ ও জনগণের উত্তেজনা প্রশমনে ২২ নভেম্বর আমাপা আসেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেইর বোলসোনারো। ভেবেছিলেন সমস্যা সমাধান করে নিজের কৃতিত্ব দেখাতে পারবেন; কিন্তু আমাপাবাসীর জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হন তিনি। আমাপার সমস্যা এখনো সমাধান হয়নি। নভেম্বরের শেষ দিকে ঝড় আঘাত হানে মাকাপায়। বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে এখানকার বাড়ি, দোকানঘর। বিপর্যস্ত হয় জনজীবন। ব্রাজিলের জাতীয় মিডিয়ায় জায়গা নিতে পারেনি আমাপাবাসীর দুভোর্গ। এ ঘটনা সংবাদমাধ্যমগুলো এক রকম এড়িয়ে গেছে বলা যায়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও নীরব।
স্থানীয়রা মরিয়া হয়ে ফেডারেল কর্তৃপক্ষকে বেসরকারিকরণ অভিযান বন্ধ ও নাগরিকদের জরুরি সেবা দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন; কিন্তু তারা এটিও জানেন, বধির কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের আহ্বান পৌঁছাবে না। তাই নিজেদের সমস্যা সমাধানে নিজেরাই সংঘটিত হতে শুরু করেছেন আমাপাবাসী। তৈরি করেছেন স্বেচ্ছাসেবী নেটওয়ার্ক ‘সলিডারিটি উইথ আমাপা’। এই স্বেচ্ছাসেবী দল জরুরি অবস্থায় যে কোনো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে সবরকম সহায়তা করতে প্রস্তুত থাকে। নিজেদের কর্মযজ্ঞ সবার কাছে তুলে ধরতে মিডিয়া নিনজা ও কাসা নিনজা অ্যামাজোনিয়ার মতো স্থানীয় মিডিয়া কোম্পানির দ্বারস্থ হচ্ছে সলিডারিটি উইথ আমাপার সদস্যরা।
বিশ্ববাসীর জন্য দুঃখজনক বিষয় হলো- আমাপা সংকট কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত এবং রাজ্যের সম্পদ জনগণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে মুনাফাকেন্দ্রিক বহুজাতিক করপোরেশনের স্বার্থে ব্যবহৃত হলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। এটি যেকোনো দেশেই ঘটতে পারে। ব্রাজিলের আমাপা এ পরিস্থিতির একটি উদাহরণ মাত্র। এমন ঘটনা ঘটছে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়, যা থেকে যাচ্ছে অগাচরে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সমস্যাগুলোয় ক্ষতিগ্রস্ত হয় অস্বচ্ছল দুর্বল জনগোষ্ঠী। তাদের ক্ষতির পরিমাাণ পদ্ধতিগত বর্ণবাদ ও বৈষম্যের মাধ্যমে আরও বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। বর্ণবাদ ও বৈষম্যের কারণেই ব্রাজিল ও অন্য অনেক দেশে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সুবিধা পান গুটিকয়েক ব্যক্তি, বাকিরা থেকে যান বঞ্চিত।
আজ মহামারি মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ অনুসন্ধান করছে বিশ্ব। স্বাভাবিক জীবনযাপন ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই নিজের নিয়মে। সবদিক বিবেচনা করে আমাপা সংকটে সবারই মনযোগী হওয়া উচিত। আমাপাবাসীর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়া জরুরি। বিশ্ব নেতাদের উচিত শক্তিশালী বিকেন্দ্রীভূত সিস্টেম নির্মাণ করা। এই নতুন সিস্টেমে বিশ্বে আমাদের অবস্থান, রাষ্ট্রের ভূমিকা ও এই সংকটপূর্র্ণ সময়ে নাগরিক হওয়ার অর্থ সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। তা না হলে পুরো বিশ্বই ব্ল্যাকআউটে চলে যেতে পারে।