সরকারের ১২ বছর: সাফল্য ও সীমাবদ্ধতার পর্যালোচনা

শেখর দত্ত

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:২৬ এএম

শেখর দত্ত

শেখর দত্ত

উপরোক্ত শিরোনামে যখন লেখার কথা চিন্তা করছি, তখনই খবরে জানলাম ও টেলিফোনেও কেউ কেউ বললেন, ভারত করোনার টিকা রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। তাই বাংলাদেশে টিকা আসার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হবে। 

এই কথা শোনার পর মনে হলো এটাকে তো দেশবাসী সরকারের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখবে ও দেশ-জনগণ পড়বে বিপদে। বিপদ যখন একেবারেই দোরগোড়ায়, তখন সরকারের সাফল্যের কথা বিবেচনায়ই নিতে চাইবে না। এ নিয়ে যখন ভাবছি, তখনই জানলাম স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ভারতের টিকা সমস্যা হবে না। স্বাস্থ্যসচিব আবদুল মান্নান বলেছেন, ভারতের সাথে আমাদের চুক্তি রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীও একই কথা বলেছেন। বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনও একই কথা বলেছে। 

মার্চের আগে টিকা আনাই হবে সরকারের সাফল্য এটা দিয়ে লেখাটা যখন শুরু করব ভাবছি, তখন ৫ জানুয়ারি সকালে পত্রিকার হেডিং- টিকা নিয়ে হঠাৎ অনিশ্চয়তা। আবারো দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়লাম। 

তাই লেখার শুরুতেই বলে নেই, দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যেই চলছে বহুকেন্দ্রিক বিশ্বের বর্তমান সময়। আমেরিকা-রাশিয়া ঠান্ডাযুদ্ধ যুগে কিংবা আমেরিকার এককেন্দ্রিক বিশ্বযুগে দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা প্রশ্ন ছিল কম। ভালো-মন্দ অবস্থান ছিল জনগণের বিপুল বহুলাংশেরই অনঢ়। এখন এই অবস্থা নেই। মতের ভিন্নতা বর্তমানের যুগবৈশিষ্ট্য। এই দিকটি বিবেচনায় নিয়ে সরকারের সাফল্য-সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনায় ব্রতী হলাম। প্রসঙ্গত, সাফল্যের বিপরীতে ব্যর্থতা শব্দটা ব্যবহার করা হয়নি। কেননা সরকারের দুর্বলতা-ব্যর্থতা প্রভৃতি যা আছে, তা জাতীয় ও বিশ্ব পরিস্থিতিতে সীমাবদ্ধতার বৃত্তেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে সাফল্যের ওপর দাঁড়িয়ে এই সীমবদ্ধতা ভাঙা বা বৃত্তের পরিধির ক্রম-প্রসারণ করে শত লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার অনুযায়ী জাতীয় চার নীতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জই এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে রয়েছে। 

২০১৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ আসনে জিতে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন ৬ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। জাতির সৌভাগ্যই বলতে হবে, মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যখন পালিত হচ্ছে, তখন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। দলমত নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সবার মনে শত আলোচনা-সমালোচনা, জিজ্ঞাসা-প্রশ্ন, অভিমান-ক্ষোভ, যার মনে যা-ই থাকুক না কেন, বিএনপি-জামায়াত জোট যদি ক্ষমতায় থাকত, তবে জাতির গৌরবমণ্ডিত এ দুই অনুষ্ঠান কী রূপ নিত, তা বোধ করি ভাবতেও পারি না কেউ। কেননা যদি শুনতে হতো, প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়া হচ্ছেন স্বাধীনতার ঘোষক বা প্রধানমন্ত্রী জাতীয় শোক দিবসে ভুয়া জন্মদিনের কেক কাটছেন কিংবা রাজাকার-আলবদরের দলের নেতাদের গাড়িতে-বাড়িতে দেশের গৌরবমণ্ডিত পতাকা উড়ছে, তবে এই দুই অনুষ্ঠান হতো কলঙ্কিত। 

আওয়ামী লীগ ১২ বছর অর্থাৎ দেশের সবচেয়ে বেশি সময় ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় রয়েছে। প্রসঙ্গত, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বিরোধীরা বলতেন, পাকিস্তানের মুসলিম লীগের মতো অবস্থা হবে আওয়ামী লীগের, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। জাতীয় চার নেতাকে এই উদ্দেশ্যেই জেলে হত্যা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১৯ বার বিশেষত ২ বার (কোটালীপাড়া ও বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) মারাত্মকভাবে হত্যার প্রচেষ্টা চলেছে; কিন্তু আজ ওই ভবিষ্যৎবাণী ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ১২ বছর ক্ষমতায় থেকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এনে দিয়েছে। যথার্থ ইস্যু থাক বা না থাক, কথায় কথায় হরতাল-অবরোধ এখন আর হয় না। অস্থিতিশীলতা-অরাজকতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা এখন আর প্রকাশ্যে নেই। 

প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর ‘রাতের বাহিনী’ আর ‘চাটার দল’র অপতৎপরতা আর ‘বটমলেস বাসকেট’ বলে দেশের রাজনীতিকে সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে একদলে ও হত্যা ক্যুর অক্টোপাশের জালে আটকে দেয়ার স্মৃতি আজও জাজ্বল্যমান। একইসাথে ১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগ শাসনামলে গঙ্গার পানি চুক্তি আর শান্তিচুক্তি নিয়ে হরতাল-অবরোধ আর উৎখাতের হুঁশিয়ারি ও পরে ক্ষমতায় এসে তা বাতিল না করার দিনগুলোর কথা স্মরণ করলেই অনুধাবন করা যাবে, আমাদের জাতির ললাট লিখন যেন ছিল রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তথা অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখল বা নির্বাচন নয় আন্দোলন করে সময়ের আগেই সরকারের বিদায়। 

সত্তরের দশকে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট, আশির দশকে একাশির ৩০ মে, নব্বইয়ের দশকের ছিয়ানব্বইয়ের ৩০ মে, একবিংশ শতকের প্রথম দশকের ১১ সেপ্টেম্বর যেন সেলুলয়েডের মতো চোখের সামনে একে একে ভেসে ওঠে। ‘ভালোবাসিবারে দে আমায় অবসর’ যেমন লাগে, তেমনি উন্নয়ন-অগ্রগতির পথে দেশকে নিতেও স্বস্তির সময় লাগে। বর্তমানের স্বস্তি যত কঠিন-কঠোর, অনভিপ্রেত-বেদনাদায়কই হোক না কেন, এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার এনে দিয়েছে। এটাই সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য ও অর্জন। তবে এতে আত্মতৃপ্তির কোনো অবকাশ নেই। আত্মতৃপ্তি হচ্ছে কবরের শান্তি। আলোচনা-সমালোচনা বিবেচনায় নেয়া, স্বচ্ছতা-জবাবদিহির দুয়ার উন্মোচন করা, ভালোকে ভালো বলে গ্রহণ করা আর মন্দকে মন্দ তথা ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ প্রভৃতিকে এখন ঊর্ধ্বে তুলে ধরা ভিন্ন আওয়ামী লীগ সরকারের বিকল্প নেই। 

বিগত ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সংস্কৃতির সব বিষয় যেমন গণতন্ত্র-নির্বাচন-সংসদ, আইনের শাসন-মানবাধিকার, দুর্নীতি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে করণীয় থেকে শুরু করে কেমন গ্রাম চাই, তারুণ্যকে কীভাবে কাজে লাগাতে হবে, নারীর ক্ষমতায়ন, পররাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি ৩৩টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করার সাথে সাথে সেই সময়ের সাফল্য ও অর্জন এবং ৫ বছরের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা তুলে ধরেছিলেন। বিজয়ের পর তিনি এটাও বলেছিলেন, এই ইশতেহার আমরা হাতে হাতে রাখব ও কাজের সময় মিলিয়ে দেখব কোনটা কতটুকু হচ্ছে, কোথায় কি করতে হবে। মাননীয় মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ধারণা করি, তা এখন মিলিয়ে দেখছেন। 

ইতিমধ্যে দেখলাম, সরকার ৪৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনার মূল্যায়ন করে তালিকা প্রকাশ করেছে। এতে প্রথম হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, দ্বিতীয় কৃষি বিভাগ, তৃতীয় অর্থ বিভাগ প্রভৃতি। সেবাখাত যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবারকল্যাণ, যুব ও ক্রীড়া, জননিরাপত্তা পিছিয়ে আছে। এটা প্রকাশ করায় ভালো হয়েছে, তাতে দেশবাসী সরকারি কাজের একটা দিক সম্পর্কে অনুমান করতে পারল; কিন্তু প্রশ্ন হলো, নির্বাচনী অঙ্গীকার বা ইশতেহারের লক্ষ্য-পরিকল্পনার সাথে সরকারের বিভিন্ন কাজের সাফল্য-সীমাবদ্ধতা মিলিয়ে দেখা যাবে কীভাবে? 

আওয়ামী লীগ শাসনামল ১৯৯৬-২০০১ ও বিগত ১০ বছরেও লক্ষ্য করা গেছে, প্রতিটি মন্ত্রণালয় ধরে অর্জন ও সাফল্যের মূল্যায়ন প্রায়ই বছর শেষে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বা সরকার করে থাকে। এটা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারই প্রথম স্বচ্ছতা-জবাবদিহির স্বার্থে করেছিল। ২ বছর পার হওয়ার মুহূর্তে সরকার বা দল তা করেছে কি না জানা যায়নি। যদি করে থাকে তবে প্রকাশ করা দরকার, আর না করলে তা স্বচ্ছতা- জবাবদিহির স্বার্থে করা একান্ত প্রয়োজন। 

২০০১ সালের শা-ল-সা সরকারের ভোট ডাকাতির নির্বাচন জাতির গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা রূদ্ধ করে দেয়। বিএনপি-জামায়াত-ইসলামী ঐক্যজোট ক্ষমতায় আসে। সরকারে থেকেই একটা অংশ আওয়াজ তোলে ‘আমরা হবো তালেবান বাংলা হবে আফগান।’ বেশি কথায় না গিয়ে বলি, দেশ বাংলাভাই আর মুফতি গংদের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসী তালিকায় নাম উঠিয়েছিল। ক্ষমতার প্যারালাল কেন্দ্র ‘হাওয়া ভবন’- এর বদৌলতে অকার্যকর রাষ্ট্রের তালিকায়ও শোভা পেয়েছিল। 

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা করেছিল সেনা-সুশীলসমাজ সমর্থিত জরুরি আইনের সরকার, তারেক রহমানও বিদেশে নির্বাসনে গেছেন সেই আমলে নিজেদের ইচ্ছায়। তাই বিএনপির পায়ে কুড়াল মারার দায় আওয়ামী লীগ সরকারকে দেয়া যায় না। বাস্তবে নিজেদের ফাঁদে নিজেরাই বাধা পড়েছে ক্যান্টনমেন্টে গড়া ওই দল। দলটির নৈতিক বল শূন্য বা বিয়োগান্তুক বলেই আন্দোলনে রাস্তায় নামতে পারছে না। 

এতদসত্ত্বেও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নেগেটিভ অবস্থানকে যারা আওয়ামী লীগের পজেটিভ বা সাফল্য হিসেবে দেখেন, তাদের সাথে একমত হওয়া যায় না। আওয়ামী লীগকে এ সরকারের সাফল্য ও অর্জন দিয়ে আরো পজেটিভভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। আগামী তিন বছর এই ক্ষেত্রে সাফল্য-অর্জন যতটুকু হবে, তা দিয়েই আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্য-সীমাবদ্ধতার যথার্থ পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করতে হবে।

-লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh