পুরাকীর্তি সফরের যত সব অভিজ্ঞতা

খন্দকার মাহমুদুল হাসান

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২১, ১০:৫৯ এএম | আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২১, ১১:০০ এএম

খন্দকার মাহমুদুল হাসান

খন্দকার মাহমুদুল হাসান

রহস্যের অবগুণ্ঠন উন্মোচন-প্রচেষ্টার নেশা আমায় ধরেছে বহুকাল আগে। সেই নেশার ঘোরেই ছুটছি আজও। ইতিহাস ও পুরাকীর্তির রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে ছুটে চলেছি দিনরাত। যেহেতু নিজে কোথাও না গিয়ে, নিজ চোখে না দেখে, কিছু না লেখাটা আমার নীতি, তাই আমার বিশ্রাম নেয়ার সময় হয়নি।

একবার সুন্দরবন যাত্রায় পথ হারিয়ে বাঘের মুখে পড়তে বসেছিলাম। যমুনা নদীতে সেতু নির্মিত হওয়ার অনেক আগে ১৯৮৫-তে ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জের পথে ঝড়ের রাতে লঞ্চ না পেয়ে কী নাস্তানাবুদই না হয়েছিলাম! শেষে সমবায় দফতরের থানা পর্যায়ের এক মহানুভব কর্মচারীর দয়ায় তার আবাসনে আশ্রয় পেয়ে রক্ষা হয়েছিল। 

ঠাকুরগাঁও জেলার রানিশংকৈল উপজেলার নেকমরদের প্রাচীন ইমারতে ব্যবহৃত সম্ভাব্য গুপ্তযুগীয় ত্রিকোণাকৃতির গ্রানাইট পাথরের কাঠামো দেখতে গিয়ে সাংবাদিক সন্দেহে ধাওয়া খেয়ে হাওয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। প্রত্নস্থল ধ্বংস করে বাড়ি নির্মাণ করে প্রত্নসামগ্রী ব্যবহারকারীরা সেখানে এতটাই সংঘবদ্ধ ছিল যে, তারা আমার সর্বনাশ করতে উদ্যত ছিল। একই উপজেলার গোরকুইয়ে দেশের ও সম্ভবত অবিভক্ত বাংলারও একমাত্র পাথরে তৈরি প্রাচীন পাথরের কুয়ো দেখতে গিয়ে সাপের ফনার সামনে পড়েছিলাম। গোরক্ষনাথের সমাধিস্থল হিসেবে পরিচিত কালো পাথরের বেশ কয়েকটি শিবলিঙ্গসহ সেই নাথ ধর্মীয় কেন্দ্রটি দেখেছি। 

আরেকবার বগুড়ার মহাস্থান গড়ের শহরতলীর প্রত্ন ঢিবিগুলো সম্পর্কে জরিপ চালাতে গিয়ে পলাশবাড়ী গ্রামে গিয়ে দেখলাম, সুউচ্চ ঢিবির অর্ধেক কেটে ফেলা হয়েছে। পাশে বিরাট গর্ত করে লোপাটের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রত্নসন্ধানী তৎপরতা চলছে। কাটা অংশে প্রাচীন ইমারতের সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখা যাচ্ছে। প্রাচীন বাংলার দুর্গনগরী পুণ্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষের পেছনের একটি গ্রামে প্রকাশ্যে এভাবে প্রত্ন-নিদর্শন নিশ্চিহ্ন করতে দেখে বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল। নিধিরাম সর্দার হিসেবে যেসব অনুনয় বিনয় করলাম, সেগুলোকে তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে দলবল নিয়ে আমার ওপর চড়াও হলেন, কথিত পর্চাধারীরা। হতাশ হয়ে ভাবলাম, আমি আবার কে? আমার তো কোনো অধিকারই নেই প্রত্নসম্পদ লোপাটে বাধা দেওয়ার! এই পুণ্ড্রনগরেরই শহরতলির প্রাচীন স্থাপনাযুক্ত ঢিবি ছোট ট্যাংরার ধাপের হাল অবস্থা দেখতে গেলাম। এই ঢিবি থেকে প্রায় দেড় হাজার বছরের প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি পাওয়া গেছে। সেই মূর্তি ফ্রান্সের প্রদর্শনীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এখনো তা মহাস্থান জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। কাজেই প্রত্নঢিবিটার হাল অবস্থা জানাকে কর্তব্য জ্ঞান করে সেখানে গেছি। যা দেখলাম তাতে বুকটা ফেটে গেল। প্রকাশ্য দিবালোকে সর্বসমক্ষে লোপাটকারীরা জাতীয় সম্পদ এ প্রাচীন স্থাপনার ইট হাজার দরে বিক্রি করছেন। সস্তায় পেয়ে সুদূর ঢাকা থেকে ক্রেতা এসে জুটেছেন ট্রাক নিয়ে। মাটি থেকে অনেক উঁচুতে ঢিবির অবশিষ্টাংশের ওপর দাঁড়িয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করলাম। কে শোনে আমার মতো অধিকারহীন চুনোপুঁটির কথা! আর বলারই বা কে! 

একবার চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার কুমিরার কাছে মসজিদ্দা গ্রামের সুলতানি আমলের মসজিদটি ধ্বংস করে সেখানে বিশাল আধুনিক মসজিদ গড়ার তৎপরতা দেখলাম। আগেরবার এখানে পুকুরের পাশে ফাঁকা মাঠ দেখেছিলাম। এটির নাম হাম্মাদিয়া মসজিদ। একটি আদর্শ সুলতানি মসজিদ। এক গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদের মেহরাবে আরবি লিপি-নিদর্শন দেখেছিলাম। মসজিদটি ভাঙার উদ্যোগের খবর দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের কয়েকজন সুহৃদ। ঢাকায় যতদূর সাধ্যে কুলায় চেষ্টা করলাম। কিছু মানুষকে অনুরোধ করলাম। মসজিদ ভাঙা সে দফায় আটকানো গেল। তবে আরেক দফায় ওখানটায় গিয়ে দেখি মসজিদের পাশে আলীশান নয়া ইমারত উঠেছে। দীনহীন পুরনো মসজিদটি আগে যেমন সবদিক থেকে সুন্দরভাবে দেখা যেত, তেমন আর দেখা যাচ্ছে না। তবু সান্ত্বনা, মসজিদটা তো তাও টিকে আছে! 

চুয়াডাঙ্গার মুঘল আমলের ঘোলদাড়ি মসজিদ, কুষ্টিয়ার ঝাউদিয়া মসজিদসহ আরো অনেক প্রত্নস্থাপনা দেখেছি। ঘোলদাড়ি মসজিদটিকে বেশ বিপজ্জনক অবস্থায় দেখেছিলাম। তবে রংপুরের বদরগঞ্জের চাপড়াকোটের সম্ভাব্য পাল যুগের বৌদ্ধ বিহারটিকে নিশ্চিতভাবে নিশ্চিহ্ন হওয়ার জন্য কাল গুনতে দেখেছি। এটি নিয়েও লিখেছি। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার নিমগাছি এলাকায় ও গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নগর ঢিবি ও আশপাশের আরো কিছু প্রত্নঢিবির অবস্থান জরিপ ও প্রত্নানুসন্ধান করার সময় আমার কাছে মূর্তি বিক্রি করতে চেয়েছে কেউ কেউ। 

এসব প্রত্নস্থল প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। থাকার ব্যবস্থা তো দূরে থাকুক খাবারের দোকান পর্যন্ত ত্রিসীমায় নেই। একবার বৃহত্তর দিনাজপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে রাত ঘনিয়ে এলো। রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ল। উত্তরের জনপদ দিনাজপুরের শীত। এক বাড়িতে অন্যগ্রহের দান হিসেবে আশ্রয় পেলাম। এক সম্বলহীনা বৃদ্ধা, যার নিজেরই থাকার সংস্থান নেই, তিনি আমায় তার ঘরে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তার ঘরে কোনো লেপ নেই, চাদর নেই, কাঁথাও নেই। তিনি তার ঘরের মাটির মেঝেতে খড় বিছিয়ে তার ওপর চট বিছালেন। এই চটের ওপর শোয়ার ব্যবস্থা। শুয়ে গায়ে আবারো চট। তার ওপরে আবারো খড়। খুব ভালো ঘুম হলো। লেপ-কম্বলের চেয়ে অনেক ভালো। এই দরিদ্র নারীর স্নেহ-ভালোবাসার কাছে চিরকালের জন্য ঋণী হয়ে গেলাম। আমার দৃষ্টিতে সাহেবদের চেয়ে অনেক বড় ছিলেন ওই নারী। ওই রাতের পর আর কোনোদিনও আমার সাথে দেখা হয়নি সেই নারীর; কিন্তু প্রতিনিয়ত সেই দরিদ্র নিঃসন্তান বিধবা নারীর অস্তিত্ব আমার সঙ্গী। ভালোবাসার চেয়ে বড় সম্পদ মানুষের আর কী আছে! 

প্রত্নকীর্তির সন্ধানে ছোটার কাজটা অব্যাহতভাবেই চলেছে। তা যেমন এ বাংলায়, তেমনি ও বাংলায়ও। তবে বাংলাদেশের মতো অবাধে যাতায়াত করার উপায় পশ্চিমবঙ্গে নেই, বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক নিবিড় ভ্রমণে পাসপোর্ট-ভিসার মতো প্রতিবন্ধকতা আছে। তারপরও পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থলে গিয়ে প্রত্নসন্ধানী গবেষণা কাজ পরিচালনার সুযোগ আমার হয়েছে। এর মধ্যে আছে ঝাড়খণ্ড দিয়ে ঘেরা দূরবর্তী জেলা পুরুলিয়া, বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমা, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার চন্দ্রকেতুগড় ও খনা মিহিরের ঢিবি ও মুর্শিদাবাদ। বিষ্ণুপুরের মধ্যযুগীয় মল্ল রাজাদের কীর্তিগুলোর সংরক্ষণ ব্যবস্থা ভালো। খ্রিষ্টীয় ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের কীর্তিই নয় প্রস্তর যুগের মানববসতিও ছিল পুরুলিয়া, বর্ধমান, বীরভূম, মেদিনীপুর জেলায়। মৌর্য, গুপ্ত, পাল, এমনকি মৌর্যপূর্ব যুগের নিদর্শনও এখানে পাওয়া গেছে। পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ একটি জাদুঘরও আছে বিষ্ণুপুর শহরে। আছে বিখ্যাত দলমাদল কামান। এই কামানের গায়ে হেলান দিয়ে তোলা কাজী নজরুল ইসলামের একটি বিখ্যাত ছবি আছে। দেখলামও প্রাণ ভরে। মাকড়া পাথর বা ঝামা পাথর এখানে সহজলভ্য ও সেগুলো দিয়েই বানানো হয়েছে অনেক মন্দির। তবে ইটের তৈরি মন্দিরও আছে। শ্যামরায় মন্দির ও জোড়বাংলা মন্দির বিশেষভাবে আলোচিত। আর জোড়বাংলা মন্দিরটির কথা বিশেষ করে বলতেই হয়। কারণ টেরাকোটার কাজের জন্যে দুই বাংলায় এই মন্দিরের বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। টেরাকোটার অলঙ্করণে এখানে অভিনবত্ব ও বিষয় বৈচিত্র্য আছে। 

বাংলাদেশের দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরের কথা মনে পড়ল এ মন্দির দেখার সময়। নিঃসন্দেহে এই দুটি মন্দিরই বাংলার মধ্যযুগীয় টেরাকোটার অলঙ্করণের শ্রেষ্ঠ কাজকে ধারণ করে রেখেছে। না দেখলে এর সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যাবে না। মুঘল আমলের সামাজিক, রাজনৈতিক ও শৈল্পিক অবস্থার ছাপ এতে মেলে।

চন্দ্রকেতুগড় এলাকা একটি খ্রিস্টপূর্ব কালের প্রত্নস্থল। খনা মিহিরের ঢিবিতে অনেক প্রত্নানুসন্ধান হয়েছে। খ্রিস্টপূর্বকালের প্রত্নসম্পদ এখানে পাওয়া গেছে। এখানকার টেরাকোটার ভাস্কর্য নিদর্শনের সৌন্দর্যের বিশ্বখ্যাতি রয়েছে। অযোধ্যা পাহাড়সহ অন্য প্রত্নস্থলগুলোর অবস্থান শহর এলাকার কাছে বলে সেগুলো দেখতে বিশেষ সমস্যা হয়নি। এভাবে আমার প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার কাজ অবিরত চলছে, কোনো কিছুর প্রত্যাশা ছাড়াই।

লেখক: প্রত্ন গবেষক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh