প্রকৃতির আলিঙ্গনে একদিন

সজল জাহিদ

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২১, ১০:১৫ এএম

টেকনাফের এই জায়গাটি আমার কাছে সব সময়ের জন্যই ভীষণ প্রিয়। এর আগে যতবার টেকনাফ গিয়েছি বা টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন গিয়েছি, সব সময়, সবকিছুর মধ্যে এই জায়গাটির প্রতি একটি মুগ্ধতা তৈরি হয়েছে। যার অন্যতম কারণ বোধহয় এই জায়গার পথ উঁচু একটি পাহাড়চূড়া দিয়ে নিচ থেকে উপরে, আবার আরেক পাহাড়চূড়া পেরিয়েই ঝুপ করে নেমে গেছে নিচে বা সমতলে। যে পাহাড়চূড়ার ঠিক মাঝখানে দাঁড়ালে, হাঁটলে বা বসে নিচে তাকালে নাফ নদের তীর এসে মিশে গেছে একদম নেটং পাহাড়ের পায়ের কাছে।

কতবার যে নদীতে বা বাসে যাওয়া আসার সময় এই জায়গার দিকে তাকিয়ে আফসোস করেছি, তার হিসাব নেই। মনে মনে কতবার যে এই পথের পাহাড়চূড়ায় বসে বসে নাফ নদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকার কল্পনা করেছি, কতবার মনে মনে ভেবেছি যে, কোনো এক কুয়াশা জড়ানো সকালে অথবা সোনালি সন্ধ্যায় নাফ নদের তীরে, নেটং পাহাড়ের এই চূড়াটায় চুপ করে বসে থেকে নদীর কলকল শব্দ শুনব, পাহাড়ি পাখিদের উড়ে যাওয়া দেখব, জেলেদের ঘরে ফেরা দেখব, নদী আর পাহাড়ের ঝিরিঝিরি বাতাস গায়ে মাখব, অদ্ভুত আনন্দের কিছুটা সময় কাটাব! 

কিন্তু কোনোদিন এই ইচ্ছে, এই স্বপ্ন পূরণের সুযোগ আমি পাইনি। কোনোভাবেই কোনো উপায় বের করতে পারিনি। তাই দিন যত গেছে, এই পথ দিয়ে যত গেছি, এই পাহাড়ের পায়ের কাছের নদীতে ভেসে অথবা নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়চূড়া দিয়ে চলে যাওয়ার সময় শুধু আফসোসে পুড়েছি, আক্ষেপ বেড়েছে আর আমার অপেক্ষা দীর্ঘতর হয়ে রয়ে গেছে।

বাস যখন টেকনাফ শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে নামিয়ে দিল, আর শহরে যাওয়ার কোনো বাহন খুঁজে পেলাম না, তখন মেজাজটা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল বটে। তাই ভাগ্যকে দোষারোপ করে যখন বাহনের আসা বাদ দিয়ে দু’পায়ে হাঁটা শুরু করলাম, তখনো কি ভাবতে পেরেছিলাম, সামনেই আমার অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণের সেই পাহাড়-নদীর অদ্ভুত সম্মিলনস্থল অপেক্ষা করে আছে! এমন কিছু যে সামনে আছে, আমি পেতে পারি, পায়ে পথ চলা শুরু করার পরে কিছুতেই ভাবতে পারিনি সত্যি। তারপরেও মেজাজ আরও বিগড়ে গেল যখন একটি বাসে উঠেও একটু পরে রাস্তায় জ্যামের জন্য নেমে যেতে হয়েছিল বলে; কিন্তু আরও কিছুটা এগিয়ে সমতল পিচঢালা পথ যখন ধীরে ধীরে পাহাড়ি পথে ওপরের দিকে উঠে যেতে শুরু করতেই কেন যেন আমার মনে হতে শুরু করেছিল কষ্ট হলেও সামনে আমার জন্য কিছু একটি অপেক্ষা করছে! যা আমার মন খারাপ দূর করে দেবে নিমিষেই, প্রাণ ভরে দেবে মুহূর্তেই, আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠব এক ঝলকেই, প্রাপ্তির খাতার আর একটি পাতা ভরে যাবে সেখানে পৌঁছেই। 

পিঠে একটি ব্যাকপ্যাক আর বুকে একটি খাবার পানির ব্যাগ নিয়ে শীতের কনকনে সকালেই ঘেমে নেয়ে আর হাঁপিয়ে উঠেছিলাম কয়েক মিনিটের মধ্যেই। তবুও হাল ছাড়া যাবে না এই মানসিকতা নিয়েই একটি সময় ধীরে ধীরে উঠে গেলাম পিচঢালা সেই পথের, পাহাড়চূড়ায়। আর তারপর? 

আমি নেটং পাহাড়ের চূড়ায় বসে বসে, নাফ নদে পা ঝুলিয়ে দোল খাচ্ছি, পাহাড়ের পায়ের কাছে নাফ নদের মৃদু ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, রাতের মাছ ধরা শেষে জেলেদের ঘরে ফেরার জন্য মাছ ধরার রঙিন ট্রলারগুলোর নোঙর করা, ধোঁয়া ওঠা নদীর জলের সঙ্গে শীতের কুয়াশার মাখামাখি আলিঙ্গন! পাহাড়ের ঘন অরণ্যে মেঘ বা কুয়াশার চাদর, সকালে বুনো পাখিদের কিচিরমিচির, নীরব, নিশ্চুপ, হিম হিম এক শীতল সকালে আমি আমার স্বপ্নের সেই পাহাড় আর নদীর সম্মিলনে বসে আছি একরাশ সুখের স্মৃতি জমা করে, একটি অপার্থিব সুখের সকালের কাছে এর বেশি আর কি-ই বা চাওয়ার থাকতে পারে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh