উপালি শ্রমণ
প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২১, ১০:৪৮ এএম
মধ্য যুগের ইতিহাসে যত বাঙালি মনীষী কর্ম ও কীর্তির জন্য অমর হয়ে আছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম পরিচিত ও আলোচিত হচ্ছেন পঞ্চদশ শতাব্দীর বাঙালি কবি রামচন্দ্র। অতীশ দীপঙ্কর যেভাবে তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের পুনঃজাগরণে অবদান রেখেছিলেন, বা আলাওল যেমন আরাকান রাজসভায় মহাকাব্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন; রামচন্দ্রের জীবন ও অবদান সে রকম রোমাঞ্চকর বা ব্যাপক না হলেও কোনোভাবেই নগণ্য নয়। রামচন্দ্র বর্তমানে কম পরিচিত হওয়ার একটি কারণ হয়তো তার জীবনী নিয়ে বিস্তারিত দলিলের অভাব। আমরা তার সম্পর্কে মূলত জানতে পারি, সংস্কৃত ভাষায় রচিত কিছু গ্রন্থ থেকে। ‘ভক্তি শতকম’ নামে তার একটি গ্রন্থ শ্রীলঙ্কার পরিবেণা বা বৌদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো অধ্যয়ন করা হয়। বলা যায়, মূলত এই গ্রন্থের কারণেই রামচন্দ্রের জীবনী সম্পর্কে যৎসামান্য তথ্য এখনো সংরক্ষিত রয়েছে।
ভক্তি শতকম অনুসারে, রামচন্দ্র গৌড় প্রদেশে বরেন্দ্র অঞ্চলের বেরাবতী গ্রামের এক কাত্যয়নী ব্রাহ্মণ কুলে জন্মগ্রহণ করেন। তার সঠিক জন্ম ও মৃত্যু সাল উল্লেখিত হয়নি। বর্তমানে উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিভক্ত হয়ে আছে। শ্রীলঙ্কায় তিনি গৌড়দেশীয় পণ্ডিত ‘রামচন্দ্র ভারতী’ হিসেবেই পরিচিত হন। সেকালের শিক্ষা রীতি অনুসারে, রামচন্দ্র যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, ছন্দ, হিন্দু পৌরাণিক সাহিত্য ইত্যাদিতে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং নিজেও একজন কবি, ব্যাকরণবিদ ও ছন্দ বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। তখন শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ভিক্ষু শ্রী রাহুলা ছিলেন উপমহাদেশের একজন সুখ্যাত পণ্ডিত। ছয়টি ভাষায় সমানভাবে দক্ষ ছিলেন বলে শ্রী রাহুলাকে ‘বাগীশ্বর’ এবং ‘ষড় ভাষা পরমেশ্বর’ অভিধায় ভূষিত করেন রাজা পরাক্রম বাহু।
শ্রীলঙ্কার ইতিহাস অনুসারে, শ্রী রাহুলা ত্রিপিটক মুখস্ত বলতে পারতেন। বৌদ্ধ ধর্ম ছাড়াও জ্যোতির্বিদ্যা ও আয়ুর্বেদেও তার সমান দক্ষতা ছিল। বিভিন্ন বিষয়ে পাণ্ডিত্যের কারণে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে সুখ্যাত ছিলেন। এমনকি রামচন্দ্রের মতো একজন উচ্চ কুলের বাঙালি ব্রাহ্মণও রাহুলার পণ্ডিত্যের আকৃষ্ট হয়ে চলে আসেন শ্রীলঙ্কায়। উৎকৃষ্ট গুরুর কাছে শিক্ষার জন্যে রামচন্দ্রের এই লঙ্কাগমন তার প্রায় তিনশ বছর আগে গুরু ধর্মকীর্তি শ্রীর সাক্ষাতের জন্য অতীশ দীপঙ্করের ইন্দোনেশিয়া যাত্রার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
রামচন্দ্র যখন শ্রীলঙ্কায় আসেন, তখন শ্রী রাহুলা ছিলেন বিজয়াবাহু পরিবেণের প্রধান অধ্যক্ষ। এই পরিবেণটি তোটাগামুওয়ে অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত এবং সেখানে তিনি স্থায়ীভাবে থাকতেন। তাই শ্রীলঙ্কায় এখনো তিনি ‘তোটাগামুওয়ে রাহুলা’ নামেই পরিচিত। শ্রী রাহুলা রাজা পরাক্রম বাহুর উপদেষ্টা ছিলেন। তাই রাজধানী কোট্টেতেও তার অনেক সময় থাকতে হতো। কোট্টে সরকারিভাবে এখনো শ্রীলঙ্কার প্রশাসনিক রাজধানী (আর কলম্বো বাণিজ্যিক রাজধানী), যা বর্তমানে জয়বর্ধণপুরা নামেও পরিচিত। এখানেই রামচন্দ্রের সঙ্গে শ্রী রাহুলার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। সাক্ষাতের পর শ্রী রাহুলার কাছ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের দীক্ষা নিতেও দেরি করেননি রামচন্দ্র। যথাযথ সাধনার মাধ্যমে ইহজন্মে নির্বাণ লাভের সম্ভাবনাই রামচন্দ্রকে বৌদ্ধধর্মে আকৃষ্ট করেছে বলে উল্লেখ আছে তার ভক্তি শতকমে।
রামচন্দ্রের ভক্তি শতকম (নামান্তরে বৌদ্ধশতকম) গ্রন্থটি বুদ্ধ ও বৌদ্ধ দর্শনের প্রতি তার অগাধ ভক্তির প্রকাশ। এটি বুদ্ধের জীবনী নয়, যদিও কবি প্রাসঙ্গিকভাবেই বুদ্ধের জীবনের কিছু কিছু ঘটনা উল্লেখ করে ভক্তি প্রকাশ করেছেন। অষ্টম শতাব্দীতে রচিত আচার্য শান্তিদেবের ‘বোধিচর্যাবতার’ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায় তথা ‘পাপ মোচন’ এর ভাষা ও আবেগের সঙ্গে রামচন্দ্রের ভক্তি শতকমের কিছুটা মিল রয়েছে। ১০৭টি গাথায় রচিত প্রাঞ্জল ও বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় বুদ্ধের প্রতি একজন কবির একান্ত আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশে ভক্তি শতকম গ্রন্থটি অনন্য। এ গ্রন্থে বুদ্ধের প্রতি তার সুদৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা প্রকাশ পেয়েছে। সর্বোপরি নিজেকে সমস্ত পাপ থেকে উত্তরণ করে একজন পরিশুদ্ধ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই তার মূল লক্ষ্য। নিজের অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে প্রজ্ঞার আলো উদ্ভাসিত করার জন্য সচেষ্ট এই কবি তার পাঠকগণকেও আহ্বান করেছেন এই মহতী উদ্যোগে শামিল হতে। হৃদয়ের অকৃত্রিম অনুভূতি ও বুদ্ধের বিবিধ গুণাবলির বর্ণনায় তার কবিত্বের বিশেষ স্বাক্ষর রয়েছে এই গ্রন্থে। বুদ্ধের কাছে শরণ নেওয়ার কারণ তিনি ব্যক্ত করেছেন এভাবে-
কোনো সুবিধা অর্চনা পাওয়ার জন্য নয়
নয়কো ভয়ে চকিত হয়ে বা সুনামের জন্য
তুমি ধর্ম-রবির কিরণে উজ্জ্বল- সেহেতুও নয়
তোমার বিদ্যার আশায়ও নয় হে মুনিবর
পরম্পরায় জ্ঞাতি বলেও নিইনি শরণ, তবে
সর্ব জীবের তরে নিবেদিত সম্যক প্রজ্ঞায়
দেখেছ সবারে তুমি, সংসার সমুদ্র হতে
উত্তরণের জন্যই নিয়েছি শরণ তোমার। (গাথা-২৪ )
এতেই বোঝা যায়, রামচন্দ্র বুদ্ধের শরণ নিয়েছেন কোনো প্রকার লাভ বা সম্মান আশা করে নয়। ভয় বা বুদ্ধের প্রতি অন্ধভক্তির কারণেও নয়। বরঞ্চ প্রজ্ঞা ও করুণার মাধ্যমে দুঃখের সমুদ্র পার করার জন্যই তিনি বুদ্ধের শরণ নিয়েছেন। এই গ্রন্থটি রাজা পরাক্রম বাহুকে এমনভাবেই প্রভাবিত ও আনন্দিত করেছিল যে, তিনি কবি রামচন্দ্রকে ‘বৌধাগামা চক্রবর্তী’ উপাধি প্রদান করেন।
রামচন্দ্রের ভক্তি শতকমে তৎকালীন বৈষ্ণব ভক্তির চর্চা ও সাহিত্য ধারার প্রভাব থাকা অসম্ভব নয়। বৈষ্ণবী সাহিত্যে যেভাবে একজন ভক্ত সম্পূর্ণ রূপে নিজের আরাধ্য ঈশ্বরের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করে দেন, রামচন্দ্রের ভক্তি শতকম গ্রন্থেও ভক্তের আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে সেভাবে। এখানে বিবেচ্য বিষয় হলো- বৈষ্ণবী কাব্য বা সংগীতের মতোই ভক্তি শতকে বুদ্ধের সঙ্গে কবি বা ভক্তের যে সম্পর্ক, সেটি একান্তই ব্যক্তিগত ও আন্তরিক এবং একেবারে হƒদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত বলেই কবি রামচন্দ্রের ভাষায় সর্বজনের আবেগ প্রকাশ পেয়েছে।
ওই গ্রন্থে ভক্তি মুখ্য হলেও রামচন্দ্র নৈতিক আদর্শের প্রকাশও করেছেন নিজের মতো করে, কাব্যিক ভাষায়। বিশেষ করে উল্লেখ্য, রামচন্দ্র একজন ব্রাহ্মণ হয়েও উচ্চকূলে জন্মের কারণে দম্ভ করাকে মূল্যহীন বলে ব্যক্ত করেছেন। নিরহঙ্কারী এবং হিংসা বা বৈরিতাহীন লোক যেন জন্মে জন্মে তার মিত্র হয়, সে প্রার্থনাই তিনি করেছেন বারবার। ভক্তি কাব্যে সাধারণত আরাধ্য গুরু, দেবতা, বা ঈশ্বরের প্রতি একান্ত ভক্তিকেই নৈতিক জীবন চর্চার মূল উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। কবি রামচন্দ্রও পরম মৈত্রীময় বুদ্ধের বিবিধ গুণাবলি উল্লেখ করে বলেছেন, একাগ্রচিত্তে বুদ্ধের শরণ নেওয়ার ফলে অনন্ত কুশলের সঞ্চয় হয়। এ যেন বুদ্ধাণুস্মৃতি ধ্যানেরই সম্প্রসারণ।
ভক্তি শতকম গ্রন্থটির উপর উনবিংশ শতাব্দীতে শ্রীলঙ্কায় শীলকখন্দ নামের একজন পণ্ডিত ভিক্ষু সংস্কৃত ভাষায় একটি ব্যাখ্যামূলক ভাষ্য রচনা করেন। বর্তমানে তার ভাষ্যসহ শ্রীলঙ্কার পরিবেণায় সংস্কৃত বিষয়ের কোর্সে এটি শিক্ষা দেওয়া হয়। এর প্রথম আধুনিক সংস্করণ ও ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৮৯৩ সালে। এরপর ১৯৪৫ সালে বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবিরের দ্বারা প্রথম এবং ১৯৯৯ সালে জ্যোতিপাল মহাথের কর্তৃক দ্বিতীয় বঙ্গানুবাদ প্রকাশ হয়। ১৯৮৫ সালে জার্মানির বিখ্যাত স্কলার হাইঞ্জ বেচার্ট তার শ্রীলঙ্কার সংস্কৃত সাহিত্য (Sanskritexte aus Ceylon) গ্রন্থেও ভক্তি শতকমের মার্জিত সংস্করণ প্রকাশ করেন। ভক্তি শতকম ছাড়াও রামচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো- ‘বৃত্তরত্নাকরপঞ্চিকা’ এবং ‘বৃত্তমালেখ্য’। দুটিই সংস্কৃত ছন্দের গ্রন্থ। এর প্রথমটি হলো- কেদারনাথ ভট্টের ‘বৃত্তরত্নাকর’ তথা সংস্কৃত ছন্দের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের উপর ভাষ্য। সেখানে গুরু শ্রী রাহুলাকে উৎসর্গিত প্রশস্তির মাধ্যমে রামচন্দ্র একটি ছন্দের উদাহরণ দিয়েছেন। ‘বৃত্তমালেখ্য’ হলো- সংস্কৃত কিছু দুর্বোধ্য ছন্দের ওপর রামচন্দ্রের মৌলিক গ্রন্থ। এখানেও ‘দীপঙ্কর’ নামে একজন ভিক্ষুর জন্য প্রশস্তি লিখেছেন রামচন্দ্র। এ থেকেই এই মহান বাঙালি কবির অসাধারণ কাব্যপ্রতিভার কিছুটা আন্দাজ করা যায়।