আচরণ পরিবর্তনে প্রচার: করোনা ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প প্রেক্ষিত

আব্দুল জব্বার তপু

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২১, ০৪:০৮ পিএম

২০১৯ সালের শেষের দিকে চীনের উহান রাজ্য থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মোকাবেলায় গত এক বছর ধরে নাজুক পরিস্থিতিতে বিশ্বের প্রতিটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। ওয়ার্ল্ড ওমিটারের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বের ২২১ দেশের ১০ কোটি ২৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৩৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। একই সময়ে মারা গেছেন ২২ লাখ ১৭ হাজার ৯৭০ জন। বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত করোনা আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ লাখ ৩৪ হাজার ৭৭০ জন এবং মারা গেছেন আট হাজার ১১১ জন। দেশের অন্যান্য জেলার মতো পর্যটন নগরী কক্সবাজারও করোনার ভয়াল থাবার শিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং হেলথ সেক্টর কক্সবাজার কর্তৃক প্রকাশিত সাপ্তাহিক করোনা আপডেট অনুযায়ী, চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৪২৯ জন এবং মারা গেছেন ৭৩ জন বাংলাদেশি। 

এই কক্সবাজার জেলার দুইটি উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফে শরণার্থী শিবিরে ২০১৭ সালে মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় সাড়ে আট লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। সেখানে প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ৪৬ হাজার লোক বসবাস করে, যা পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। প্রায় ৭৫ শতাংশ পরিবারে একাধিক সদস্য একই ঘরে বসবাস করে এবং অধিকাংশ পরিবারই রান্নাঘর, খাবার পানির ট্যাপ এবং টয়লেট ভাগাভাগি করে ব্যবহার করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং হেলথ সেক্টর কক্সবাজার কর্তৃক প্রকাশিত সাপ্তাহিক করোনা আপডেট অনুযায়ী, ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৭১ জন রোহিঙ্গা করোনা আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ১০ জন রোহিঙ্গা। 

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের একদল গবেষক  তিন বছর মেয়াদি একটি অংশগ্রহণমূলক গবেষণা প্রকল্পের অংশ হিসেবে করোনাভাইরাস সম্পর্কে কক্সবাজার জেলায় বসবাসরত স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মতামত, ধারণা এবং আচরণ বিষয়ে জানার জন্য ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার ও দলীয় আলোচনার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেছে। উক্ত গবেষণা প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ এবং সেন্টার ফর পিস এন্ড জাস্টিস; যার অর্থায়ন করছে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি)- কানাডা। 

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে করোনাভাইরাসের লক্ষণ, করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার উপায়, সংক্রমণের মাধ্যম প্রভৃতি বিষয়ে একদিকে যেমন কমবেশি জ্ঞান লক্ষ্য করা যায় তেমনি দেখা যায় অসংখ্য ভুল ধারণা। করোনা সংক্রমণের উপায় নিয়ে তথ্যদাতাদের অধিকাংশই জানান, কাশির মাধ্যমে করোনা ছড়ায়- কাশির পরে যে জীবাণু বের হয়, সেখান থেকে ছড়ায়। কেউ কেউ বলেন, করোনাযুক্ত বাতাস থেকে করোনা ছড়ায়, একজন আরেকজনকে স্পর্শ করলে বা জড়িয়ে ধরলে করোনা ছড়ায়, মাছির মাধ্যমে করোনা ছড়ায়। করোনাভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে তথ্যদাতাদের কেউ কেউ বলেন, কাশি, সর্দি, জ্বর, শরীর ব্যাথা, শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা, হার্টে সমস্যা প্রভৃতি। করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার উপায় প্রসঙ্গে তথ্যদাতারা বলেন, মাস্ক ব্যবহার করা, দূরত্ব বজায় রেখে চলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে চলা, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, গরম পানি খাওয়া প্রভৃতি। ১৬ বছর বয়সী একজন কিশোরী বলেন, নিউটেশন (স্বাস্থ্যকর্মী) আপা বলছে, কারো সাথে কথা বলবেন না, যদি বলতে হয় ৩ ফিট দূরে থাকতে হবে, কথা বলার সময় মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, আর খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।

করোনা সম্পর্কিত জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে তথ্যদাতারা জানান, করোনার শুরুতে অর্থাৎ, ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে বিভিন্ন ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে মাইকিং করে করোনাভাইরাস নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার করা হয়। কিছু প্রতিষ্ঠান বর্তমানেও এই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। ক্যাম্পের ভেতরে করোনাভাইরাস থেকে সচেতন থাকা সম্পর্কিত বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানার-পোস্টার লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া মাইকিং কার্যক্রম দেখা যায়। যেখানে রোহিঙ্গা ভাষায় মাইকিং করতে শোনা যায়।

উল্লেখ্য, গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ক্যাম্পের ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের করোনা সম্পর্কিত জ্ঞান কম লক্ষ্য করা যায়। এর কারণ সম্পর্কে ১৬ বছর বয়সী একজন কিশোরী বলেন, আমরা তো বাইরে যাই না, তাই জানতে পারি না। 

অন্যদিকে বেশি কিছু বয়স্ক (৬০-৭০ বছর) তথ্যদাতা জানান, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরলে করোনা হবে না। কারণ নামাজের আগে ওজু করা হয়। আর অজুর মাধ্যমে জীবাণু চলে যায়। কেউ কেউ বলেন, রোদে কাজ করলে করোনা হবে না। কারণ, রোদে কাজ করলে ঘাম হয় আর ঘামের সাথে জীবাণু চলে যায়। ৬০ বছর বয়সী আরেকজন তথ্যদাতা বলেন, আমার জন্য করোনা নাই। বলছি যে যেখানে গরমে ঘাম বাইর হয়ে যাচ্ছে, আমার জন্য করোনা কীসের? যে নাকি পেনের (ফ্যানের) নিচে বসে আরামে বেতন খাবে তার করোনা হইতে পারে। 

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতামূলক জ্ঞান থাকলেও তাদের এগুলো মানার ক্ষেত্রে ভিন্ন রূপ দেখা যায়। গবেষণা চলাকালে পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ক্যাম্পের রাস্তায় বা বাজারের মানুষের মাস্ক ছাড়া চলাচল, চায়ের দোকানে আড্ডায়-দোকানে কেনাবেচা করার ক্ষেত্রে কোথাও কোনো ধরনের সাবধানতা লক্ষ্য করা যায়নি। রেশন গ্রহণের সময় কেউ কেউ মাস্ক পরলেও রেশন গ্রহণের পরপরই তা খুলে ফেলতে দেখা যায়। কেউ মাস্ক পরলেও তা নাকের নিচে, মুখের নিচে এমনকি থুতনির নিচে গলায় ঝুলিয়ে রাখতে দেখা যায়। ক্যাম্পের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে সরকারি-বেসরকারি উদ্দ্যোগে সাবান-পানির ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কাউকে হাত ধুতে দেখা যায়নি। শুধু মাত্র যারা সেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে, তাদের কাউকে কাউকে হাত ধুতে দেখা গেছে।  

করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও সে অনুযায়ী না মেনে চলার যেমন রয়েছে কিছু বাস্তবসম্মত কারণ, তেমনি রয়েছে তাদের ভুল ধারণা। ৫০ বছর বয়সী একজন পুরুষ তথ্যদাতা জানান, এখানে তো ঘন পরিবেশ। তো ভাই দূরত্ব বজায় রাখাটা খুব কঠিন। কেউ কেউ বলেন, তারা তাদের এলাকায় কেউ করোনা আক্রান্ত হয়েছে বা মারা গেছে এমন কথা শুনেনি। তাই তারা বিশ্বাস করে না যে, ক্যাম্পে করোনা আছে। যদি কেউ আক্রান্ত হতো বা মারা যেত তাহলে মানুষ ভয় পেতো এবং স্বাস্থ্যবিধি মানতো। 

গবেষণার ফলাফল এবং গবেষকদের পর্যবেক্ষণ থেকে একটি প্রশ্ন আসে যে, করোনা সম্পর্কে জানার পরও তা না মেনে চলার কারণ কি শুধুই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অসচেতনতা নাকি দুর্বলতা রয়েছে তথ্য প্রচারকারী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরও? 

কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে কোনো জনগোষ্ঠীর আচরণ পরিবর্তন করতে হলে প্রথমে ওই বিষয়ে সমাজের মানুষ কী বিশ্বাস পোষণ করে তা জানতে হবে। সঠিক তথ্য দেয়ার পাশাপাশি কোনো ভুল ধারণা থাকলে তা দূর করতে হবে। তাদের বিশ্বাস এবং সঠিক তথ্যের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। ওই জনগোষ্ঠীর ভাষার মানুষ দিয়ে তথ্য প্রচার করতে হবে। এটাই হলো তথ্যের স্থানীয়করণ। যে পদ্ধতি হবে বটম-আপ (নিচ থেকে উপরে)। তবেই তাদের বিশ্বাস পরিবর্তন হবে। আর বিশ্বাস পরিবর্তনের সাথে সাথে আচরণও পরিবর্তন হবে। 

এই লক্ষ্যে ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেন্টার ফর পিস এণ্ড জাস্টিস, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান চলমান এই প্রকল্পটি উক্ত পদ্ধতিতে করোনা বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছে।  

দেশের যেকোনো স্থানের তুলনায় ক্যাম্পের মধ্যে করোনা সংক্রমন কম দেখা গেলেও রয়েছে শঙ্কা। একদিকে, অতিরিক্ত ঘনবসতি অন্যদিকে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে বসবাসরত দেশি-বিদেশি কর্মীদের নিয়মিত ক্যাম্পে আসা-যাওয়া। কারো মাধ্যমে কেউ আক্রান্ত হলে মুহূর্তের মধ্যে তা অনেক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে। ক্যাম্পে বসবাসরত এই জনগোষ্ঠীর করোনা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো, করোনা সম্পর্কিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। আর স্বাস্থ্যবিধি তখনই মানা সম্ভব যখন তাদের বিশ্বাস ও জ্ঞানের সমন্বয় হবে। আমরা বিশ্বাস করি, চলমান প্রকল্পটি এই সমন্বয় তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।


লেখক: গবেষক, ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh