হরিণ শিকারের পেছনে শক্তিশালী চক্র

এস.এস শোহান

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৬:৫০ পিএম

পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সাধারণ মানুষের আকর্ষণ ও গুরুত্বের দিক দিয়ে বাঘের পরেই চিত্রল ও মায়া হরিণের অবস্থান। কিন্তু কিছু অসাধু মানুষ সুদীর্ঘকাল ধরে সুন্দরবনের হরিণ শিকার করে আসছে। এই শিকারের সাথে জড়িত রয়েছে শক্তিশালী অপরাধী চক্র।

হরিণ শিকারের জন্য এই চক্রটি সব সময় সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের হতদরিদ্র, লোভী জেলে ও অসাধু বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহার করে। সামান্য আর্থিক লাভের আশায় তারাও ব্যবহৃত হচ্ছেন যুগের পর যুগ। সাম্প্রতিক সময়ে এই চক্রটি খুব বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এই চক্রকে দমন করতে বনবিভাগের পাশাপাশি পুলিশও অভিযান শুরু করেছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সরাসরি হরিণ শিকারের সাথে জড়িতরা ধরা পড়লেও অধরা থেকে যাচ্ছেন মূল হোতারা।

বনজীবীদের দাবি বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ ছাড়া সুন্দরবনের অভ্যন্তরে কোনো অপরাধ করা সম্ভব নয়। সুন্দরবন ও বনের বন্য প্রাণি রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধিসহ জেলে, বনজীবী ও স্থানীয়দের মাঝেও সচতেনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।

সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে করোনাকলীন সময়েও সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ ২১৫ কেজি ৮০০ গ্রাম হরিণের মাংস, দুটি হরিণের চামড়া, একটি হরিণের শিং, ৬টি হরিণের মাথা, ২৪টি হরিণের পা জব্দ করেছে। এসব অপরাধের জন্য ৩২ জনকে আটকও করে বন বিভাগ। সাথে সাথে ৬টি ট্রলার, ১৬টি নৌকা ও ১১ হাজার ৩৩৩ ফুট হরিণ শিকারের ফাঁদ উদ্ধার করে বনবিভাগ। এর বাইরে পুলিশ ও কোস্টগার্ডের অভিযানেও উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ হরিণের মাংস, মাথা ও চামড়া।

কিন্তু ২০২১ সালের মাত্র ৩৫ দিনে বন বিভাগ ৪০ কেজি হরিণের মাংস, একটি বাঘের চামড়া ও ৪ হাজার ৯৫০ ফুট হরিণের ফাঁদ জব্দ করে। পুলিশ ১৯টি হরিণের চামড়া, ৩টি মাথা ও ৪২ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করে। এসবের সাথে চোরা শিকারিরা আটক হলেও বের হয়ে যায় আইনের ফাঁকফোকরে। শাস্তি যা হয় তা হতদরিদ্রদের এমন দাবি হরিণ শিকারের অপরাধে সাজা ভোগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা মানুষদের।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের জেল থেকে ছাড়া পাওয়া এক ব্যক্তি বলেন, আমরা সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতাম। লোভে পড়ে হরিণের মাংস বহন করতে গিয়ে ধরা পরেছি, জেল খেটেছি, জরিমানা দিয়েছি। কিন্তু হরিণ শিকার তো থামেনি, আমাদের জায়গায় এসেছে নতুন মানুষ, রাঘব বোয়ালরা রয়ে গেছে অগোচরে। যারা আমাদের মত অসহায়দের অর্থের লোভ দিয়ে ব্যবহার করে, আপনারা তাদেরকে ধরুন।

বনবিভাগের হাতে হরিণের মাংসসহ আটক এক ব্যক্তি বলেন, আমি শরণখোলা এলাকার বিভিন্ন জায়গায় দিন মজুরের কাজ করতাম। সব জায়গায় আমার যাওয়া আসা ছিলো। বনের এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে জবাই করা হরিণের মাংস ৫০০ টাকা করে ক্রয় করে উপজেলা সদরের ধনী মানুষদের কাছে ৭০০-৮০০ টাকা বিক্রি করতাম। আসলে শিকারের সাথে আমরা জড়িত না। যতদূর শুনেছি শিকার হয় বনরক্ষীদের সহযোগিতায়।

হরিণের মাংস ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত এক মোটরসাইকেল চালক বলেন, শরণখোলা থেকে বন বিভাগে চাকুরীরত এক ব্যক্তিকে হরিণের মাংসসহ অনেকবার সাইনবোর্ডে নিয়ে আসছি। বস্তায় করে এনে মাংসগুলো স্থানীয়দের কাছে দিয়ে আবার দ্রুত সে চলে যেত। এসব কাজে আমরা স্বাভাবিকের থেকে বেশি ভাড়া পাই।

সুন্দরবনের কুখ্যাত চোরাশিকারী মালেক গোমস্তা গ্রুপের এক সদস্য বলেন, আমরা বেশিরভাগ সময় হরিণ শিকার করে মাংসগুলোকে ঢাকায় পাচার করি। ঢাকায় পাঠানো প্রতিকেজি হরিণের মাংসে আমরা দেড় থেকে ২ হাজারের উপরে টাকা পাই। তবে এই মাংস যখন শরণখোলায় ৭০০ টাকা কেজি এবং বাগেরহাট শহরে ১ হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি হয়।


সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে বাঘ হরিণ হত্যাকাণ্ডের বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। হরিণের মাংস, হরিণের চামড়া ও বাঘের চামড়া উদ্ধার হচ্ছে। একটি অসাধু চক্র এর সাথে জড়িত রয়েছে। এর পিছনে গডফাদারের পাশাপাশি বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে। এদেরকে অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় আনতে হবে। বনরক্ষীদের টহল বৃদ্ধি করতে হবে। লোকালয় সংলগ্ন বনে কাঁটাতারে বেড়া দিতে হবে। এখনই যদি বাঘ ও হরিণ শিকার বন্ধ না করা যায় তাহলে সুন্দরবন থেকে বাঘের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।

সুন্দরবনের দস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার অন্যতম ভূমিকা পালনকারী সাংবাদিক যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মোহসিন উল হাকিম বলেন, সুন্দরবন একটি বিস্তৃত জায়গা, সুন্দরবনের বন্যপ্রাণি হত্যা ও নিধন কমাতে বনবিভাগের গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। বনবিভাগের কাছে শিকারিদের যে তালিকা রয়েছে, তাদেরকে বনে প্রবেশের জন্য পাশপারমিট বন্ধ করতে হবে। যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তি সুন্দরবনের অপরাধ কর্মের সাথে জড়িত তাদেরকেও বনবিভাগের তালিকায় এনে নজরদারিতে রাখতে হবে। হরিণ শিকারের পেছনে যে প্রভাবশালীরা রয়েছে তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। হরিণ শিকারের অপরাধের জন্য শাস্তির পরিমাণও বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেন তিনি।

সুন্দরবনের বন্য প্রাণি রক্ষা ও বন ভিত্তিক অপরাধ কমাতে স্থানীয়দের অংশিদারিত্ব বৃদ্ধি করতে হবে। বনসংলগ্ন লোকালয়ের মানুষের মধ্যে বন্য প্রাণির গুরুত্ব জাগিয়ে তুলতে হবে। যেসব অপরাধীরা শাস্তির আওতায় এসেছে এই বিষয়টি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশসহ সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের মানুষের মাঝে ফলাও করে প্রচারের ব্যবস্থা করলে সুন্দরবনের বন্য প্রাণি নিধন কমে আসবে বলে মনে করেন খুলনা বিশ্ব বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এস.এম হায়াত মাহমুদ।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মাদ বেলায়েত হোসেন বলেন, সুন্দরবন রক্ষায় বন বিভাগের পাশাপাশি পুলিশ, র‌্যাব, কোস্টগার্ড কাজ করে যাচ্ছে। সকলের তৎপরতায় আমরা শিকারিদের আটক করে আইনের আওতায় এনেছি। শিকারিদের অপরাধ রুখতে আমরা সুন্দরবনে টহল বৃদ্ধি করেছি। বনবিভাগসহ সকলের চেষ্টায় ভবিষ্যতে সুন্দরবন থেকে চোরাশিকারিরা পালাতে বাধ্য হবে বলে দাবি করেন তিনি।

সুন্দরবনের অপরাধের সাথে বন কর্মকর্তা ও বনরক্ষীরা জড়িত রয়েছে এসব অভিযোগের বিষয়ে ডিএফও মোহাম্মাদ বেলায়েত হোসেন বলেন, বনবিভাগের কোনো ভিন দেশ থেকে আসে না। এদেশেরই মানুষ তারা। আমরা দুই চার জনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ পেয়েছি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। ভবিষ্যতেও যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাবে এবং প্রমাণিত হবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের হুশিয়ারি দেনে তিনি।


বাগেরহাটের পুলিশ সুপার পঙ্কজ চন্দ্র রায় বলেন, জেলা পুলিশ বাগেরহাট সুন্দরবনের বন্য প্রাণি রক্ষায় অভিযান চালু করেছে। আমরা অপরাধ দমনের পাশাপাশি সুন্দরবন এলাকায় জন সচেতনতা মূলক কার্যক্রমও চালু রেখেছি।

বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী চিতা বাঘ, লাম চিতা, উল্লুক, হরিণ, কুমির ঘড়িয়াল, তিমি বা ডলফিন হত্যা করলে দায়ী ব্যক্তির তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা ৩ লক্ষ টাকা জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে দায়ী ব্যক্তির পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে বাঘ ও হাতি হত্যায় দণ্ডিত হলে সর্বনিম্ন দুই ও সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ডের সাথে সর্বনিম্ন একলক্ষ এবং সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। তবে এই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে সর্বোচ্চ ১২ বছরের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১৫ লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh