‘গণতন্ত্রের ঘোমটা’ ছেড়ে কোন পথে মিয়ানমার!

জাকারিয়া পলাশ

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:১৬ পিএম

মিডিয়াপাড়ায় হা-হুতাশ চলছে মিয়ানমারের গণতন্ত্র ‘গেল গেল’ বলে। এই বাস্তবতায় আমরা খতিয়ে দেখতে চাই, সেখানে গণতন্ত্র আদৌ ছিল কি? অং সান সু চিকে সামনে রেখে যে বেসামরিক নেতৃত্ব প্রদর্শিত হচ্ছিল গত এক দশক ধরে, তা মূলত সামরিক বাহিনীর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন গণতন্ত্রেরই একটি ছায়া। দশ বছর এমন একটি ‘গণতন্ত্রের প্রদর্শনী’ করে আসল রূপে ফিরে গেল মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। 

ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনেই দেশটির রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সামরিক বাহিনী। মিয়ানমারের ‘গণতন্ত্রের প্রতীক’ খ্যাত নেত্রী অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) প্রায় সব শীর্ষ নেতাকে আটক করে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। ফলে দেশের সকল নির্বাহী ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ অং লাইয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। 

এ প্রসঙ্গে আলোচনার শুরুতেই বলা দরকার, মিয়ানমারের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্বের মধ্যকার টানাপড়েন বহু পুরনো ব্যাপার। দেশটি ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে বিগত ৭১ বছরের মধ্যে প্রায় ৪৯ বছর সরাসরি সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। তা ছাড়া স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৬২ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নেওয়ার আগ পর্যন্ত সময়কালে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপের সঙ্গে গৃহযুদ্ধ চলেছে। দীর্ঘদিনের যুদ্ধবিগ্রহের ফলে দেশটিতে শুরু থেকেই প্রভাবশালী অবস্থানে ছিল সামরিক বাহিনী। ফলে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী এতটাই অভ্যস্ত হয়েছে যে, তাদের অনায়াশে ‘পাওয়ার হ্যাপি’ বাহিনী বলা যায়। 

অনেকেই বলে থাকেন, ২০০৮ সালের গণভোট এবং ২০১০ সালের নির্বাচন পরবর্তীকাল থেকে এনএলডির বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে হয়তো গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হচ্ছিল মিয়ানমার। বলা হয়, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গত ১০ বছর ধরেই বেসামরিক সরকারের হাতে ক্রমেই ক্ষমতা ছেড়ে দিচ্ছিল; কিন্তু এই সময়ের নানা ঘটনা প্রমাণ করে যে, আসলে দেশের সকল ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতেই ছিল। 

২০০৮ সালে যে সংবিধান পাস করা হয়, সেখানে দেশটির আইনসভার ২৫ শতাংশ আসন এবং প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্তসংক্রান্ত মন্ত্রণালয় সামরিক বাহিনীর হাতে রাখা হয়। ওই সংবিধান অনুযায়ী কোনো দল সংবিধান পরিবর্তন করতে চাইলে তাদের ৭৫ শতাংশ আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হবে। অর্থাৎ সামরিক বাহিনীর ২৫ শতাংশ বাদ দিলে বেসামরিক সব আসনের নিয়ন্ত্রণ না পেলে কোনো দলের পক্ষে সংবিধান পরিবর্তনের সুযোগ নেই। এর মানে হচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গত ১০ বছরে গণতন্ত্রের নামে দেশটিতে রাজনীতির কোনো মৌলিক উন্নয়নের সুযোগ দেয়নি। অন্যদিকে, মিয়ানমারে কথিত এই গণতন্ত্রের সময়কালেই বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকটের সৃষ্টি করা হয়েছে। রাখাইন প্রদেশের এক মিলিয়ন মানুষকে গণহত্যা ও গৃহছাড়া করে একুশ শতকের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরের মানবেতর জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয় বিনাশের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তাকে সংকটাপন্ন করেছে। এই পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রমাণ জাতিসংঘসহ সব মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে রয়েছে। মিয়ানমারের কথিত ‘গণতন্ত্রের প্রতীক’ আর ‘ক্ষমতাহীনকে ক্ষমতাসীন করার আপসহীন’ নেত্রী অং সান সু চিও এই ভয়াবহতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অংশীদার হয়েছেন নীরবে। আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জেনারেলরা কথিত ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থায়ই পূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পেয়ে আসছেন। এসবই প্রমাণ করে যে, মিয়ানমার আসলে গত এক দশকে গণতন্ত্রায়নের পথে মোটেও এগোয়নি। 

লক্ষণীয় বিষয় হলো- যদি ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের দিকে দেশকে এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করার মতো বোধোদয় সামরিক বাহিনীর মধ্যে হতোই, তাহলে সে জন্য ১০ বছর কম সময় নয়। বাস্তবে দেখা গেছে, এ সময়েই উল্টো পথে হেঁটেছে সেনাবাহিনী। এটি আরও বোধগম্য হবে যদি আমরা খেয়াল করি, ক্ষমতা দখলের আগের কয়েক দিনের গতিপ্রকৃতি। 

সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, গত নভেম্বরের নির্বাচনে সামরিক বাহিনী ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএডিপি) নামের একটি দলকে সমর্থন দেয়; কিন্তু ভোটে অং সান সু চির দল এনএলডি ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোট পায়। ভোটের পর পরই জালিয়াতির অভিযোগ তোলে সামরিক বাহিনী। এই অভিযোগকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপ-পরিচালক ফিল রবার্টসনের ভাষায় গণমাধ্যম বলছে, ‘ট্রাম্পসুলভ- প্রমাণ বিহীন অভিযোগ’। লক্ষণীয়, নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলছে সামরিক বাহিনী। এর মধ্য দিয়েই পরিষ্কার হয়, দেশটিতে সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক তৎপরতা কতটা খোলামেলা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সমর্থন দেওয়া দল নির্বাচনে না জেতায় সামরিক বাহিনীর জন্য ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, সামরিক বাহিনীর জেনারেলরা যদি বছরের পর বছর রাজনৈতিক ক্ষমতার চর্চা করেন, তাহলে তাদের এমন তৎপরতাই স্বাভাবিক। এ জন্যই আধুনিক রাষ্ট্রে জেনারেলের দায়িত্ব আর রাজনীতিকের দায়িত্ব আলাদা। যেমনটি বিবিসিকে মিন থান্ট নামে এক বিশ্লেষক বলছিলেন, আন্তর্জাতিক মিডিয়া অং সান সু চিকে দেশের ‘মা’ হিসেবে দেখায়। অন্যদিকে সামরিক বাহিনী মনে করে তারাই এ দেশের ‘পিতা’। 

এই অভ্যুত্থানের পেছনের কারণ নিয়ে নানা বিশ্লেষণ এরই মধ্যে হয়েছে। এই প্রসঙ্গে আরও একটি প্রসঙ্গ সামনে রাখা প্রয়োজন। ভারত মহাসাগরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যে বৈশ্বিক মেরুকরণ চলছে, সেখানে স্পষ্টতই মিয়ানমার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর সেখানে এক দশক আগের চেয়ে বর্তমানে চীনের অবস্থান যথেষ্ট অগ্রসর মনে হয়, যা ট্রাম্প-পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের মাথাব্যথার কারণ। এটি বাইডেন প্রশাসনের বাড়তি মনোযোগের বিষয়ও বটে। এই বাস্তবতায় পশ্চিমাদের কাছে অপেক্ষাকৃত আস্থাভাজন অং সান সু চির চেয়ে চীনের জন্য সরাসরি সামরিক জেনারেলদের ওপর নির্ভর করা সুবিধাজনক হওয়া অসম্ভব নয়। সেদিক থেকে দেখলে মিয়ানমারের এই ‘গণতন্ত্রের ঘোমটা’ নামিয়ে ফেলাকে বৈশ্বিক মেরুকরণে আরও বেশি চীনমুখী হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। 

বলা বাহুল্য, একটি দেশের সামরিক বাহিনী যদি আইনসভার চারআনি দখলে রাখে, নির্বাচনে প্রকাশ্যে একটি রাজনৈতিক দলকে অন্যদলের বিপরীতে সমর্থন দেয়, তাহলে তেমন একটি বাহিনীর উপস্থিতিতে কোনো দেশ ‘গণতন্ত্রের’ পথে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের শাসন; সহজ-সরল, সাধারণের শাসন। রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্র বা ‘ডিপ স্টেট’ চালায় যারা, তারা গভীর জলের মানুষ। তারা যখন কোনো দেশে সম্প্রসারিত হয়, তখন গণতন্ত্র মারা যায়। 

শেষ করার আগে একটি আত্মজিজ্ঞাসা থেকেই যায়। সেটি হলো- এই সংকটের সমাধান কী? পৃথিবীর পাঁচ হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে সভ্য মানুষের সামনে একটিই সমাধান, ‘গণতন্ত্র’। গণতন্ত্রেরও সমস্যা আছে। তার সমাধান আরও গণতন্ত্র। যেমন- আমরা দেখি ফ্যাসিবাদ যদি সংকটে পড়ে, সে আরও বেশি ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠে। তেমনি গণতন্ত্র সংকটে পড়লে, আরও গণতান্ত্রিক হওয়ার বিকল্প নেই। আর সেটি হতে হলে বঞ্চিত ও বিতাড়িত সবাইকে সঙ্গে নিতে হবে। এ জন্য উদ্যোগও নিতে হবে জনগণকেই- গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ‘পাওয়ার হ্যাপি’ সামরিক বাহিনীর ভরসায় কোনোদিন গণতন্ত্র আসে না। এ কথা চিরসত্য। মিয়ানমারের জন্য যেমন, তেমন সত্য পৃথিবীর সব দেশের ক্ষেত্রে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh