এম এইচ রশিদ
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:১২ এএম
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। খাদ্যের প্রধান উপাদান চাল। কৃষকদের পরিশ্রমের উৎপাদিত ধানই দেশের গর্বের বিষয়। করোনাভাইরাস মহামারির ভয়াবহ সংকটের সময়ও কৃষকের পরিশ্রম থেমে থাকেনি।
অর্থনীতিতে বিস্ময়করভাবে টিকে থাকে তার মূল শক্তি অভ্যন্তরীণ কৃষি উৎপাদন; কিন্তু নানা কারণে সেই কৃষকরাই ভালো নেই। ধান উৎপাদন করে নিজেরা যেন আরো নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। উৎপাদিত ধান নিয়ে ছলচাতুরীর মাধ্যমে ফুলেফেঁপে বড় হচ্ছে স্থানীয় ফড়িয়া, মজুদদার ও মিল মালিকরা। অন্যদিকে, ধান উৎপাদন করে ঋণ পরিশোধ করতেই হিমশিম খাচ্ছেন কৃষক।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশের প্রধান খাদ্য চাল; কিন্তু সেই চাল নিয়ে চালবাজি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। যেসব অঞ্চলে ধান উৎপাদন বেশি হতো সেই এলাকার কৃষক ধান উৎপাদন থেকে সরে আসছেন। বগুড়া ও নওগাঁয় ধান উৎপাদন বেশি হয়।
নওগাঁর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে জেলায় ১৮ হাজার ৬০০ হেক্টর ধানের জমি আম বাগানে পরিণত হয়েছে। ১০ বছর আগে গোটা জেলায় আমের বাগান ছিল দেড় হাজার হেক্টরেরও কম। যে হারে জেলায় আমের বাগান বাড়ছে, তাতে আগামী পাঁচ বছরে ধানের জমির পরিমাণ তিনগুণ কমে আমের বাগানে পরিণত হতে পারে। এর কারণ হলো- ধান চাষে পানি বেশি লাগে, পরিশ্রম বেশি, ঝুঁকি বেশি; কিন্তু লাভ কম। অন্যদিকে আম চাষে পরিশ্রম কম ও লাভ বেশি। তাছাড়া বরেন্দ্রভূমিতে পানির সংকট তো আগে থেকেই ছিল, যা কৃষকদের আম চাষের প্রতি আগ্রহী করে তুলছে।
কৃষি-সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, বগুড়া জেলায় গত ৮-১০ বছরে ধানী জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ১২ হাজার হেক্টর। আগে যেসব জমিতে ধান চাষ হতো, এখন ভালো দামের আশায় কৃষক বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি (বিশেষ করে অগ্রিম) এবং উচ্চমূল্যের ফল ও ফসল আবাদ করছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি) চালের প্রাপ্যতা ও দামের অস্থিরতা নিয়ে একটি আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধারে কৃষি উপকরণ ক্রয় ও গ্রামের মজুদাগার ব্যবস্থা উঠে যাওয়ার কারণে দ্রুত ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা। সংগ্রহের এক মাসের মধ্যে ৫২ শতাংশ ধান বিক্রি করে দেন তারা। আর এক থেকে দুই মাসের মধ্যে বিক্রি হচ্ছে ২৫ শতাংশ, দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে ১৮ শতাংশ ও চার মাস বা তার বেশি সময়ের মধ্যে বিক্রি করা হচ্ছে ৫ শতাংশ ধান। অর্থাৎ বেশি দামের আশায় ধান মজুদ করার প্রবণতা কম।
কৃষক ধান বিক্রিতে বাধ্য হন, কারণ তারা ধান উৎপাদনের জন্য বীজ, সার, জমি প্রস্তুতকরণ, ধান সংগ্রহ ও মাড়াইয়ের খরচ মেটাতে স্থানীয় ব্যবসায়ী, এনজিও ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঋণ গ্রহণ করেন। তারা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সার ও বীজ উচ্চমূল্যে বাকিতে কিনে থাকেন। ধান সংগ্রহের সাথে সাথে এসব অর্থ পরিশোধের জোরাজুরি থাকে। এজন্য কৃষক সংগ্রহের সাথে সাথে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন। আর ওই সুযোগে ধানের দাম অনেক কমিয়ে দেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ শেষ হলেই বাজারে ধান ও চালের দাম বেড়ে যায়। এই প্রক্রিয়া কৃষকের জন্য বেশ ক্ষতির কারণ হচ্ছে। ধানের মজুদাগার ও আর্থিকভাবে কৃষকদের সক্ষম করে তুলতে পারলে কৃষককে ধানের মাধ্যমে আরও বেশি লাভবান করা সম্ভব।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে কৃষকের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কৃষক যে ভালো নেই, এটি তার একটি প্রতীকী চিত্র। প্রধানত, দুটি কারণে মৌসুমের শুরুতে কৃষক ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন। প্রথমত, কৃষক ধারদেনা করে ধান উৎপাদন করে বলে দ্রুত অর্থ পরিশোধের তাড়া থাকে। অন্যদিকে, কৃষকের ঘরে এখন আর বাড়তি জায়গা নেই। ফলে আর্থিক সক্ষমহীনতা ও মজুদাগারের অভাবে বাধ্য হয়েই ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন কৃষক। এ কারণে ধানের বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে মিলার ও ব্যবসায়ীদের হাতে। আবার কৃষকের ধান উৎপাদন খরচ এক যুগ ধরে প্রতি বছর গড়ে ২-৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে, এই এক যুগে মুনাফা কমে গেছে প্রায় ৮ শতাংশ। ফলাফল- ধানের প্রকৃত দামে হ্রাস। একদিকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, অন্যদিকে মুনাফার কমতি কৃষকদের আর্থিক সক্ষমতায় দারুণভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে।’
এজন্য সরকারকে মোট উৎপাদিত ধানের ন্যূনতম ১০ শতাংশ সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহের পরামর্শ দেন তিনি।
বাজার বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, কয়েক বছর ধরে ধানের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। আনুষঙ্গিক সবকিছুর দাম বাড়ছে। অথচ ধানের প্রকৃত দাম কমে যাচ্ছে প্রতি বছরই। সম্প্রতি ধানের দাম বেশি থাকলেও, বিগত কয়েক বছর বোরো ধান লোকসানে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন কৃষক। অথচ সারাদেশে বোরা ধানের আবাদ হয় সবচেয়ে বেশি। বোরো আবাদে কৃষকের হেক্টরপ্রতি লোকসান এখন প্রায় ৬ হাজার টাকা। এ লোকসানের অন্যতম কারণ শ্রমিক ব্যয়। পারিবারিক ও ভাড়া শ্রমিকের পেছনে ব্যয় হচ্ছে মোট উপকরণ খরচের প্রায় ৪৬ শতাংশ। কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে যান্ত্রিকীকরণ ও কৃষিপণ্যের আধুনিক বাজার ব্যবস্থা ও বাণিজ্যিকীকরণ দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে এসিআই এগ্রিবিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ড. ফা হ আনসারী বলেন, ‘কৃষকদের ক্ষতির বিষয়টি সামনে এসেছে। এখন তাদের সমাধানের পথে নিয়ে আসতে হবে। কৃষিতে প্রযুক্তির ও যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে। এতে কৃষকদের উৎপাদন সংক্রান্ত ব্যয় অনেক কমে যাবে। আবার যন্ত্রের ব্যবহার হলে অপচয় কমে গিয়ে সাশ্রয়ী হবে। পাশাপাশি বাণিজ্যিক সুবিধা দিতে উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া প্রথাগতভাবে ধান কাটা ও মাড়াই করলে ধানের ১২-১৫ শতাংশ নষ্ট হয়। যন্ত্রের মাধ্যমে সেই কাজটি করলে ক্ষতির পরিমাণ ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব। পাশাপাশি যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে তরুণ কর্মসংস্থানকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘শস্যের নিবিড়তা বাড়ানোর মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি ও ইন্টারক্রপিং গ্যাপ (আন্তঃফসল বিরতি) কমিয়ে এনে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। কৃষকের উৎপাদন খরচের বহুমুখী মাধ্যম প্রয়োগ করে মুনাফা বৃদ্ধি করতে হলে যান্ত্রিকীকরণের বিকল্প নেই।’
আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইএফপিআরআই) গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের অধিকাংশ কৃষক প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র শ্রেণির। জমির পরিমাণ বা আকারের হিসেবে দেশের প্রায় ৮৩ শতাংশ কৃষকই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র। ০.৫ একরের নিচে এমন আকারের জমি আবাদ করে থাকেন ৩৬ শতাংশ কৃষক। তাদের বলা হয় প্রান্তিক কৃষক। আর ০.৫ থেকে দেড় একরের কম জমি আবাদ করেন ৪৭ শতাংশ, সংজ্ঞানুযায়ী তারা ক্ষুদ্র কৃষক। ফলে দেশের সিংহভাগ কৃষকই ক্ষুদ্র ও ছোট জমিতে আবাদ করেন। এসব জমিতে আবাদের মাধ্যমে কৃষক নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য আর্থিক ও সামাজিক চাহিদা পূরণ করেন। এতে চাহিদা মেটানোর জন্য কাটার শুরুতেই ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন কৃষক। এটির সুযোগ নিচ্ছেন মিলার ও ফড়িয়ারা।
এ বিষয়ে ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ‘একদিকে কৃষকদের জমির পরিমাণ কম, অন্যদিকে তাদের আর্থিক সঙ্গতিও সামান্য। এই দুটি কারণে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কৃষক ঝুঁকিতে থাকেন। কৃষকদের এই দুর্বলতার কারণে মিলার ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তুলনামূলক কম মূল্যে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার সুযোগ পায়। এরাই সিন্ডিকেট করে পরবর্তীতে ধান ও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। দেশে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সবার আগে কৃষকদের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার প্রতি বছর যে ধান কেনে, তা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিনতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনা সবসময় যেন কৃষকের নিয়ন্ত্রণে থাকে, সেজন্য তাদের আর্থিক অসঙ্গতি দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।’