অটোইমিউন ডিজিজ কী?

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:৩০ এএম

অটোইমিউন ডিজিজ কী? এই রোগে আক্রান্ত হলে কি সারাজীবনই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে? চিকিৎসকদের মতে, ব্যক্তিবিশেষে এ রোগের ধরন যেমন আলাদা, তেমনই তার চিকিৎসা পদ্ধতি। তবে আগে জানতে হবে, এই রোগ কেন হয়।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেডিসিনের ডা. অরুণাংশু তালুকদার কথায়, আমাদের শরীর জন্মের পর থেকেই কোনটা সেলফ আর কোনটা নন-সেলফ সেই পার্থক্য বুঝতে শুরু করে। যখন শরীরে ফরেন প্রোটিন প্রবেশ করে, তখন শরীর সচেতন হয়ে যায়। ফলে সে অ্যান্টিবডি প্রস্তুত করে ও সেই অ্যান্টিজেনকে আক্রমণ করে শরীরের ইমিউনিটি বাড়ায়। কিন্তু যখন শরীর কোনটা সেলফ ও কোনটা নন-সেরফ বুঝতে পারে না, তখন নিজের কোষকেই সে ফরেন প্রোটিন ভেবে আক্রমণ করে। একেই বলে অটোইমিউন ডিজিজ।

এক্ষেত্রে রোগীর ইমিউন সিস্টেম রোগীর শরীরকেই আক্রমণ করে। রিউমাটোলজিস্ট ডা. অভ্রজিৎ রায় বললেন, জন্মের তিন বছর অবধি শিশুর ইমিউনিটিতে নিজের কোষের প্রতি একটা টলারেন্স তৈরি হয়। ফলে সে নিজের কোষের ক্ষতি করে না। কিন্তু তিন বছরের মধ্যে যদি তা ডেভলপ না করে, বড় হলে টি-সেল তখন বি-সেলকে উদ্দীপিত করে অটো-অ্যান্টিবডি তৈরি করার জন্য। এই অটো-অ্যান্টিবডি মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত শরীরের যেকোনো অংশে আক্রমণ করতে পারে। 

তিনি বলেন, শরীর নিজের কোষের বিরুদ্ধে একটা প্রোটিন তৈরি করে নিজেরই ক্ষতি করা শুরু করে। লুপাস রোগে এ রকম হতে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে শরীরের কোন অংশে তা আঘাত করছে, সেই অনুযায়ী রোগের ধরন ও চিকিৎসা পদ্ধতি পাল্টাতে থাকে। যেমন কিডনিতে আঘাত করলে যে চিকিৎসা হবে, মাথায় আঘাত করলে তা হবে না। 

অটোইমিউন ডিজিজ যেমন অনেক ধরনের হয়, তেমনই শরীরের কোন অংশে হচ্ছে তার উপরেও নির্ভর করে রোগের গুরুত্ব ও চিকিৎসা।

কিছু ধরনের ডায়াবিটিস, কিছু থাইরয়েড, কয়েক ধরনের শ্বেতি যেমন এই রোগের মধ্যে পড়ে, তেমনই অটোইমিউন আর্থ্রাইটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, লুপাসও (সিস্টেমিক লুপাস ইরিথেম্যাটোসাস)অটোইমিউন ডিজিজ। ফুসফুস থেকে শুরু করে পেশিকেও আক্রমণ করতে পারে এই রোগ। মধ্যবয়স্ক নারীদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে এই রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। আবার রোগীর শরীরের উপরে নির্ভর করে রোগের প্রকোপ কতটা হবে। কারও ক্ষেত্রে অটোইমিউন ডিজিজ খুব একটা কাবু করতে পারে না, অনেকের আবার সারাজীবনই অসুখ কখনো বাড়ে, কখনো কমে- এভাবে চলতে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে আবার হঠাৎ রোগ অনেকটা বেড়ে যায়। তাই অবশ্যই নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি। কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত কি না, তা বুঝবেন কীভাবে?


ক্লান্তি দেখা দিতে পারে। জ্বর আসে, তা অ্যান্টিবায়োটিকসেও কমে না। আবার অনেকের গাঁটে-গাঁটে ব্যথা হয়, তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে এলে বিভিন্ন পরীক্ষা করে রোগনির্ণয় করা হয়। ব্লাড কালচার, ইউরিন কালচার, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর পরীক্ষা করে কোনো ইনফেকশন পাওয়া না গেলে, তখন বিভিন্ন ধরনের রক্তপরীক্ষা যেমন রিউমাটয়েড ফ্যাক্টর, অ্যান্টি সিসিপি, অ্যান্টি নিউক্লিয়ার ফ্যাক্টর ইত্যাদি করতে দেয়া হয়। 

ইনফেকশন বাদ দেয়ার পরে ইমিউনোলজিক্যাল ডিজ়িজ়ের কথা ভাবা হয়। অনেক সময়ে মুখের লালা শুকিয়ে যায়। ড্রাই আইজের সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

চিকিৎসা হবে কীভাবে

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইমিউনিটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে রোগীদের স্টেরয়েড দেয়া হয়। কারণ স্টেরয়েড হল ইমিউনোসাপ্রেস্যান্ট। স্টেরয়েডের ডোজও দু’ভাগে ভাগ করা হয়, লো-ডোজ (১০ মিলিগ্রাম বা তার কম) ও হাইডোজ (৪০-৬০ মিলিগ্রাম) অথবা ইন্ট্রাভেনাস ডোজ (১ গ্রাম) পর্যন্ত দেয়া হয়। 

গাঁটে-গাঁটে ব্যথা কমাতে, শরীরের ক্লান্তি কমাতে, অটোইমিউন রেসপন্স কমাতে স্টেরয়েড ভাল কাজ দেয়। তবে স্টেরয়েড বাদ দিয়েও এ রোগের চিকিৎসা কিছু ক্ষেত্রে সম্ভব। 

ডা. অভ্রজিৎ রায়ের কথায়, বেশি স্টেরয়েড না দিয়ে অ্যাজাথিয়োপ্রাইন, সাইক্লোস্পোরিন, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন এই ধরনের ওষুধ দেয়া হয় রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও লুপাসে আক্রান্ত রোগীদের। আবার অনেক সময়ে কেমোথেরাপির প্রয়োজন পড়ে। অনেক রোগীর হাতের আঙুলে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়। তখন কেমোথেরাপি যেমন সাইক্লোফসফামাইডও ব্যবহার করা হয়।

কম ডোজের স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা শুরু করে, দরকার মতো ডোজ বাড়িয়ে আবার কমানো হয়। তবে প্রাণসংশয় দেখা দিলে হাইডোজের স্টেরয়েড দেয়া হয়। নেফ্রাইটিস বা ব্রেন অ্যাটাকের মতো মেজর অর্গ্যান আক্রান্ত হলে হাইডোজ দেয়ার কথা ভাবা হয়। পরে সেই ডোজ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হয়।

দীর্ঘদিন স্টেরয়েড কি নিরাপদ?

ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অস্টিয়োপোরোসিস ইত্যাদি অসুখ বাড়তে পারে। মনে রাখবেন, প্রত্যেকের শরীরেই কিন্তু ২৫ মিলিগ্রাম কর্টিজল তৈরি হয় অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে। তাই স্টেরয়েড কিন্তু আমাদের শরীরেরই অংশ। স্টেরয়েড নেয়ার কথা ভেবে আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই। 

তবে জেনারেল মেডিসিনের ডাক্তার সুবীরকুমার মণ্ডল বললেন, এই রোগ নিয়ন্ত্রণে স্টেরয়েডের কার্যকারিতা রয়েছে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে সাবধানতা জরুরি। যেহেতু এটি ইমিউনোসাপ্রেস্যান্ট, তাই বেশি এক্সপোজড হলে ইনফেকশনের আশঙ্কা বেড়ে যায়। ইউটিআই থেকে শুরু করে সব ধরনের ইনফেকশনের ভয় থাকে। তাই বাড়তি সতর্কতা জরুরি। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

অটোইমিউন ডিজিজ কি কমে?

নিয়ম মেনে চললে এই অসুখও নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ জীবনযাপন সম্ভব বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। ডা. অভ্রজিৎ রায় বললেন, অটোইমিউন ডিজিজের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন অসুখ হল ভাসকুলাইটিস বা স্মল ব্লাড ভেসেল ডিজঅর্ডার। যেহেতু শরীরের প্রত্যেক জায়গায় শিরা ও ধমনী রয়েছে, তাই এ রোগ ছড়ায় তাড়াতাড়ি। এই অসুখে মর্টালিটি রেটও হাই, প্রায় ১৫ শতাংশ। কিন্তু এ রোগেও এখন সারভাইভাল রেট বেড়েছে। ১৯৬০ সালে রোগনির্ণয়ের চার বছরের মধ্যে ৫০ শতাংশ রোগী মারা যেতেন। ২০১৮ সালে সেই সারভাইভাল রেট ৮৫ শতাংশ। এখন আরো বেড়েছে। 

এমন রোগীও আছেন, যাদের সন্তান হয়েছে ও সংসারজীবনও করছেন। উদাহরণস্বরূপ- লন্ডনের প্রফেসর ডেভিড আইসেনবার্গের পর্যবেক্ষণের উল্লেখ করতে হয়। তার কাছে চিকিৎসাধীন লুপাস রোগীদের পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে- চিকিৎসা চলাকালীন অনেকেই একটা ভাল ফেজ পায়, যখন তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। তখন খুব একটা ওষুধেরও দরকার পড়ে না। এমনকি এএনএ নেগেটিভ হয়ে যায় সে সময়ে। 

বছর তিনেক পর্যন্ত এ রকম ভাল ফেজ পেয়েছেন, এমন রোগীর উদাহরণও আছে। পরে মানসিক উদ্বেগ বা ভাইরাল ইনফেকশনের জন্য রোগ ফিরে আসতে পারে। কিন্তু চিকিৎসা চালু রাখলে রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

এ রোগে সবচেয়ে বেশি দরকার ধৈর্য। এই অসুখ হলে সারা জীবন চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে চিকিৎসাবিদ্যা এখন এতটাই এগিয়েছে যে, অটোইমিউন ডিজিজ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। চিকিৎসকদের মতে, হাল না ছেড়ে রোগের মোকাবিলা করার মনোবল রাখতে হবে। -আনন্দবাজার পত্রিকা

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh