এখানে পিএইচডি থিসিস পাওয়া যায়!

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:৪৭ এএম

ফটোকপির দোকানে মিলছে গবেষণাপত্র। ছবি: একুশে টেলিভিশন

ফটোকপির দোকানে মিলছে গবেষণাপত্র। ছবি: একুশে টেলিভিশন

‘এখানে পিএইচডি থিসিস পাওয়া যায়’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন নীলক্ষেত মার্কেটের কোনো ফটোকপির দোকানে সরাসরি এ রকম বাক্য লেখা সাইনবোর্ড না থাকলেও, সেখানকার অনেক দোকানে চুরি করা গবেষণাপত্র তথা থিসিস বিক্রি হয়। 

স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী পানির দরে তা কিনে নিজের গবেষণা হিসেবে জমা দেন। এ অভিযোগ বহু পুরনো। 

অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন বিষয়ে এখানে থিসিস পাওয়া যায়, যেখানে লেখকের নাম উল্লেখ থাকে না। ফটোকপি, এমনকি বনিবনা হলে সফট কপিও পাওয়া যায়। হাজারখানেক টাকার মধ্যেই নীলক্ষেতে যে থিসিস পাওয়া যায়, তা নিয়ে মিডিয়ায় সংবাদও বেরিয়েছে।

এই মার্কেট সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও যে এখান থেকে থিসিস কিনে নিয়ে সেখানে কিছু ঘষামাজা করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন বা এখনো দিচ্ছেন, তা মোটেও অসম্ভব নয়। ফলে যে প্রশ্নটি সামনে আসে তাহলো- অন্যের গবেষণা চুরি করে যারা প্রতিষ্ঠানে ও সমাজে নিজেদের গবেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যে শিক্ষক অন্যের গবেষণা চুরি করে নামের আগে ‘ডক্টর’ উপাধি লাগিয়েছেন- সেই শিক্ষকের নৈতিক মানদণ্ড কী ও তিনি ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের কী পড়ান?

গবেষণাপত্রে চৌর্যবৃত্তির (ইংরেজিতে যাকে বলে plagiarism) দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষকের পদাবনতির (ডিমোশন) ইস্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় বইছে। plagiarism-এর শ্রুতিমধুর অর্থ চৌর্যবৃত্তি হলেও, আসলে এটিও চুরি। 

তিনজনকে শাস্তি দেয়া হলেও মূলত টিভি তারকা সামিয়া রহমানই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তার অর্থ এই নয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এ জাতীয় চৌর্যবৃত্তি এবারই প্রথম ঘটল বা সব দায় একা সামিয়া রহমানের। বরং বছরের পর বছর ধরেই গবেষণার নামে এরকম চুরির ঘটনা ঘটছে ও কালেভদ্রে দু-একটি প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে কেন ও কোন ‘রাজনীতির’ কারণে দু-একটি ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে ও বাকিগুলো অধরাই থাকছে, সেটিরও নির্মোহ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সুতরাং, এই ইস্যুতে আলোচনা করতে হলে শুধু এই তিন শিক্ষকের শাস্তির বিষয়টিই নয়, বরং পুরো প্রক্রিয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার নামে আসলে কী হয়- তা নিয়ে পর্যালোচনার অবকাশ রয়েছে।

সম্প্রতি একাডেমিক গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমানকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদাবনতি দেয়া হয়। আগামী দুই বছরের মধ্যে তিনি পদোন্নতির জন্য আবেদন করতে পারবেন না। প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান এখন শিক্ষা ছুটি নিয়ে দেশের বাইরে আছেন। ছুটি শেষে ফেরার পর তিনি পদোন্নতি পেয়ে যেতেন; কিন্তু সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিভাগে যোগ দেয়ার পর তাকে আরো দুই বছর প্রভাষক পদে চাকরি করতে হবে। নিজের পিএইচডি গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুককে পদাবনতি দিয়ে প্রভাষক করা হয়েছে। তার নকল পিএইচডির অনুমোদনও বাতিল করে দিয়েছে সিন্ডিকেট।

সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সামিয়া ও মারজানের যৌথভাবে লেখা ‘আ নিউ ডাইমেনশন অব কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার : আ কেস স্ট্যাডি অব দ্য কালচারাল ইমপেরিয়ালিজম’ শীর্ষক আট পৃষ্ঠার একটি নিবন্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের নিজস্ব জার্নাল সোশ্যাল সায়েন্স রিভিউয়ে প্রকাশিত হয়। তখন অভিযোগ ওঠে, ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ১৯৮২ সালে প্রকাশিত ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ শীর্ষক নিবন্ধ থেকে পাঁচ পৃষ্ঠার মতো হুবহু নকল করেছেন তারা। নিবন্ধে ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন চিন্তক এডওয়ার্ড সাঈদের ‘কালচার অ্যান্ড ইমপেরিয়ালিজম’ গ্রন্থের কয়েক পাতা হুবহু কপি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ তদন্তে কমিটি করা হয়। অপরাধ প্রমাণিত হলে তাদের শাস্তি নির্ধারণের জন্য তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল দায়ীদের ইনক্রিমেন্ট কাটার মতো ‘লঘু শাস্তির’ সুপারিশ করলেও সিন্ডিকেট তা নাকচ করে দিয়ে পদাবনতির সিদ্ধান্ত নেয়। 

এখানে যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো- গবেষণায় তারা চুরি করেছেন নাকি অন্যের বক্তব্য নিজেদের নামে চালিয়ে দিয়েছেন? যদি গবেষণায় ফুকো ও সাঈদের বক্তব্য তারা কোট-আনকোট ব্যবহার করেন, তাহলে সেটিকে সরাসরি চুরি বলা যায় না। তবে তারা ফুকো ও সাঈদের বক্তব্য নিজেদের নামে চালিয়ে দিলে, সেটি অবশ্যই চৌর্যবৃত্তি বা plagiarism.

পুরো গবেষণায় যদি সাঈদ ও ফুকোর বক্তব্য হুবহু তাদের নামেও উদ্ধৃত করা হয়, তারপরও প্রশ্ন থাকে যে, এটিকে মৌলিক গবেষণা বলা যায় কি-না? কারণ একটি গবেষণায় ৪০ থেকে ৬০ ভাগ মৌলিকত্ব না থাকলে সেটি গবেষণাপত্রের মর্যাদা পায় না। কেউ যদি এ রকম গবেষণা করেন, তাহলে তাকে গবেষক না বলে তথ্য সংগ্রাহক বলাই শ্রেয়। 

যদিও মিডিয়ার খবর বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেবেন সামিয়া রহমান। তার দাবি- বিতর্কিত নিবন্ধটি তিনি লেখেননি। তিনি তাতে স্বাক্ষর করেননি ও নিজেও জমা দেননি; কিন্তু তারপরও উপাচার্য ও ডিনের ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে তাকে শাস্তি পেতে হয়েছে। এটিই হওয়া উচিত। যদি সত্যিই সামিয়া রহমান এই ইস্যুতে নির্দোষ হয়ে থাকেন ও যদি তিনি সত্যিই কারও ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হয়ে থাকেন, তাহলে তারও বিচার হওয়া উচিত।

তবে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তিই শুধু নয়, বরং সামিয়া রহমান সম্পর্কে এর আগেও যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো- একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলটাইম শিক্ষক হয়েও কী করে ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেলের সিনিয়র পজিশনে চাকরি করেন? তিনি আসলে কোন পরিচয়টি বহন করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নাকি টেলিভিশন চ্যানেলের কর্তা? একসঙ্গে দুটি চাকরি করা কি নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য? এমন নয় যে, তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন, আরো অনেকে যেটি করেন। বরং সামিয়া রহমান যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সেটিও অনেকে জানেন না। সবাই তাকে টেলিভিশন তারকা হিসেবেই চেনেন। সম্ভবত, তার গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি ও পদাবনতির খবর দেখার পরই বহু মানুষ জেনেছেন যে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। 

সুতরাং, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বিরাট অংশ যে শ্রেণিকক্ষের বাইরে টেলিভিশন ও এনজিওসহ বিভিন্ন জায়গায় অধিকতর ব্যস্ত থাকেন, সেটি প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে কি-না বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-কানুন এগুলো সমর্থন করে কি-না? 

কারণ শিক্ষকের মূল কাজ পড়ানো। সেজন্য প্রয়োজন পড়ালেখা ও গবেষণা; কিন্তু শিক্ষক যদি নিজের শ্রেণিকক্ষের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠান, টেলিভিশন, এনজিওসহ নানা জায়গায় পার্টটাইম বা প্রায় ফুলটাইম চাকরি করে আরো বেশি পয়সা কামানোর সুযোগ পান, তাহলে তিনি গবেষণার পেছনে খামোখা সময় দেবেন কেন? 

যদি পদোন্নতির জন্য তাকে গবেষণা করতেও হয়, তাহলে সেই গবেষণায় যে চুরি (ভদ্র ভাষায় চৌর্যবৃত্তি) থাকবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। আবার গবেষণার উদ্দেশ্য যদি হয় পদোন্নতি, দলবাজি বা অন্য কোনো স্বার্থ হাসিল, সেখানেও চুরির শঙ্কা প্রবল।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh