সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা তিতুমীর

গাজী তানজিয়া

প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:৫৫ এএম

গাজী তানজিয়া

গাজী তানজিয়া

ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী সৈয়দ নিসার আলী ‘তিতুমীর’ নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। কৃষক বিদ্রোহের নেতা হিসেবেও তার নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।

১৭৫৭ সালে সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর ইংরেজ শাসনের পত্তন ঘটে। তার কিছুকাল পর ১৭৯৩ সালে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রবর্তনের ফলে বাংলায় যে জমিদার শ্রেণির সৃষ্টি হয় তারা ও তাদের সন্তান-সন্ততিরাই সরকারের আনুকূল্য পেয়ে সম্পদের মালিক ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে থাকে। 

একটি শক্তিশালী ধনিক-বণিক শ্রেণিও এই সময়ে গড়ে ওঠে। যারা সরকারের সহযোগিতায় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে দেশের ব্যবসা-বণিজ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতি। পক্ষান্তরে, কৃষি নির্ভর বাংলার সাধারণ মানুষ যাদের অধিকাংশ কৃষক, জেলে, তাঁতী ও ক্ষেত মজুর অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। সুবিধাভোগী অভিজাত শ্রেণি, যাদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষই ছিল, তারা ছিল নিরাপদ অবস্থানে। 

পলাশির যুদ্ধের পরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমান ফকির সন্যাসীরা সশস্ত্র সংগ্রাম সংগঠিত করেন, যা ‘ফকির বিদ্রোহ’ ও ‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত। ১৭৬০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলে এই আন্দোলন পরিচালিত হয় মজনু শাহ্, ভবানী পাঠক, মুসা শাহ্, মাদার বকস প্রমুখের নেতৃত্বে। মুখোমুখি সশস্ত্র যুদ্ধে ১৭৮৭ সালে মজনু শাহ্ নিহত হন। মজনু শাহ ফকির বিদ্রোহের ধারাবাহিকতায়ই ১৮৩২ অব্দে শেরপুরে পাগলপন্থীদের বিদ্রোহ শুরু হয়। শুধু ইংরেজ নয় তাদের দোসর এদেশীয় জমিদার, নায়েব, গোমস্তাদের বিরুদ্ধেও ছিল সেসব আন্দোলন। 

বলাকী শাহ নামক একজন ধর্মীয় নেতার নেতৃত্বে ১৭৯২-এ বাকেরগঞ্জ জেলার প্রজাগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মির্জা আগা মোহম্মদ রেজা বেগ ইংরেজ বিরোধী দুর্জয় আন্দোলন গড়ে তোলেন ও ঘোষণা করেন স্বাধীনতা। এরপর আবির্ভাব ঘটে সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীরের (১৭৮২-১৮৩১)।

তিতুমীর ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি এক সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান কৃষকের ঘরেই তার জন্ম। তিতুমীর ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের সমসাময়িক। তিনি ধর্ম সংস্কার আন্দোলন শুধু নয় কোম্পানির কর্মচারী, ইংরেজ নীলকর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে এক দুর্বার সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলেন। তিনি শুরুতে ধর্ম সংস্কারে ব্রতী হন। ওহাবী আন্দোলন গড়ে তোলেন চব্বিশ পরগণা, নদীয়া, যশোর ও ফরিদপুর প্রভৃতি এলাকায়। তারপর তিনি দরিদ্র কৃষক, তাঁতী প্রভৃতি শোষিত শ্রেণির মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করতে থাকেন। বিভিন্ন এলাকায় তিনি তাদের নিয়ে ইংরেজ নীলকর ও বাঙালি জমিদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হন। 

দরিদ্র মুসলিম কৃষক সমাজে তিতুমীরের প্রভাব ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ১৮৩১ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত তিতুমীর জমিদারের কাছে হয়ে উঠেছিলেন প্রায় অপ্রতিরোধ্য। ভূষাণার জমিদার মনোহর রায়ও তিতুমীরের দলভুক্ত হয়ে শক্তিসামর্থ ও অর্থসাহায্য দেন। ঊনবিংশ শতকের প্রথম থেকেই নীলচাষীদের উপর ইংরেজদের প্রচণ্ড অত্যাচার শুরু হয়েছিল। ভালো আবাদী জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য করা, জমি মাপজোকের সময় কারচুপি করা, কুঠিতে নীল জমা নেবার সময় ওজনে ঠকানো, নানাবিধ নির্যাতন ও গালিগালাজ চলতে থাকে প্রতিদিন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম আইনে দাদন নিয়ে নীলচাষ না করা আইনবিরুদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় অত্যাচার ক্রমে চরমে উঠে। এসব কথা ও বহুদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ কৃষকরা ভুলতে পারেনি। তিতুমীরের অনুগামীরা সাহেবদের দেয়া দাদনের কাগজপত্র নষ্ট করে কৃষকদের বাঁচাবার জন্য একের পর এক নীলকুঠি আক্রমণ করতে থাকে। বারঘরিয়ার অভিযান তাদের সফল হয়, হুগলির নীলকুঠির তারা তছনছ করে দেয়। বারঘরিয়া ও হুগলির নীলকুঠির মালিক ছিলেন উইলিয়াম স্টর্ম। তার বারঘরিয়া কুঠির ম্যানেজার মিস্টার পিঁরো ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর তিতুমীরের শক্তিবৃদ্ধি ও নীলকুঠির উপর আক্রমণের ঘটনায় শঙ্কিত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে সংবাদ পাঠান। বারাসতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার আলেকজান্ডার ১১ নভেম্বরে পত্র পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি তৎক্ষণাৎ বিভাগীয় কমিশনার মি. বারওয়েলকে বিষয়টি জানালেন। কমিশনার সাহেবও সরেজমিন-তদন্তে পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট দেন। ১৪ নভেম্বর আলেকজান্ডার সাহেব সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী সিপাহিসহ সদলবলে নারকেলবাড়িয়ার মাঠে উপস্থিত হলেন। তিতুমীরকে ভয় দেখানোর জন্য বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করলেন এই ইংরেজ পুরুষ। যুদ্ধ ঘোষণায় সাড়া দিয়ে তিতুমীরের বিদ্রোহী বাহিনী সেই গুলির আওয়াজ গ্রাহ্য না করে সিপাহিদের আক্রমণ করল। সেই যুদ্ধে বসিরহাটের দারোগা, জমাদারসহ বহু সিপাহি বন্দি হলো। আলেকজান্ডার সাহের ঘোড়ায় চেপে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। ১৪ নভেম্বর মি. স্মিথ তিতুমীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অভিযান করেন।

ইতিমধ্যে তিতুমীর নির্মাণ করেছেন তার ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা। ১৮৩১ সালের ১৫ নভেম্বর বিদ্রোহীরা বারঘরিয়া নীলকুঠি আক্রমণ করেন। তারা পিরোঁ সাহেবকে না-পেয়ে তার কুঠি ও বাংলো ধ্বংস করে দেয়। বইপত্র যা পায় সব ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে। ১৬ নভেম্বর স্মিথ সাহেব বারঘরিয়া পৌঁছে শুধু ধ্বংসস্তূপই দেখতে পান। স্টর্ম সাহেবের হুগলি কুঠির ম্যানেজার ছিলেন মি. হেনরি ব্লন্ড। বিদ্রোহীরা হুগলির নীলকুঠি আক্রমণ করে এবং ব্লন্ড সাহেব ও তার স্ত্রী শিশুপুত্রকে ধরে নিয়ে বাঁশের কেল্লায় তিতুমীরের সামনে হাজির করেন। সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও তিতুমীরের পক্ষে নীল চাষ করার প্রতিশ্রতিতে ব্লন্ড সাহেব সপরিবারে মুক্তি পান। অবশ্য বাঁশের কেল্লা ইংরেজদের দখলে এলে তিনি তিতুমীরের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক হলফনামা দিয়েছিলেন।

ইতিমধ্যে তিতুমীর স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। তিনি ১৮ নভেম্বর ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে গোবরডাঙ্গা ও অন্যান্য জমিদারের কাছে তার নামে রাজস্ব পাঠাবার পরওয়ানা পাঠিয়ে দেন। তিনি আরো ঘোষণা করেন যে, কোম্পানির রাজত্বের অবসান হয়েছে। এবার ব্রিটিশ সরকার চরম আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিলো। বাঁশের কেল্লায় শেষ আক্রমণ হয় ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর। তিতুমীরকে দমন করার জন্য সরকার থেকে কামান, গুলিগোলাসহ সৈন্যদল প্রেরিত হলো। সেনাপতি ছিলেন মি. সাজারল্যান্ড। তার সাথে ছিলেন নদিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট মি. স্মিথ, কয়েকটি নীলকুঠির মালিক স্টর্ম সাহেব, বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মি. আলেকজান্ডার প্রমুখ।

দেড়ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলে। এরপরে নারকেলবাড়িয়ার মাঠে তিতুমীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। তিতুমীর কামানের গোলার আঘাতে নিহত হন। কেউ কেউ বলেন যে, তিতুমীরের ছিন্নভিন্ন দেহ হুগলি গ্রামের লোকেরা কবরস্থ করে। আবার কারো কারো মত এই যে, যুদ্ধের শেষে আলেকজান্ডার সাহেব তার মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন, যাতে করে তার অনুগামীরা তিতুমীরকে শহীদের মর্যাদা দিতে না পারে ও স্মারক স্তম্ভ নির্মাণ করতে না পারে। এই নির্দেশের পেছনে ছিল বিদ্রোহের আগুন পুনরায় প্রজ্বলিত না-হওয়া।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নিপীড়িত জনগোষ্ঠীই বারবার বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন। অষ্টাদশ শতকে বঙ্গে যে সব আন্দোলন সংগঠিত হয়, তার বেশিরভাগই নেতৃত্ব দিয়েছেন স্থানীয় কৃষক সমাজ, জাতীয় পর্যায়ে কোনো বিখ্যাত নেতারা নন। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের গোড়ার দিক থেকে তিতুমীরসহ উপরোক্ত নেতাদের অবদান চির স্মরণীয়।

-লেখক: কথাসাহিত্যিক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh