মালিকদের নতুন আবদার ব্যাংকে সংকটের শঙ্কা

এম এইচ রশিদ

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:৫৮ এএম | আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:০২ এএম

গত বছর ব্যাংকগুলো নগদ আদায় করতে পারেনি; কিন্তু নীতি ছাড়ের কারণে কাগজে-কলমে আয় দেখিয়ে মুনাফা দেখিয়েছে। ব্যাংকগুলো যে মুনাফা দেখিয়েছে, তার সিংহভাগই কাল্পনিক। 

এখন আবার সুযোগ দেয়া হলে ব্যাংকগুলো নতুন করে সংকটে পড়বে। এতে আমানতকারীদের অংশ আরো কমে যাবে। আমানতের বিপরীতে সুদহার ইতিমধ্যে কমিয়ে আড়াই থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা হয়েছে। এটি দেশের মূল্যস্ফীতির তুলনায় কম। এখন সুদহার আরও কমানো হলে আমানতকারীদের ব্যাংক বিমুখ হওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে। 

এতে দেশে অবৈধ অর্থের কারবার বেড়ে যেতে পারে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব পরিচালনা পর্ষদের। সেই পর্ষদের প্রধান চেয়ারম্যান। আবার চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্যই ব্যবসায়ী। 

এখন করোনাভাইরাসের ক্ষতি বিবেচনায় ব্যবসায়ী হিসেবে ব্যাংকের কাছ থেকে সুবিধা চাচ্ছেন ওই চেয়ারম্যান-পরিচালকরা। তাদের এই সুবিধা দেয়া হলে ব্যাংকগুলো নতুন সংকটের মধ্যে পড়বে। ব্যাংকগুলোর মূল আয়ের উৎস সুদ আয়, সেটি বন্ধ হয়ে যাবে। আর সাধারণ আমানতকারী ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রাপ্য মুনাফা থেকে বঞ্চিত হবেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুটিকয়েক মালিকদের সুবিধা দিতে ব্যাংকের ক্ষতি করার সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। 

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের কথা চিন্তা করে ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থেকে রেহাই দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেও গ্রাহককে খেলাপি না করার নির্দেশ দেয়া হয়। এতে ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করা বন্ধ করে দেন। করোনাভাইরাসের প্রকোপ না কমায় এই সুযোগ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সেই সুযোগ আরেক দফায় বাড়িয়ে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। এতে গত এক বছরে কোনো ঋণ ফেরত না দিয়েও কোনো ব্যবসায়ী খেলাপি হননি। 

গত ৩১ জানুয়ারি এক সার্কুলারের মাধ্যমে জানানো হয়, করোনাভাইরাসের ক্ষতি বিবেচনায় ঋণগ্রহীতাদের ওপর প্রভাব সহনীয় রাখতে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ খেলাপি করার ক্ষেত্রে ডেফারেল সুবিধা দেয়া হয়। ১ জানুয়ারি থেকে এই সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়। তবে ব্যাংক চাইলে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে অবশিষ্ট মেয়াদের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সুবিধা বাড়ানো যাবে। এর আওতায় মেয়াদি ঋণের গ্রাহকরা সর্বোচ্চ দুই বছর ঋণের মেয়াদ বাড়াতে পারবেন। 

এখন আংশিক সুবিধার পরিবর্তে সম্পূর্ণ সুবিধা চাইছেন ব্যাংকের মালিক ও অন্যান্য ব্যবসায়ীরা। পূর্ণাঙ্গ সুবিধা দাবি করে সর্বপ্রথম পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, করোনাভাইরাসে পোশাক শিল্প মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। ক্রেতারা নতুন করে ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন না। আগের রফতানি বিল পরিশোধ করছেন না। এক হাজার ১৫০টি কারখানার প্রায় ৬১৮ কোটি ডলারের রফতানি আদেশ বাতিল হয়েছে। এতে অনেক কারখানা দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকের টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়। তাই সব সুবিধা আগামী দুই বছরের জন্য বাড়াতে হবে। পাশাপাশি যেসব প্রণোদনা সরকার দিয়েছে সমপরিমাণ প্রণোদনা ফের দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিজিএমইএ। 

পোশাক মালিকদের মতো ব্যাংকের চেয়ারম্যানরাও একই দাবি জানিয়েছেন। ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) দাবি, দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ এখনো করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পোশাক কারখানাগুলোর ক্রয়াদেশ ৩০-৪০ শতাংশ কমেছে। এ জন্য মেয়াদি ঋণের মেয়াদ আরো তিন বছর বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি চলতি মূলধন ও তলবি ঋণের পরিশোধযোগ্য অংশকে মেয়াদি ঋণ হিসেবে পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি। এছাড়া বিএবি কোনো ডাউন পেমেন্ট বা এককালীন জমা ছাড়াই কমপক্ষে তিন বছরে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছে।

বিএবি চেয়ারম্যান ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘ঋণের ৬০ শতাংশের বেশি চলতি মূলধন ঋণ। এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া এখনো করোনা শেষ হয়নি। বৈশ্বিক চাহিদাও আগের অবস্থায় ফেরেনি। তাই চলতি মূলধন ঋণকে মেয়াদি ঋণে পুনর্গঠনের দাবি জানানো হয়েছে। ঋণের মেয়াদ আরো তিন বছর বাড়ানোর জন্য বলা হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরাও ব্যবসায়ী। আমরা জানি, পুরো ঋণ শোধের মতো অবস্থা এখনো আসেনি। এছাড়া পোশাক মালিকরাও এ দাবি তুলেছেন। ঋণ শোধ না হলে ব্যাংকগুলো বিপদে পড়বে। এর চাপ পুরো অর্থনীতিতে পড়বে।’

বিএবির চিঠিতে বলা হয়, বর্তমানে অধিকাংশ ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ৫০ শতাংশ বা কোনোটি তারও কম উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারছে। করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবে ভোগ্যপণ্যের স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মেয়াদি ঋণের অবশিষ্ট মেয়াদের ৫০ শতাংশ বা দুই বছর অতিরিক্ত সময় বাড়ানোর সুযোগ দিয়েছে। এতে যেসব ঋণের মেয়াদের পরিমাণ বেশি, তারা কিছুটা সুবিধা পাবে; কিন্তু যাদের অবশিষ্ট মেয়াদ খুবই কম, তাদের কম সময়ে বড় অঙ্কের ঋণ পরিশোধ করতে হবে, যা খুবই দুষ্কর হবে। এতে ঋণের বড় অংশ অনিচ্ছাকৃত খেলাপিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নগদ টাকা প্রবাহ বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে কমপক্ষে আরো তিন বছর বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

বিএবি বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি মূলধন ও তলবি ঋণ সম্পর্কে কিছুই বলেনি, যা এক বছরের মধ্যে পরিশোধযোগ্য ঋণ। এতে মোট ঋণের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ নির্দেশনার বাইরে রয়ে গেছে। তাই ২০২০ সালের সব কিস্তি ও সুদ এখনই শোধ না হলে চলতি বছরের জানুয়ারিতেই এসব ঋণ খেলাপি হয়ে যেতে পারে। এতে ব্যবসায়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে। সে জন্য চলতি মূলধন ও তলবি ঋণের পরিশোধযোগ্য অংশ কোনো জমা ছাড়াই মেয়াদি ঋণ হিসেবে তিন বছরে পরিশোধের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়েছে বিএবি।

পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক জানান, করোনাভাইরাসের কারণে অনেক ক্রেতা দেউলিয়া হয়ে পড়েছেন। এতে তাদের মূল্য পরিশোধ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া নতুন রফতানি আদেশও আসছে না। এতে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। তাই ঋণ শোধে বাড়তি সময় দেওয়ার উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে গত বছর শোধ করা হয়েছিল দুই লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বিশেষ সুবিধা পেয়েও তা কাজে লাগাননি অনেক ব্যবসায়ী। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমে হয়েছে ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮.৮৮ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর ব্যাংকগুলো নগদ আদায় করতে পারেনি; কিন্তু নীতি ছাড়ের কারণে কাগজে-কলমে আয় দেখিয়ে মুনাফা দেখিয়েছে। ব্যাংকগুলো যে মুনাফা দেখিয়েছে, তার সিংহভাগই কাল্পনিক। এখন আবার সুযোগ দেয়া হলে ব্যাংকগুলো নতুন করে সংকটে পড়বে। এতে আমানতকারীদের অংশ আরো কমে যাবে। আমানতের বিপরীতে সুদহার ইতিমধ্যে কমিয়ে আড়াই থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা হয়েছে। এটি দেশের মূল্যস্ফীতির তুলনায় কম। এখন সুদহার আরো কমানো হলে আমানতকারীদের ব্যাংক বিমুখ হওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে। এতে দেশে অবৈধ অর্থের কারবার বেড়ে যেতে পারে। 

দেশের ব্যাংকগুলোর মোট সম্পদের মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশের মালিক উদ্যোক্তারা। অবশিষ্ট ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ সম্পদের মালিক দেশের সাধারণ জনগণ। ব্যাংকের অর্থ মূলত জনগণের জমানো আমানত। অথচ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পরিচালনার দায়িত্বে থেকে জনগণের পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh