মদন-সমাচার

সুমন সাজ্জাদ

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৩:৩৮ পিএম

‘ব্যাটা মদন!’- এ রকম কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি; বলেও থাকি বটে। মদনটাক নামে একটা পাখিও আছে। প্রেমরাজ কৃষ্ণের এক নাম মদনমোহন। আর মদনমোহন তর্কালংকারের নাম কে না জানে! কথা হলো, মদনের মানে কী? মদনই-বা কে? মদনের এখনকার মানে হাবাগোবা আর বোকাসোকা ধরনের হাস্যকর লোক। আদতে মদন কি তা-ই ছিলেন? মোটেও না। ইতিহাসের মূল মদন বরং মহানায়ক! আহা তিনি যদি জানতেন আজকের বঙ্গদেশে তার এমন অর্থান্তর ঘটেছে! নিশ্চিত বুক চাপড়াতেন। আসল মদন হলেন ভারতীয় পুরাণের প্রেমের দেবতা, কামদেব। গ্রিক পুরাণে যেমন এরোস, রোমান পুরাণে যেমন কিউপিড।

মদনের পাঁচটি শর বা তীর; যার দিকেই ছুড়ে মারেন, সে-ই তখন প্রেমে কুপোকাৎ। মদনের আরেক নামও তাই পঞ্চশর। প্রেমের তীর মেরে শিবের ধ্যান ভাঙতে গেলে শিব তাকে তৃতীয় নয়নের আগুনে পুড়িয়ে মারেন। মদনের কাহিনি পাওয়া যাচ্ছে কালিকাপুরাণে। ঘটনা গুরুতর। আরাধনার মাধ্যমে ব্রহ্মা সুর, অসুর, মানুষ প্রভৃতি সৃষ্টি করলেন। তার মন থেকে জন্ম নিল অনিন্দ্য সুন্দরী এক তরুণী। নাম তার সন্ধ্যা। ‘এই সন্ধ্যা স্বভাব সুন্দর সুনীল কুন্তলভারে বর্ষাকালীন ময়ূরীর ন্যায় বিরাজ করিতে লাগিলেন।’- সন্ধ্যার রূপদর্শনে মুনির মনও দুলে ওঠে। অতঃপর ব্রহ্মার মন থেকে জন্ম নিল মনোহর এক চঞ্চল পুরুষ। তার বক্ষস্থল সমুন্নত, নাক সুচারু; ঊরু কোমর ও জঙ্ঘা সুবৃত্ত; কুঞ্চিত নীলাভ চুল; মুখম-ল চাঁদের ন্যায়। সুবিশাল বক্ষস্থল লোমে আবৃত। মত্ত হাতির মতো তার গমন, প্রফুল্ল পদ্মের মতো চোখ, বকুল ফুলের মতো শরীরের ঘ্রাণ। পুষ্পময় ধনুক ও ফুলের তীর তার হাতে। ব্রহ্মাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে ব্রাহ্মণ। আমি কোন্ কার্য্য করিব?’ ব্রহ্মা বললেন, ‘তুমি তোমার এই মনোহর মূর্তি ও পুষ্পময় পঞ্চশরে স্ত্রী-পুরুষদিগকে মোহিত করত চিরস্থায়িনী সৃষ্টির প্রবর্ত্তক হও।’

ব্রহ্মা বললেন, ‘সকল প্রাণীর মনই, তোমার পুষ্পবাণের লক্ষ্য হইবে। তুমি উহাদিগের সতত মত্ততা ও আনন্দ সম্পাদন করিবে।’ দেব, গন্ধর্ব, কিন্নর, মানুষ, রাক্ষস, যক্ষ, পিশাচ, দানব সকলেই তার শরাঘাতে ঘায়েল হবে। শুধু তা-ই বললেন না, ব্রহ্মা আরও বললেন, ‘হে পুরুষপ্রবর! অন্য প্রাণীর কথা দূরে থাক, আমি বিষ্ণু এবং মহেশ্বর আমরাও তোমার বশবর্ত্তী হইব।’ জগতের অসাধারণ কামরূপী বলে তার নাম হলো কাম। লোককে মত্ত করে বলে তার নাম হলো মদন। মহাদেবে দর্প নাশে সক্ষম বলে নাম তার দর্পক ও কন্দর্প। কামদেবের ধনুক দেখতে কেমন? রমণী ভ্রু-সদৃশ বাঁকা, উন্মাদনা নামক কুসুমনির্মিত।

তীরগুলোর নাম : হর্ষণ, রোচন, মোহন, শোষণ ও মারণ। ব্রহ্মার নাম স্বাক্ষর করা একটা ব্ল্যাংক চেক পেলে যে-কেউই তার সদ্ব্যবহার করবে এটাই স্বাভাবিক। অতএব, পুরুষপ্রবর সেই সুযোগ ছাড়বেন কেন। পুরুষপ্রবর পুষ্পশরের প্রয়োগ ঘটালেন স্বয়ং ব্রহ্মার ওপরই। আর তাই ব্রহ্মা এবং তার সকল সৃষ্টি মদনের পুষ্পশরে মোহিত হয়ে পড়লেন। মিষ্টি গন্ধে আলোড়িত হয়ে তারা বারবার সন্ধ্যা নামের সেই রূপবতীকে দেখতে লাগলেন। ব্রহ্মাও মতিভ্রষ্ট হলেন। মদন দেখল কুসুমশরে দারুণ কাজ হচ্ছে। তখনই আকাশপথে যেতে যেতে মহাদেব উপহাস করে বললেন, ‘অহে ব্রহ্মা! নিজের তনয়াকে দেখিয়া তোমার কি না কামভাব উপস্থিত হইল!’

লজ্জায় ক্ষোভে ব্রহ্মা শাপ দিলেন মদনকে। অতি দুষ্কর্ম করার কারণে মহাদেবের নয়ন-আগুনে ভস্মীভূত হবে মদন। তবে ব্রহ্মার সঙ্গে এক ধরনের মীমাংসা হলো। সঙ্গিণী হিসেবে মদন পেল রতিকে। তাকেও মোহাবিষ্ট করে ফেলল মুহূর্তে। রতির মানে রমণ, আসক্তি, অনুরাগ। উৎসে আছে সংস্কৃত রম্। মদন জানাল, রতিকে সঙ্গী করে মহাদেবের নিষ্কাম তপস্যায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারবে সে। তখন ব্রহ্মার দীর্ঘশ্বাস থেকে বসন্তের জন্ম হল। ফুল দল নিয়ে উৎপন্ন হল সে। রক্তকমলের মতো তার রঙ, সন্ধ্যার পূর্ণ চাঁদের মতো তার মুখ- সুন্দর নাক, নীলাভ চুল। বসন্তকে দেখে মধুর স্বরে কোকিলেরা গান গেয়ে উঠল, বিকশিত হল কমল।

বসন্তেই আছে শৃঙ্গার; মলয় পবন তার উপকরণ। শৃঙ্গ থেকে শৃঙ্গার। একেই বলে আদিরস; নারীপুরুষের সঙ্গম, মৈথুন। বসতির অন্ত বলে নাম তার বসন্ত- প্রবাসীকে প্রবাসে থাকতে দেয় না বসন্ত। মহাদেবের মধ্যে কামভাব জাগ্রত করতে মদনের সঙ্গী হলো পঞ্চশর, রতি ও বসন্ত। অবশ্য সকলকে বশে আনতে বসন্তের জুড়ি নেই। শিবকে বশে আনার মদনযাত্রার বর্ণনা পড়া যাক ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্য থেকে:
ইন্দ্রের আজ্ঞায়        রতিপতি ধায়
    পুষ্পশরাসন হাতে।
সমুখে সামন্ত        ধাইল বসন্ত
    কোকিল ভ্রমর সাতে ॥
মলয় পবন         বহে ঘন ঘন
    শীতল সুগন্ধ মন্দ।
মদনবাণে বিদ্ধ হলে মহাদেব। ধ্যানভঙ্গের ক্রোধে কপালের আগুন দিয়ে তাড়া করলেন মদনকে; পুড়ে ভস্ম হল মদন; কিন্তু ততক্ষণে মহাদেবের কামভাব সমাগত। মত্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লেন নারীর খোঁজে। মদন, রতি, বসন্ত, প্রেম, কাম ও প্রকৃতির এই বর্ণনা আমরা পাব ভারতীয় অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে।

রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম ও কাম-এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় মদনের তীক্ষ্ণ বাণ আরও বেশি মনোহর হয়েছে বলে মনে হয়। বৃন্দাবনের পথে হারিয়ে যাওয়া বড়ায়ি যখন রাধাকে খুঁজছিল, তখন কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা। কৃষ্ণ জানতে চাইল রাধা দেখতে কেমন। অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিলেন বড়ায়ি। আর তা শুনেই মোহিত হল কৃষ্ণ। বলল:
তোর মুখে রাধিকার রূপকথা সুনী।
ধরিবাক না পারো পরাণী ॥ বড়ায়ি ল ॥
দারুণ কুসুমশর সুদৃঢ় সন্ধানে।
আতিশয় মোর মন হানে ॥ বড়ায়ি ল ॥
...
কুসুমিত তরুগণ বসন্ত সমএ।
তাত মধূকর মধূ পীএ ॥
সুসর পঞ্চম শর গাএ পিকগণে।
তেকারণে থীর নহে মনে ॥
আতিশয় বাঢ়ে মোর মদনবিকার।
তাত কর মোর উপকার ॥
তোর মুখে রাধিকার রূপের বিবরণ শুনে প্রাণ ধরে রাখতে পারছি না। আমার মনের ভেতর আঘাত হানল দারুণ কুসুমশর। এদিকে ফুলে ফুলে ছেয়ে উঠেছে তরু। মধুকর পান করছে মধু। পিকেরা সুস্বর পঞ্চম সুর গাইছে। সে কারণে স্থির নেই মন। অতিশয় বেড়েছে মদনবিকার। তাই কর আমার উপকার।

অন্য এক রাতে কৃষ্ণ স্বপ্ন দেখল। রাধা এসে শিয়রে বসেছে। তখন হৃদয়ে তার মদন বিদ্ধ হল। রাধার কাছে এসে বড়ায়ি বলছে, শোন চন্দ্রবলী কৃষ্ণ তোকে সপনে দেখেছে। তোর পদ্মকোরকের মতো দুই স্তনে হাত রেখেছে। দুঃসহ মদনে বিকল হয়ে পড়েছে। বড়ায়ির দুতিয়ালি শুনে ক্ষুব্ধ রাধা বড়ায়িকে বলে, তোর এত দুষ্ট মন, তাহলে কেন আমি তোর সঙ্গে চলব, তুই বরং কৃষ্ণের কাছে চলে যা। প্রত্যাখ্যাত কৃষ্ণের পরিকল্পনা শুনুন : যমুনার তীরে কদমের তলে বসে থাকব। লুটে নিব রাধার সকল পসার। খেয়ে নেব তার দধির ভাঁড়। কেটে নেব সাতসরি হার। ছড়িয়ে দেব তার খির। চিরে দেব কাঁচুলি। হাত দেব তার স্তনে। তোর অনুমতি নিয়ে রাধাকে নিয়ে যাব বৃন্দাবনে। পরে মদনবাণে বিদ্ধ করে মুনির বেশ ধরব। বোঝা যাচ্ছে প্রেম ও কামে বশ করার এক পুরনো হাতিয়ার মদন।

অনেক ঝুটঝামেলা শেষে বদলে গেল রাধাও। কৃষ্ণের বাঁশির শব্দে তার রান্না এলেমেলো হয়ে যায়। আম গাছের ডালে বসা কোকিলের ডাক বিষবাণের মতো আঘাত করে। রাধা বলছে, ‘সরস বসন্ত ঋতু কোকিল রাএ।/আধিক বিরহশিখি হৃদএ জলএ॥’ কিন্তু কৃষ্ণের দেখা নেই। বাঁশির শব্দে এতোই ব্যাকুল যে, রাধা ঘিয়ের ভেতর সুপারি ভাজল, বিনাজলে চাল চড়ালো। কৃষ্ণের আলিঙ্গন পেয়ে অভ্যস্ত রাধা বিদ্ধ হলো বিরহবাণে। রাধা-কৃষ্ণের এই লীলা কাম ও প্রেমের সম্মিলনে জমে উঠেছে বৈষ্ণব কবিতায়। সেখানেও মদন তির-ধনুক নিয়ে হাজির। পুড়ে যাওয়া মদনকে নিয়েই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একি সন্ন্যাসী
বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে!
ব্যাকুলতর বেদনা তার বাতাসে উঠে নিঃশ্বাসি,
অশ্রু তার আকাশে পড়ে গড়ায়ে।

মদন এক যন্ত্রণার নাম; দিল্লির লাড্ডুর মতোই, খেয়েও পস্তায়, না খেয়েও পস্তায়। মদন দিয়ে শব্দ মদনজ্বালা, মদনবাণ। বসন্ত-উৎসবের আরেক নাম মদনোৎসব। কোকিলেরও আছে এক আশ্চর্য নাম : মদনপাঠক; মদন এখানে বসন্তকাল, বসন্তকালে যে পাঠ করে- সে-ই মদনপাঠক। কে পাঠ করে বা রব করে? সরল জবাব- কোকিল। আর তাই কোকিল হয়ে যায় মদনপাঠক! পুং লিঙ্গের নাম মদনাঙ্কুশ ও মদনশলাকা। নারী যোনীর নাম মদনালয়। এই লেখা পড়তে পড়তে যদি কামভাব জাগ্রত হয় তবে বুঝবেন, তার নাম তার মদনাবস্থা। এইবার ভেবে দেখুন মদন না থাকলে কী দশা হতো আমাদের! না প্রেম, না কাম, না বিরহ! সংস্কৃত মদ, মদক, মদন- বেশ নেশা ধরানো ব্যাপার, তাই না? সেদিক থেকে বলা চলে, মাতাল করে এমন বস্তুই মদন। প্রেম তার মধ্যে একটা। অতএব, বলি, মদনকে হেলা করিবেন না, মদন-বিনা জীবন লইয়া কী করিবেন? মদনের জয় হোক। জয় হে মদনবাবা প্রেমনাথ।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh