ভ্যাকসিন নিলেও মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:৫৪ এএম

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

স্বাস্থ্যবিধি মানার বিকল্প নেই- বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ভ্যাকসিন নিলেও মাস্ক পরতে হবে ও ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে যেতে হবে। 

এর একটি কারণ- করোনাভাইরাসের যে ভ্যাকসিনটি বাংলাদেশে দেয়া হচ্ছে, এটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি। এটির অনেক ট্রায়ালে ভিন্ন ভিন্ন ফল পাওয়া গেছে। 

সর্বশেষ এই ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এটির প্রথম ডোজ দেয়ার পর আট থেকে ১২ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হলে ৮৩ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর হয়। অপরদিকে ভ্যাকসিনটি প্রথম ডোজ দেয়ার চার সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হলে ৫৩ শতাংশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৮৩ শতাংশ হলেও, অবশিষ্ট ১৭ শতাংশ অসুরক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার এই ভ্যাকসিনটির এটি একটি সীমাবদ্ধতা। ভ্যাকসিন আসার আগে মানুষ সুরক্ষা পেয়েছে মাস্ক ব্যবহার করে। ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে, জনসমাগম এড়িয়ে, আবার একজন থেকে আরেকজন নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করে সুরক্ষা পেয়েছে এর আগে। এখন ভ্যাকসিন নেয়ার পরও একই রকম সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। 

যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম বলেন, ‘ভ্যাকসিন নেয়ার পরও স্বাস্থ্যবিধি আরো কিছু কারণে মেনে চলতে হবে। ভ্যাকসিন গ্রহণকারী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন এমন কারও সংস্পর্শে আসতে পারেন। ফলে সংক্রমিত ব্যক্তির নিঃশ্বাস থেকে বের হওয়া করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন গ্রহণকারী ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করবে এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু ভ্যাকসিন নেয়ার কারণে ভ্যাকসিন গ্রহণকারী ব্যক্তির দেহে করোনাভাইরাস কোনো ক্ষতি করতে পারবে না (করলেও সামান্য কিছু)। ভ্যাকসিন গ্রহণকারীর দেহে হয়তো করোনাভাইরাস বেশ কিছুদিন থাকতে পারে। ভ্যাকসিন গ্রহণকারী ব্যক্তির দেহে অবস্থান করে ভাইরাসটি হয়তো রূপ পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। তখন পরিবর্তিত রূপের (স্ট্রেইন) করোনাভাইরাস অন্য দেহে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করতে পারে। ফলে যারা ভ্যাকসিনের আওতায় এলো না, তাদের দেহে ওই নতুন রূপের ভাইরাস অবস্থান করে তার ক্ষতি করতে পারে। এই ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে ভ্যাকসিন নেননি এমন ব্যক্তি ও ভ্যাকসিন গ্রহণকারীরও নিয়মিত এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সরকারি ঘোষণা না আসা পর্যন্ত মাস্ক ব্যবহার করে যেতে হবে।’ 

তিনি বলেন, ভ্যাকসিন গ্রহণকারীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে আরো অনেক কারণে। আমরা জানি, ভাইরাস নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত নিজের জিনে পরিবর্তন (নতুন স্ট্রেইনে রূপান্তর করে) এনে থাকে। হয়তো বা এমন কোনো স্ট্রেইন তৈরি হয়ে গেল, যে স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন সুরক্ষা দিতে পারল না। সে স্ট্রেইনগুলো থেকে নিজেকে রক্ষা করতে প্রচলিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এটি করতে হবে নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য সর্বোপরি দেশবাসীর জন্য। দেশব্যাপী হার্ড ইমিউনিটি (৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন দিলে হার্ড ইমিউনিটি হয়ে থাকে) তৈরি না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। হার্ড ইমিউনিটি কখন হবে, তখন সরকারি ঘোষণায় জানা যাবে। জীবন স্বাভাবিক করার জন্য সরকার নিজেই উদ্যোগী হয়ে ঘোষণাটি দেবে। সে পর্যন্ত সবাইকে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করে যেতে হবে।’

ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা

এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের দুই ধরনের নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হয়েছে। একটি যুক্তরাজ্যে (জিবি৫০১১কিউভিবি) অপরটি দক্ষিণ আফ্রিকায় (বি৮৪কে)। প্রশ্ন উঠেছে- নতুন স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনগুলো কতটুকু কার্যকর? 

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, যুক্তরাজ্যে শনাক্ত করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনের পরিবর্তিত রূপটি (মিউটেশন) মানুষের শরীরে সুরক্ষা (অ্যান্টিবডি) থাকা সত্ত্বেও সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এই মিউটেশনটির সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্রেইনের মিল রয়েছে। ইংল্যান্ডের পাবলিক হেলথ (পিএইচই) বিভাগ ব্রিটিশ স্ট্রেইনের নমুনা পরীক্ষা করে এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর অর্থ এমন হতে পারে যে, নতুন রূপটি আগেরটির তুলনায় অনেক বেশি সংক্রামক। ভ্যাকসিন নেয়ার ফলে অ্যান্টিবডি তৈরি হলেও ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে এবং আগে আক্রান্ত হয়েছেন এমন মানুষও পুনরায় সংক্রমিত হতে পারেন। 

ইয়েল স্কুল অব পাবলিক হেলথের এপিডেমিওলজি বিভাগের সহযোগী গবেষণা বিজ্ঞানী জোসেফ ফাওয়ার সিএনএনকে বলেন, ‘এটি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে খুব ভালো সংবাদ না।’ 

এ বিষয়ে ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম জানান, যুক্তরাজ্যের স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে ফাইজারের ভ্যাকসিনের ল্যাবরেটরি পরীক্ষা চালানোর পর দেখা গেছে, ফাইজারের ভ্যাকসিনটি কাজ করছে; কিন্তু আফ্রিকার স্ট্রেইনের ওপর চালানো এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।

কয়েকটি ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই স্ট্রেইনগুলোর বিপরীতে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৬ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। অপরদিকে যুক্তরাজ্যে নোভাভ্যাক্স নামক ভ্যাকসিনটির তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে ৮৯ শতাংশ কার্যকর বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে নোভাভ্যাক্স যুক্তরাজ্যের নতুন স্ট্রেইনের ওপর ৮৬ শতাংশ কার্যকর ও দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্রেইনের ওপর ৬০ শতাংশ কার্যকর বলে বিজ্ঞানীরা জানান। একইভাবে জনসন অ্যান্ড জনসনের তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে সাধারণ করোনাভাইরাসের কার্যকারিতা ৬৬ শতাংশ পাওয়া গেছে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্রেইনের ওপর কার্যকারিতা ৫৭ শতাংশ। দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্রেইনের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৬ থেকে ১০ শতাংশ কমে যাচ্ছে। 

নতুন স্ট্রেইনের ওপর নোভাভ্যাক্স ও জনসন অ্যান্ড জনসনের কার্যকারিতা যে কারণে কমে গেছে ঠিক একই কারণে আশঙ্কা করা হচ্ছে অন্যান্য ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাও কিছুটা কমে যেতে পারে। কারণ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের ওপর ভিত্তি করে এর ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে যেহেতু পরিবর্তন ঘটেছে, তাই দুইটি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার মানে অন্যগুলোর ক্ষেত্রেও কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন করোনাভাইরাস মহামারির সংক্রমণ কমাতে অত্যন্ত কার্যকর ফল দিয়েছে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার বরাত দিয়ে ড. আকরাম বলেন, ‘নতুন স্ট্রেইনের ওপর অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের ট্রায়াল এখনো চলছে। এখনো সেই ফল পাওয়া যায়নি।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh