নাভালনি ইস্যুতে বিভক্ত ইউরোপ

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:৫৯ এএম | আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:০৫ এএম

আলেক্সেই নাভালনি

আলেক্সেই নাভালনি

অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর সেবাস্টিয়ান কুর্জ গত ৬ ফেব্রুয়ারি জার্মান পত্রিকা ওয়েম আম সনটাগে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অনেক দেশের স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই ইইউর উচিত হবে না রাশিয়ায় বিরোধী রাজনীতিবিদ আলেক্সেই নাভালনির কারাদণ্ডের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এই প্রকল্পকে বিপদে ফেলে দেয়া।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘এটি একটি ইউরোপীয় প্রকল্প, যারা এটিকে রুশ স্বার্থের প্রকল্প হিসেবে দেখছেন, তারা ভুল করছেন।’ 

তবে চ্যান্সেলর নাভালনির কারাদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধাচরণ করেন ও বলেন যে, রাশিয়ার উচিত নাভালনিকে মুক্ত করে দেয়া। ৭ ফেব্রুয়ারি আরেক জার্মান পত্রিকা বিল্ড আম সনটাগে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে জার্মান অর্থমন্ত্রী পিটার আল্টমায়ার বলেন যে, নাভালনি ইস্যুকে ‘নর্ড স্ট্রিম-২’ পাইপলাইনের সাথে একত্রে দেখা ঠিক হবে না। 

তিনি আরো বলেন, বহুদিন ধরে চলে আসা ব্যবসা একটি বিষয় আর মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে জার্মানির প্রতিক্রিয়া আরেকটি বিষয়। এর আগে ৫ ফেব্রুয়ারি জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল রাশিয়া থেকে জার্মানিসহ তিন দেশের কূটনীতিবিদ বহিষ্কারের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে নাভালনি ইস্যুর সাথে ‘নর্ড স্ট্রিম-২’ প্রকল্পকে একত্রে না দেখার আহ্বান জানান। 

রাশিয়া অভিযোগ করে যে, সুইডেন, পোল্যান্ড ও জার্মানির সেই কূটনীতিবিদরা নাভালনির পক্ষে রাস্তায় বিক্ষোভ করেছিলেন। নাভালনি ইস্যু ভূরাজনৈতিকভাবে একটি অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে, যা শুধু রাশিয়ার রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। 

ডয়েচে ভেলে জানায়, আলেক্সেই নাভালনি ২০০৮ সালে তার ব্লগের মাধ্যমে রুশ রাজনীতি ও সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করে আলোচনায় আসেন। প্রাক্তন এই আইনজীবী ২০১১ সাল থেকে বেশ ক’বার বিক্ষোভ করার ফলে কারাগারে যান। ২০১৩ সালে তিনি মস্কোর মেয়র পদে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পান। রুশ সরকারি মিডিয়াতে আসতে বাধা দেয়ায় নাভালনি সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করে পুতিনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে থাকেন। 

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে রুশ প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেন। এরপর বিভিন্ন মামলার ফাঁদে পড়ে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে সক্ষম হননি। ২০১৭ সালের এপ্রিলে এক রাসায়নিক হামলায় তার এক চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে রুশ সরকার তাকে চিকিৎসার জন্য স্পেনে যেতে অনুমতি দেয়। তবে ২০১৯ সালে তিনি আরো কয়েকবার গ্রেফতার হন ও এই সময়ের মাঝেই তিনি বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হন। 

তিনি অভিযোগ করেন যে, রুশ সরকারই তাকে আক্রান্ত করেছে। সে বছরের ডিসেম্বরে তার অফিসে পুলিশি হামলার পর ২০২০ সালের মার্চে তার এবং পরিবারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়। আগস্টে তার মুখপাত্র জানান, হঠাৎ মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার কারণে জরুরিভিত্তিতে তাকে জার্মানিতে চিকিৎসার জন্যে পাঠানো হয়েছে। জার্মান সরকার জানায়, নাভালনিকে ‘নোভিচক’ নামের নার্ভ এজেন্টের মাধ্যমে আক্রান্ত করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি দেশে ফেরত এলে আইন ভেঙে জার্মানিতে বেশি সময় থাকার কারণে তাকে দুই বছর ৮ মাস কারাদণ্ড দেয়া হয়। নাভালনির এই কারাদণ্ডাদেশের পরই তার সমর্থকরা রাস্তায় নেমে আসে।

‘নর্ড স্ট্রিম-২’ গ্যাস পাইপলাইনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বার্তা সংস্থা ব্লুমবার্গ জানায়, এই পাইপলাইন বাল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে নির্মিত হচ্ছে, যা রাশিয়া থেকে সরাসরি জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ করবে। রুশ সরকারি কোম্পানি গ্যাজপ্রমের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হওয়া এই পাইপলাইন ইতিমধ্যেই মার্কিন অবরোধের শিকার হয়েছে। মার্কিনিরা জানায়, এই পাইপলাইন নির্মিত হলে ভূরাজনৈতিকভাবে জার্মানি রাশিয়ার ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এর মাধ্যমে জার্মানি ও ন্যাটোর ওপর ক্রেমলিনের প্রভাব অনেক বেড়ে যেতে পারে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই প্রকল্পকে ‘ইউরোপের জন্যে খারাপ চুক্তি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। 

ডয়েচে ভেলে জানায়, বাইডেন প্রশাসন খুব সম্ভবত এই প্রকল্পে কাজ করা কোম্পানিগুলোর ওপর আরও অবরোধ দিতে চলেছে। ৬ ফেব্রুয়ারি রুশ জাহাজ ‘ফরচুনা’ ডেনমার্কের সমুদ্রসীমায় পাইপ বসানোর কাজ চালাচ্ছে বলে এক বিবৃতিতে বলা হয়। এক হাজার ২৩০ কিলোমিটার লম্বা এই ডাবল পাইপলাইন বাস্তবায়ন হলে জার্মানিতে রুশ প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ দ্বিগুণ হবে। এখন মাত্র ১৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানো বাকি রয়েছে। 

জার্মান চ্যান্সেলর মেরকেল ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ গত ৫ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে ইউরোপের বৈঠকের আগে ইউরোপের জ্বালানি নীতির ব্যাপারে একমত হওয়ার দরকারের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। এর আগে গত ১ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের ইউরোপ-বিষয়ক মন্ত্রী ক্লিমেন্ট বিউন ফ্রান্স ইন্টার রেডিওতে বলেন, জার্মানির উচিত রাশিয়ার সঙ্গে ‘নর্ড স্ট্রিম-২’ প্রকল্প বাতিল করে দেয়া। 

ফ্রান্স সবসময়ই বলে আসছে, এই প্রকল্পের ব্যাপারে তাদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপি মনে করিয়ে দিচ্ছে, প্রায় এক বছর মার্কিন অবরোধের কারণে কাজ থেমে থাকার পর গত ডিসেম্বর থেকে পাইপলাইনের কাজ আবারও শুরু হয়। ক্লিমেন্ট বিউন বলেন, নাভালনি ইস্যুতে ইইউ রাশিয়ার ওপর নতুন করে অবরোধ দেওয়ার চিন্তা করছে। এই পাইপলাইন নিয়ে ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও পোল্যান্ড, তিনটি বাল্টিক রাষ্ট্র এবং ইউক্রেন তাদের দুশ্চিন্তার কথা প্রকাশ করেছে। 

ইইউর জন্য নাভালনি ইস্যু এবং ‘নর্ড স্ট্রিম-২’ পাইপলাইন একই সূত্রে গাঁথা। ব্রাসেলস ইতিমধ্যেই বলেছে, ‘নর্ড স্ট্রিম-২’ প্রকল্প ইউরোপের প্রকল্প নয়; এটি জার্মান প্রকল্প। ২১ জানুয়ারি ইইউ পার্লামেন্টের এক ভোটাভুটিতে বিপুল ভোটে ‘নর্ড স্ট্রিম-২’ পাইপলাইনের বিরুদ্ধে রেজলিউশন পাস হয়। কেউ কেউ জানায়, জার্মানি বা ইউরোপের জন্য এই পাইপলাইন অবশ্য প্রয়োজনীয় নয়। তবে এই প্রকল্পে কাজ করা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ইইউর ব্যবস্থা গ্রহণের কার্পণ্য থেকে বোঝা যায় যে, ইইউতে জার্মানির প্রভাব কতটুকু। 

পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ইউরোপের জাতিরাষ্ট্রগুলোর জাতীয় স্বার্থের কাছে ইইউর স্বার্থ যখন গৌণ হয়ে যাচ্ছে, তখন ইইউর স্থায়িত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। ইইউর অভ্যন্তরীণ এই দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে তার অবস্থানকে ধরে রাখতে চাইছে, যা প্রমাণ করে- যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের সুপারপাওয়ার।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh