ফেসবুকের মার্কেটপ্লেসে বিক্রি হচ্ছে আমাজন বনভূমি

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৩:৫৩ পিএম

ব্রাজিলে আমাজনের উষ্ণমণ্ডলীয় বনভূমির কিছু অংশ অবৈধভাবে ফেসবুকের মার্কেটপ্লেসে বিক্রি করা হচ্ছে বলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানতে পেরেছে।

যেসব এলাকা বিক্রি হচ্ছে এগুলো সংরক্ষিত এলাকা- যার মধ্যে আছে জাতীয় বনভূমি ও আদিবাসীদের জন্য নির্ধারিত এলাকা।

ফেসবুকে ‘ক্লাসিফায়েড অ্যাড’ সেবার মাধ্যমে তালিকাভুক্ত আমাজনের এসব প্লটের কোনো কোনোটি এক হাজার ফুটবল মাঠের সমান বড়।

ফেসবুক বলছে, তারা এ ব্যাপারে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করার জন্য প্রস্তুত আছে, কিন্তু এই বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য তারা নিজেরা স্বাধীনভাবে কোনো পদক্ষেপ নেবে না বলে তারা আভাস দিচ্ছে।

তারা বলেছে, আমাদের বাণিজ্য সংক্রান্ত নীতিমালা এমন যে সেখানে ক্রেতা ও বিক্রেতাকে আইন-কানুন মেনে চলতে হয়। 

তবে এজন্য ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর একটির নেতা ফেসবুককে এ ব্যাপারে আরো বেশি কিছু করার আহ্বান জানিয়েছেন। পরিবেশবাদী আন্দোলনকারীরা দাবি করেছেন, দেশটির সরকার এসব বিক্রি বন্ধ করতে ইচ্ছুক নয়।

পরিবেশ বিষয়ক একটি বেসরকারি সংস্থা কানিন্দের প্রধান ইভানেইদ বানদেইরা বলছেন, ভূমি দস্যুরা এখন নিজেদের এতই ক্ষমতাবান মনে করছে যে তারা ফেসবুকে এসব অবৈধ জমি বেচাকেনার চুক্তি করতে লজ্জা বোধ করছে না।

ফেসবুক মার্কেটপ্লেসের সার্চ ব্যবহার করে কেউ যদি পর্তুগীজ ভাষায় বনভূমি বা দেশীয় জঙ্গল এ জাতীয় শব্দ লেখেন ও আমাজনিয়ান রাজ্যগুলোকে লোকেশন হিসেবে বেছে নেন- তাহলে যে কেউ এসব অবৈধভাবে দখল করা প্লটের সন্ধান পেতে পারেন। তালিকাভুক্ত কোনো কোনো বনভূমির উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি ও জিপিএসের অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশও দেয়া আছে।

তবে এগুলো যারা বিক্রি করছেন তারা খোলাখুলি স্বীকার করেছেন যে- তাদের এসব জমির মালিকানার কোনো দলিলপত্র নেই, যা ব্রাজিলীয় আইন অনুযায়ী কোনো জমির মালিকানার প্রমাণ।

ব্রাজিলে এখন যে ক্যাটল র‍্যাঞ্চিং বা বড় আকারে গবাদিপশুর খামার শিল্প গড়ে উঠেছে- তা এই অবৈধ কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করছে বলে মনে করা হয়।

গত ১০ বছরের মধ্যে ব্রাজিলিয়ান আমাজনে এখন বনভূমি ধ্বংসের পরিমাণ সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। বনভূমি বিক্রেতাদের একজন হচ্ছেন ফ্যাব্রিসিও গিমারেস। তিনি বনভূমির একটি অংশ আগুনে পুড়িয়ে খোলা প্রান্তরে পরিণত করেছেন। এটা করা হয়েছে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ও জমিটি এখন চাষাবাদের জন্য তৈরি। গোপন ক্যামেরা দিয়ে তার কর্মকাণ্ড রেকর্ড করা হয়।

তিনি বলেন, এখানে রাষ্ট্রীয় কোনো কর্মকর্তার পরিদর্শনের কোনো ঝুঁকিই নেই। তিনি জায়গাটির প্রাথমিক দাম হেঁকেছিলেন ৩৫ হাজার মার্কিন ডলার। তবে এখন সে দাম তিনগুণ বেড়ে গেছে।

ব্রাজিলের আমাজন বনভূমি সবচেয়ে বেশি উজাড় হচ্ছে যেখানে- সেই রাজ্যটির নাম রন্ডনিয়া। ফেসবুকের বিজ্ঞাপনের অনেকগুলোই আসে এই এলাকা থেকে।

বিবিসি এখানকার চারজন বিক্রেতার সাথে বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিল। এজন্য একজনকে ছদ্মবেশী আইনজীবী হিসেবে পাঠানো হয়, যিনি নিজেকে কয়েকজন ধনী বিনিয়োগকারীর প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দেন। এক জমি বিক্রেতার নাম আলভিম সুজা আলভেস। তিনি স্থানীয় মুদ্রায় ১৬ হাজার ৪০০ পাউণ্ড দামে একটি প্লট বিক্রির চেষ্টা করছিলেন। এই জায়গাটি উরু ইউ ওয়াউওয়াউ নামে একটি সংরক্ষিত আদিবাসী এলাকায়।

এখানে ২০০ জনেরও বেশি উরু ইউ ওয়াউ ওয়াউ জনগোষ্ঠীর লোক বাস করে। এছাড়া ব্রাজিল সরকারের তধ্যমতে এখানে অন্তত আরো পাঁচটি জনগোষ্ঠী বাস করে যাদের সাথে বাইরের বিশ্বের কোনো যোগাযোগই হয়নি।

কিন্তু বৈঠকে আলভেস দাবি করেন, তার জায়গাটিকে কোনো ইন্ডিয়ান নেই। তিনি বলেন, এখানে কোনো ইন্ডিয়ান নেই। আমার জমিটা যেখানে- তারা সেখান থেকে ৩১ মাইল দূরে বাস করে। তবে এমন নয় যে সেখানে আপনি তাদের আনাগোনা দেখতে পাবেন না।

উরু ইউ ওয়াউ ওয়াউ সম্প্রদায়ের নেতা বিতাতে উরু ইউ ওয়াউওয়াউকে বিবিসি ফেসবুকের বিজ্ঞাপনটি দেখিয়েছিল। তিনি জানালেন, প্লটটি এমন এক জায়গায় যেখানে তারা শিকার, ফল সংগ্রহ ও মাছ ধরার জন্য ব্যবহার করেন।

তিনি বলেন, এখানে সম্মানের অভাব আছে। আমি এসব লোককে চিনি না। আমার মনে হয় তারা আদিবাসীদের জমির বন উজাড় করতে চায়, বলতে পারেন তারা আমাদের জীবনটাই উজাড় করতে চায়। এখানে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ করা উচিত। ফেসবুকের প্রতিও তিনি আহ্বান জানান স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।

বিবিসির ছদ্মবেশী রিপোর্টারকে আলভেস এক ব্যক্তির সাথে পরিচয় করিযে দেন, যিনি কুরুপিরা সমিতি নামে এক গোষ্ঠীর প্রধান। ব্রাজিলের ফেডারেল পুলিশ এ গ্রুপটিকে অবৈধ জমি দখলের সাথে যুক্ত বলে অভিহিত করেছে। তাদের কৌশল হচ্ছে, প্রথমে জঙ্গল কেটে সাফ করে ফেলা এবং তারপর জঙ্গল এখন আর নেই- এ যুক্তি দেখিয়ে তার সংরক্ষিত মর্যাদা বাতিল করিয়ে সরকারের কাছ থেকে সেই জমি কিনে নেয়া।

এজন্য উচ্চস্তরের রাজনীতিবিদদের সহায়তায় ব্রাসিলিয়াতে সরকারি সংস্থাগুলোর সাথে বৈঠকের আয়োজন করার তদ্বির চলছে বলেও জানান আলভেস। তাদের একজন প্রধান মিত্র হচ্ছেন কংগ্রেসম্যান কর্নেল ক্রিসোতোমো। তিনি সোশ্যাল লিবারেল পার্টির সদস্য। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো নিজের দল গঠনের আগে এই দলেরই সদস্য ছিলেন।

বিবিসি তার সাথে যোগাযোগ করলে ক্রিসোতোমো বৈঠকের আয়োজনে সহায়তার কথা স্বীকার করলেও বলেন, এই কুরুপিরা গোষ্ঠী যে জমি দখলের সাথে যুক্ত তা তিনি জানতেন না। এটা করে থাকলে তারা আমার সমর্থন আর পাবে না।

রন্ডনিয়ার একজন ফেডারেল কৌঁসুলি রাফায়েল বেভিলাকুইয়া বলেন, বর্তমান সরকারের সময় পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে।

ফেসবুক তাদের মার্কেটপ্লেসে আমাজনের জমি বিক্রি বন্ধ করার ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দেয় বলে মনে হচ্ছে না। তারা বলছে, কোনো বেচাকেনা অবৈধ তা বের করা খুবই জটিল এবং তা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও বিচারবিভাগেরই দেখা উচিত।

৩০ বছর ধরে রন্ডনিয়ায় বন উজাড়ের বিরুদ্ধে লড়ে আসা পরিবেশকর্মী ইভানেই বানদেইরা বলেন, তিনি এখন আশা হারিয়ে ফেলছেন। বনভূমি রক্ষা করা এর আগে কখনো এত কঠিন ছিল না। -বিবিসি

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh